কলকাতার অনতিদূরে কয়েক দিনের ছুটির ঠিকানা হতেই পারে ঘাটশিলা। ঘাটশিলা ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার শহর। ভারতের কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয় ২১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই স্থান।
সুবর্ণারেখা নদীর ঘাটে শত শত শিলা শায়িত বলে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে ঘাটশিলা।
এখানেই রয়েছে তামার খনি। ঘাটশিলা ঝাড়খন্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। ছোট্ট জেলার মানুষের জন জীবন, নদীর স্রোত,পাহাড় ও জঙ্গলের মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়াই দেখতে সারা বছর বাঙালিদের ভিড় জমে ঘাটশিলায়।
সুর্বণরেখা নদীর হাওয়ায় ধুয়ে যাবে সারা বছরের ক্লান্তি। ঘাটশিলার জনজীবন, নদীর চোরা স্রোত, পাহাড় আর জঙ্গলে মিশে পুজোর দিনগুলি দিব্যি কেটে যাবে। এমনিতে সারা বছরই মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে এখানে। তবে পুজোর সময়ে ফাঁকা পেলেও পেতে পারেন। একটা বছর রাত জেগে ঠাকুর না দেখে বরং ফুলডুংরি টিলা, ধারাগিরির ঝরনা, বুরুডি লেক, পঞ্চপাণ্ডব পাহাড়, রাতমোহনা, গালুডিহি ব্যারেজ দেখতেই পারেন।
ঘাটশিলা অতীতে ধলভূমের সদর দপ্তর ছিল। এখানে একটি রেলওয়ে স্টেশন আছে যেটি দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের অন্তর্ভুক্ত। ঝাড়খন্ডে অবস্থিত হলেও স্থানীয় অধিবাসীদের বৃহৎ অংশ বাংলা ভাষাভাষী।
ঘাটশিলা সতেজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এবং ঝাড়খণ্ডের একটি বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত। বিপুল সংখ্যক বাঙালি পর্যটক আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য সেখানে যাচ্ছেন।
ঘাটশিলা বাঙালি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জন্যও বিখ্যাত, তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ “পথের পাঁচালী”র ছবি মনে করিয়ে দেয় আমাদের এই ঘাটশিলা।
এই শহরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি রয়েছে এবং বিহারী, বাঙালি, গুজরাটি, মারোয়ারি, পাঞ্জাবি এবং অন্যান্যদের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠী এখানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রীতির সাথে বাস করে।
ঘাটশিলার দর্শনীয় স্থান:
ফুলডুংরী টিলা:
ফুলডুংরী টিলা ওখানকার বিখ্যাত পাহাড় যা ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে জাতীয় হাইওয়েতে অবস্থিত।
একটি সর্পিল পথ রয়েছে যার মধ্য দিয়ে যে কেউ পাহাড়ের চূড়ায় যেতে পারে।পাহাড়টি প্রচুর পরিমাণে লম্বা সাল গাছ এবং এর পথটি লাল নুড়ি দ্বারা আবৃত যা প্রচুর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
ফুলডুংরী পাহাড়ের চূড়া থেকে ঘাটশিলা শহরের একটি দুর্দান্ত দৃশ্য দেখতে পারবেন।
ধারাগিরি ফলস:
ধরগিরি জলপ্রপাত ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এটি ধারগিরি পাহাড় থেকে ২১ ফুট নিচে নেমে আসে এই জলপ্রপাতটি আপনি দেখতে পাবেন।
এখানে একটি প্রাগৈতিহাসিক পাথর বর্ষণ ঝর্ণা নদীর রয়েছে এবং একটি কালী মন্দির পাবেন। এই অঞ্চলটি একটি বনাঞ্চল পাহাড়ী ধরণের।
যারা অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং পছন্দ করেন তারা এটি বিশেষ পছন্দ করবেন। পাথুরে পথ ধরে হাইকিং করে যেতে হবে।
বুরুডি লেক:
ঘাটশিলা থেকে ৬ কিমি উত্তরে বুরুডি লেকটি স্থাপিত।লেকের চারপাশে শাল পিয়ালের বন।এটি মূলত ব্রিটিশ শাসনে নির্মিত হয়েছিল।
বিন্দা মেলা প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হ্রদের তীরে ঘাটশিলায় পনের দিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়।
এটি বিশেষত সাঁওতাল উপজাতির জন্য খুব জনপ্রিয় একটি নৌকাখেলা। এখানে বোটিং করার সুযোগ রয়েছে। বোটিং করার জন্য জন প্রতি সম্ভবত ৫০/- টাকা করে।
রঙ্কিনীদেবীর মন্দির:
ঘাটশিলার রঙ্কিনী কালী মন্দিরটি কালিমাতার উপাসনা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল, এটি “রঙ্কিনী মাতা” নামে পরিচিত।
অতীত কাহিনী অনুসারে ঘাটশিলার মন্দিরে নরবলী করা হয়েছিল। স্থানীয় লোকদের মধ্যে রঙ্কিনী দেবী অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তারা মা রঙ্কিনী দেবতার শক্তি এবং প্রভাবকে বিশ্বাস করেন।
আপনি যাদুগোরা পাহাড়েও ভ্রমণ করতে পারেন যা এই মন্দিরের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত।
পঞ্চ পান্ডব পাহাড়:
পঞ্চ পাণ্ডব ঘাটশিলা থেকে উত্তর-পূর্বে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে একটি ছোট পাহাড়।এটি একটি পাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য,যা পাথর ক্ষয়ের কারণে পাঁচ জন পুরুষের মাথা হিসাবে স্থাপিত হয়েছে।
লোকেরা এটিকে পাণ্ডবের পাঁচ ভাইয়ের প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করেছিলেন, এঁরা সকলেই মহাভারতের হিন্দু পৌরাণিক মহাকাব্যের বীরত্বপূর্ণ চরিত্র।
রাতমোহনা:
সুবর্ণরেখার তীরে ঘাটশিলার কাছে রতমোহনা একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। এটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত।
গালুডিহি ব্যারেজ:
মূলত সূর্যাস্তের সময় অপূর্ব লাগে এই ব্যারেজ দেখতে। কাছেই রয়েছে আদিবাসীদের গ্রাম। হেঁটে হেঁটে যেতে, ভ্রমণ প্রেমীদের ভালোই লাগবে।
গৌরী কুঞ্জ:
সাহিত্য প্রেমী বাঙালির অতি প্রিয় একটি নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।এই গৌর কুঞ্জ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
তাঁর স্ত্রী’র নাম অনুসারে এই বাড়ির নামকরণ করা হয়। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত করা হয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে ঘাটশিলা ফলস,সিদ্ধেশর পাহাড়ের শিব মন্দির,নারোয়া ফরেস্ট,হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড, পূর্ণ পানি, মোসাবোনি খনি, যাদুগোড়া, সুরদা পাহাড়, মৌভান্ডার, তুমানডংগ্রি, সুবর্ণরেখা, কেরুকোচা, বাবা ভৈরব ইত্যাদি স্থান।
ঘাটশিলা ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় দর্শকদের কাছে পিকনিক স্পট হিসাবেও বিখ্যাত।
কী ভাবে যাবেন ঘাটশিলা?
হাওড়া থেকে ঘাটশিলার উদ্দেশে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে। এ ছাড়াও রয়েছে হাওড়া ইস্পাত এক্সপ্রেস, স্টিল এক্সপ্রেস, টাটানগর ফেস্টিভ্যাল স্পেশ্যাল। ঘাটশিলা যাওয়ার ট্রেনের ভাড়া ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। ঘাটশিলা স্টেশনে নেমে বেশ কিছু অটো এবং গাড়ি আছে। সেগুলির কোনও একটি ভাড়া করে নিলে সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। ঘাটশিলার দর্শনীয় স্থানগুলি গাড়ি করেই দেখে নিতে পারবেন। গাড়ির কোনও নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। তবে আগে থেকে বুক করে গেলে সুবিধা হবে। গুগলে ঘেঁটে ঘাটশিলার অটো কিংবা গাড়ির ড্রাইভারের ফোন নম্বর পেয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন?
সকাল ১০টার মধ্যে ঘাটশিলা পৌঁছে গেলে সে দিনই সন্ধ্যার ট্রেন ধরে রাতে ফিরে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে থাকার জন্য আলাদা খরচ হবে না। শুধু খাওয়ার খরচ। তবে অনেকেই এত ধকল নিতে চান না। ধীরেসুস্থে নতুন জায়গায় কয়েক দিন কাটিয়ে আসতে চান। সে ক্ষেত্রে কিন্তু ঘাটশিলায় বেশ কিছু বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। সেগুলিরও কোনও একটিতে থাকতে পারেন। হোম স্টেগুলির প্রতি রাতের ভাড়া পড়বে খাওয়াদাওয়া-সহ ১০০০-১২০০ টাকা। দু’দিন থাকলেও সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হবে না।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]