রাজনীতি
সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব-নির্যাতিত ছাত্রলীগের মোশাররফ, আকুতি শোনার কেউ নেই!
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:৪৪
সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব-নির্যাতিত ছাত্রলীগের মোশাররফ, আকুতি শোনার কেউ নেই!
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

শিবিরের হামলায় আহত হওয়ার পর বাবাকে হারালাম, দুই শিশু রেখে বিয়ের ৫ বছরের মাথায় স্ত্রী মারা গেল আর এখন আমার মাও শয্যাশায়ী। কিছুদিন আগে অপারেশন করিয়েছি। এখন অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। আমি অসুস্থ থাকার সময় অনেকে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু দশ বছরেও জীবন-জীবিকার কোন ব্যবস্থা হয়নি। এখন অন্ধকার সময় পার করছি। পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে নয়; আদর্শের লড়াইয়ের কারণে আমার এই অবস্থা! আদর্শের লড়াইয়ে সেদিন যদি মারা যেতাম, মনে হয় ওইটাই ভালো ছিল। আজকে ১০ বছরের মাথায় এতো কষ্ট, আর সহ্য হচ্ছে না ভাই- কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মোশাররফ হোসেন।


নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার দরিদ্র ঘরের সন্তান মোশাররফ। ২০০৭-০৮ সেশনে ভর্তি হয়েছিলেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই জড়িয়ে যান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেছেন।



কারমাইকেল কলেজে ২০১৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের হামলার শিকার হন তিনি। কেটে দেয়া হয় মোশাররফের হাত ও পায়ের রগ। রংপুর ও পরে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসায় সেই যাত্রায় বেঁচে ফিরেন তিনি। মোশাররফের আহত হবার খবর শুনে কিছুদিন পর তার পিতা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। আহত হওয়ার পর হাসপাতালে দেখতে গিয়ে মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে দলের নেতারা সুস্থ হলে মোশাররফের কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়েছিলেন।


কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেয়া নেতাদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে চাকরির বয়স পার করে ফেলেছেন- তবে চাকরি নামের সেই সোনার হরিণ মোশাররফের ভাগ্যে জুটেনি। গুরুতর আহত মোশাররফের শয্যার কাছে গিয়ে মন্ত্রী বা নেতার পাশে থাকার আশ্বাসের ১০ বছর পার হলেও কেউ কথা রাখেননি। এমনকি তারা ভুল করেও আর খোঁজ নেননি।


চলতি বছরের মে মাসে সাত মাস ও চার বছর বয়সী দুই সন্তানকে রেখে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মোশাররফের স্ত্রী মারা গেছেন। স্ত্রীর চিকিৎসা চালাতে গিয়ে আয়ের সামান্য কৃষিজমিটুকুও বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। দুই শিশু কন্যা, অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করছে মোশাররফের পরিবার।


জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত মোশাররফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিবার্তাকে বলেন, আমার বৃদ্ধা মাকে গত ৬ তারিখে অপারেশন করিয়েছি। ওনার পিত্তথলিতে পাথর, টিউমার। সম্ভবত ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তার পূর্বানুমান করে বলেছেন, মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন, সম্ভবত পিত্তথলিতে ক্যান্সার হয়েছে। পিত্তথলির ক্যান্সার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।


তিনি বলেন, আমরা দুইটা মেয়ে। একটার বয়স ১১ মাস আর আরেকটার বয়স প্রায় পাঁচ বছর। তাদের নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি। শিবিরের হামলায় আহত হওয়ার পর হাসপাতালে দেখতে গিয়ে অনেকে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোথাও একটু সহযোগিতাও পাইনি, খালি আশ্বাসই পাইছি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে দুইবার ভাইভা দিয়েছি, চাকরি হয়নি।


কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়া ব্যক্তিদের কাছে বারবার গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে জানিয়ে সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, আমি সুস্থ হওয়ার পর আমাদের এমপি সাহেব আসাদুজ্জামান নূর ভাই আমার পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি ঘোষণা দিয়েছিলেন মোশাররফের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। পঙ্গু হাসপাতালে যখন ছিলাম ওখানে দেখতে গিয়েছিলেন। তখনও উনি বলছেন দায়িত্ব নিছেন, আজকেও সেই দায়িত্ব পালন করছেন! প্রধানমন্ত্রীর সাথে বহুবার সাক্ষাতের চেষ্টা করেছি। সাইফুজ্জামান শিখর ভাই, জাহাঙ্গীর আলম বুলবুল ভাই প্রধানমন্ত্রীর পিএস-এপিএস ছিলেন। অনেকবার গেছি, ওনারা বিরক্ত হয়ে গেছিল। আমিও তিক্ত হয়ে গেছি। শেষে আর কোথাও না যেয়ে এলাকায় টুকিটাকি ব্যবসা করার চেষ্টা করেছি। কী করব আর? আদর্শ লালন করে মান-অভিমান নিয়ে বেঁচে আছি।


সবকিছু যদি দেখতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে তাহলে নেতা-এমপিরা কিসের জন্য আছে? এরা খালি মুখে বলে। কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নাই- বলেন মোশাররফ।


তিনি বলেন, বহু জনের কাছ থেকে বহু আশ্বাস পেয়েছি- এখন আর অভিমানে যাই না। তারপরও দলে আছি। এখন ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে আছি। দলকে ভালোবাসি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের সময় সংগঠক ছিলেন- কিন্তু ওনার সার্টিফিকেট নেই। ওনার কাছ থেকেই বঙ্গবন্ধুর কথা, আওয়ামী লীগের কথা শুনে শুনেই বড় হয়েছি। সেই আদর্শ লালন করে শেষে এই অবস্থা। এখন পরিচয়ও দিতে পারি না যে আমি ছাত্রলীগের সাবেক অমুক অমুক... এগুলো এখন কাউকে বলিও না। লজ্জায় বলি না। আমি এতটাই রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে গেছি।


বর্তমান শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে বলেন, মাঝে মাঝে হাত পায়ে কামড় দেয়। পঙ্গু মানুষ, এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।


সেদিনের পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করে মোশাররফ বলেন, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপির ৯০ দিনের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ছিল। এর মধ্যে একটা সমাবেশ ছিল রংপুরে। জামায়াত-শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছিল রংপুর। সমাবেশের পূর্বে পাথর, ককটেলসহ জামায়াত-শিবিরের কয়েকজনকে ধরি। তখন আমি দর্শনা কলেজ পাড়া ইউনিটের সেক্রেটারি ছিলাম। এতে তারা খুবই সংক্ষুব্ধ হয়। পরে ১৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১টা ২৫ মিনিটে আমার ওপর হামলা হয়।



আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে নয়; আদর্শের লড়াই থেকে আমার আজকের এই অবস্থা। আদর্শের লড়াইয়ে গিয়ে সেদিন যদি মারা যেতাম মনে হয় ওইটাই ভালো ছিল। আজকে ১০ বছরের মাথায় এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছে না ভাই। আমার বাবাকে হারালাম, কিছুদিন পর স্ত্রীকে হারালাম। স্ত্রীকে হাসপাতাল দেখতে যাওয়ার সময় আমার শশুরও মারা যান। একজন আশ্রয় ছিলেন, তিনিও মারা গেলেন। কি করবো? একেবারে অসহায় হয়ে গেছি। আমার মাও বিধবা, শাশুড়িও বিধবা- আক্ষেপ করে বলেন মোশাররফ।


তিনি বলেন, সব মিলিয়ে একটা অস্থির পৃথিবীতে আছি। মানবিকতার অকালে ভুগতেছি। এর শেষ কোথায়, সীমানা কোথায়? স্রষ্টাই ভালো জানেন। উনি সৃষ্টি করেছেন উনি রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। কতজন কত আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে কাউকে পাশে পাইনি। আমার একমাত্র আশ্বাসের জায়গা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওনার হিসাবটা আলাদা। উনি হৃদয়ে আছেন, ওনাকে ভালোবাসি। ওনার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান বাদশা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মোশাররফ হোসেনের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে লিখেছেন, ছাত্রলীগের দুর্দিনের সহযোদ্ধা মোশাররফ জমিজমার বিরোধ বা ব্যক্তিগত কোন বিরোধে শিবিরের হামলায় আহত হননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করে ছাত্রলীগ করার কারণে তার রগ কাটা হয়েছিল।


তিনি বলেন, দেশের অনেক নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদান পান। অনেক মন্ত্রী-এমপি-নেতা অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু মোশাররফের পাশে দাঁড়ানোর মতো কি কেউ নেই?


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com