
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলো বাঙালি জাতি তার বিজয় এসেছিলো সেই বছরের ১৬ ডিসেম্বর। লক্ষ লক্ষ জীবনের আত্মত্যাগের পরে এসেছিলো আমাদের কাঙ্খিত বিজয়। এই মাসটি আমাদের বাঙালি জাতির হৃদয়ে আনন্দ ও গৌরবের।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হবার পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর নির্যাতন শুরু করে। ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও বাঙালিরা যে তাদের প্রকৃত মুক্তি পায়নি তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি আমাদের। প্রথমেই পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য প্রথমেই তারা আমাদের ভাষাকে বেছে নেয়। অধিক সংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্যেও তারা উর্দু ভাষাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষা করার চেষ্টা চালায়। প্রতিবাদ শুরু হয় চারিদিকে। জেগে ওঠে বাঙালিরা। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের অবস্থান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এরপর প্রতিটি পদে পদে শুরু হয় নির্যাতন-বঞ্চনা। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফসল রফতানি করে সেই অর্থ দিয়ে কলকারখানা গড়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানে। শিক্ষায় সুযোগ সুবিধা পেতে থাকে তারা। বঞ্চিত হতে থাকি আমরা। সব বঞ্চনা আগ্নোয়গিরিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। আর তার পথ দেখায় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গন-অভ্যুত্থান শেষে আসে ৭০ এর নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতা পায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু হত টালবাহানা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিকল্প নেই। ১৯৭১ সালের ৭-ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে " এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সবাইকে যার যার জায়গা থেকে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। সেদিন তার অনলবর্ষী বক্তৃতা ও একটি তর্জনীর ইশারায় কেঁপে গিয়েছিলো পাকিস্তানি শাসকের ভিত্তি। সেই মাসের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলার নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা করে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ভয়ংকর রাত হয়তো আর আসবে না। বঙ্গবন্ধু সেই রাতে গ্রেফতার হবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা ২৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ তারিখে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা পঠিত হয়। দেশের জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমার্পণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন লজ্জাজনক আত্মসমার্পনের ইতিহাস আর নেই।
ডিসেম্বর মাস আমাদের কাছে আনন্দের-গৌরবের ঠিক তেমনি বেদনার। প্রায় ৫১ বছর ধরে প্রিয়জন হারানোর বেদনা, মা হারানোর বেদনা, পিতা হারানোর বেদনা, সন্তান হারানোর বেদনা, বোন হারানোর বেদনা, ভাই হারানোর বেদনা বয়ে চলেছি আমরা । এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ডিসেম্বর মাস এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। নৃশংসভাবে সেদিন তারা হত্যা করেছিলো আমাদের আপনজনদের। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। নারীদের লজ্জাস্থানে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো বেয়নেট। আটকে রেখে চালানো হতো নির্যাতন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বিজয়।
তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জীবনে এক অনন্যসাধারণ দিন। এদিন আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাই। আমাদের এই অর্জনকে অর্থবহ করে তুলতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা এখনো তৎপর আমাদের অর্জনকে মুঁছে দিতে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তবেই বিজয়ের সুফল ভোগ করতে পারবে সবাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছি। এখনো অনেকটা পথ বাকি। তবে সবাই একসাথে চেষ্টা করলে যত বাধাঁই আসুক আমরা সফলতা অর্জন করবই। বিজয়ের দিনে এই আমাদের অঙ্গিকার।
জয় বাংলা,
জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: অ্যাড. কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ.
বিবার্তা/জামাল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]