তবে কি প্রমোদতরি গঙ্গা বিলাস হুমকিস্বরূপ?
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫২
তবে কি প্রমোদতরি গঙ্গা বিলাস হুমকিস্বরূপ?
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

গঙ্গা বিলাস। প্রমোদতরি। বেড়িয়েছে ৫১ দিনের ভ্রমণে। এই ভ্রমণে প্রমোদতরিটি ভারতের ৫টি রাজ্য এবং বাংলাদেশের কিছু অংশের ভেতর দিয়ে মোট ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে।


এ ভ্রমণপথে থাকছে ভারতের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান, জাতীয় উদ্যান, বন্দর এবং বিহারের পাটনা, ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, বাংলাদেশের ঢাকা এবং আসামের গৌহাটিসহ ৫০টি পর্যটন স্পট। এটি প্রায় ২৭টি নদী ও চ্যানেল দিয়ে যাবে।


মোট ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারের যাত্রাপথে এটি যাবে বাংলাদেশ ও ভারতের ২৭টি নদীর ওপর দিয়ে। প্রমোদতরিটির চলাচলের কারণে বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। 


পর্যটকদের ‘বিশ্বের দীর্ঘতম নৌবিহারের’ স্বাদ পাইয়ে দিতে এমভি গঙ্গা বিলাস নামের এই বিলাসবহুল প্রমোদতরি চালু করেছে ভারত সরকার। গত ১৩ জানুয়ারি এ প্রমোদতরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ প্রমোদতরি যাত্রা শুরু করেছে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারানসি থেকে। পাড়ি দেবে মোট ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হয়ে এটির গন্তব্য আসামের ডিব্রুগড়। ৫১ দিনের এ নৌবিহার ভারত ও বাংলাদেশের ২৭টি নদীর ওপর দিয়ে যাবে। 


তিনতলার এ প্রমোদতরিতে রয়েছে ১৮টি কক্ষ। নদী ও সাগরপথে পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে মাঠে নেমেছে ভারত সরকার। গঙ্গা বিলাসে করে নৌবিহার এর সাম্প্রতিকতম উদ্যোগ। গঙ্গা নদীতে এ নৌবিহারকে এক ‘যুগান্তকারী মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন মোদি। তাঁর কথায়, এর মধ্য দিয়ে ভারতের পর্যটন খাতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। 


তবে ‘বিশ্বের দীর্ঘতম’ এ নৌবিহার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা ছাড়াও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকে। তাঁরা বলছেন, নদীগুলোতে এমন পর্যটকবাহী নৌযানের চলাচল বাড়লে তা গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এই ডলফিনের বৈজ্ঞানিক নাম প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা। 


গঙ্গা বিলাসের যাত্রাপথে পড়বে উত্তর প্রদেশের কাইথি গ্রাম। এটির অবস্থান বারানসি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে; গঙ্গা ও গোমতী নদীর মোহনায়। স্থানটির আশপাশে পানির গভীরতা বেশি, স্রোতও বয়ে যায় বেশ ধীরগতিতে। ফলে এলাকাটি বিপন্ন এই ডলফিনের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল। গত অক্টোবরে গঙ্গা ও গোমতীর সঙ্গমস্থলে গাঙ্গেয় ডলফিনের একটি ঝাঁক দেখতে পান ভারতে বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা সরকারি কর্মকর্তারা। ওই ঝাঁকে কয়েকটি ডলফিন শাবকও ছিল। পরে কর্মকর্তারা জানান, ওই এলাকায় ৩৫ থেকে ৩৯টি ডলফিনের বসবাস রয়েছে।


ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সিটাসিয়া গোত্রের। নৌবিহারে গঙ্গা বিলাস যে পথ দিয়ে যাবে, এর মধ্যে গঙ্গা ও গোমতীর মোহনা এ গোত্রের প্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত আবাসস্থলগুলোর একটি। যাত্রাপথে এমন আরেকটি সংরক্ষিত আবাসস্থল হলো, বিহারের বিক্রমশিলা গাঙ্গেয় ডলফিন অভয়ারণ্য।


দক্ষিণ এশিয়ায় দুটি মিঠাপানির ডলফিনের জাতের বসবাস রয়েছে। একটি প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা (গাঙ্গেয় ডলফিন)। অপরটি প্লাটানিস্টা মাইনর বা সিন্ধু নদের ডলফিন। এটি পাওয়া যায় পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের বিয়াস নদীতে। তবে দূষণ, চোরা শিকার ও অত্যধিক মাত্রায় পানিনিষ্কাশনের মতো বিভিন্ন হুমকির মুখে রয়েছে গাঙ্গেয় ডলফিন। 


বর্তমানে এনডব্লিউ-১ গঙ্গা ও এনডব্লিউ-২ ব্রহ্মপুত্র নৌপথে প্রায় ১০০ প্রমোদতরি চলাচল করছে। সংখ্যাটা ১০ গুণ বাড়ানোর পথে হাঁটছে ভারত সরকার। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নৌবিহারের সংখ্যা এ পর্যায়ে বৃদ্ধি করা হলে তা নদীর বাস্তুসংস্থানের ওপর ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলতে হয়, গঙ্গার বারানসি অংশে সাত কিলোমিটার সংরক্ষিত এলাকাজুড়ে কচ্ছপের একটি অভয়ারণ্যের কথা। ২০১৯ সালে অভয়ারণ্যটিতে আর কচ্ছপের দেখা পাওয়া যায়নি। সমালোচকেরা বলছেন, এ এলাকার নৌপথের উন্নয়নের কারণেই অভয়ারণ্যটি ধ্বংস হয়ে গেছে। 


প্রমোদতরির চলাচলের জন্য ন্যূনতম গভীরতা ধরে রাখতে এনডব্লিউ-১ গঙ্গা নৌপথে নিয়মিত খনন করার প্রয়োজন পড়বে। এতে সৃষ্টি হবে উচ্চমাত্রার কম্পন ও শব্দদূষণ। এটি নদীর জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। 


ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপথ কর্তৃপক্ষ একটি পরিবেশগত মূল্যায়ন করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, খননের ফলে সৃষ্ট শব্দদূষণের কারণে মাছ, ডলফিন ও কচ্ছপের আচরণে যে পরিবর্তন এসেছে, তা ‘উল্লেখ করার মতো না-ও হতে পারে’। এ শব্দদূষণ এগুলোর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে হয় না। কারণ, খননের সময় এসব প্রাণী সাধারণত ওই জায়গা থেকে সরে যায়।


তবে কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য মানতে নারাজ গঙ্গার উন্নয়নে কাজ করা বিহার রাজ্যের একটি কমিটির (গঙ্গা রেজুভিনেশন, প্রোটেকশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি) সদস্য সুনীল কুমার চৌধুরী। তাঁর ভাষ্যমতে, নদী সাগরের মতো বিস্তৃত নয়। নদীতে জলজ প্রাণীদের চলাচলের স্থান সীমাবদ্ধ। ফলে ড্রেজিংয়ের সময় ওই স্থান থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ নদীর ডলফিনের থাকে না। 


ভারত সরকার ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে’ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনেভিত্তিক মন্থন অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষক অভিল ভার্মা। পানি ও জ্বালানিসংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে গবেষণায় যুক্ত রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। অভিল ভার্মা বলেন, 
‘আজ যদি সতর্কতামূলক (পরিবেশ) সংরক্ষণ নীতিমালা প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে নৌপথগুলো দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে না। গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল ও অস্তিত্ব বিপদের মুখে ফেলে আপনি গঙ্গায় নৌবিহারকে ইকো-ট্যুরিজম (প্রকৃতির ক্ষতি না করে পর্যটন) হিসেবে প্রচারণা চালাতে পারেন না।’


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com