ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৬৭তম বার্ষিকী
ভাসানীর ঐতিহাসিক কীর্তি ৫৭’র কাগমারী সম্মেলন
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৫৮
ভাসানীর ঐতিহাসিক কীর্তি ৫৭’র কাগমারী সম্মেলন
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রিন্ট অ-অ+

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন। এর মধ্যে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি এবং উপমহাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’। উপমহাদেশ ও পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য গবেষকদের কাছে স্বীকৃত।


পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিন ব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় ‘রুপমহল’ সিনেমা হলে। ওই অধিবেশনে বলা হয়েছিল- ‘... পাকিস্তান সরকারের গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যে সব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হইয়াছে।’ ৫৬-র ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুর’-হিসাবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই জাতীয় প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃঞ্সার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।


দু’টি প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পরিণত হয়, যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, অপরটি সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দুটি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপোষ প্রবণ ও নমনীয়। পক্ষান্তরে মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপসহীন। অবশ্য এই দুটি বিষয় কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি। দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে যখন মতবিরোধ চরমে তখনই মওলানা ভাসানী দলীয় প্রধান হিসাবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারিতে। ভাসানী যখন কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছেন তখন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তদুপরি ওইসময়ে বৈদেশিক নীতি- বিশেষ করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিসমূহ ও সামরিক চুক্তি সম্পাদন তথা ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি’ ও ‘বাগদাদ চুক্তি’ সংস্থার সদস্য ভুক্তির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত দ্বৈধতা চরম আকার ধারণ করেছিল বলে কাগমারী সম্মেলনটির বিশেষ গুরুত্ব দেখা দিয়েছিল।


প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে মতবিরোধ নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাগমারী সম্মেলনের ঘোষণা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির অন্তরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কাম রাজনৈতিক সম্মেলনে রূপ নেয়। ওই সম্মেলনকে ঘিরে যেমন পাকিস্তানি ‘দর্শনে’র সমর্থকরা বিরূপ সমালোচনায় মুখর ছিলো, তেমনই আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বলে পরিচিত এবং প্রকৃত প্রস্তাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থিত পত্র-পত্রিকাগুলোও কাগমারী সম্মেলনকে সুনজরে দেখেনি, বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিরূপ সমালোচনা করেছিল।


উল্লেখ্য যে, কাগমারী সম্মেলনের মাত্র স্বল্প সময়ের মাথায় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপসারণ এবং সর্বশেষ ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ও সামরিক শাসন জারির মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এসব কারণেই স্বাধীন জাতিরূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি ভিত ভূমি নির্মাণে কাগমারী সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।


কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষ্যে ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার গরীব চাষি, মজুর, ছাত্র-যুবক ও জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন ‘এদেশে শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারি কর্মচারীদের নহে, এদেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যাহারা এদেশ পরিচালিত করেন, তাহারা শতকরা ৯৫ জন গরীব চাষি, মজুর, কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণির জনসাধারণের টাকা দিয়াই চলে। ...পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায় এবং ২১ দফার বাকী ১৪ দফা দাবি পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুমুল আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হবে।


দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি হইতে সপ্তাহব্যাপী সন্তোষ কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিয়া জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।’


৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়- *সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক, * ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাকা, * চাষী-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সকল শ্রেণির মিলনের ডাক, * পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক, * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়নের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। -মওলানা ভাসানী


যখন তাঁর দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন এই বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার প্রায় সকল মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলন সফল করতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন হয়েছিল তার অন্যতম সদস্যরা হলেন- ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মো. ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী ও আবু জাফর শামসুদ্দিন।


সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তায় অসংখ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আর সেই তোরণগুলির নামকরণ করা হয়েছিল বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো হযরত মোহাম্মদ (সা.), মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি ইকবাল, নেতাজী সুভাস বোস, হাজী শরিয়তউল্লাহ, শহীদ তিতুমীর, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, হাজী মোহাম্মদ মহসীন, সি. আর. দাস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং, ওয়ার্ড ওয়ার্থ, বায়রন, শেলী, মাওলানা রুমী, হযরত ঈমাম আবু হানিফা, হযরত ঈমাম গাজ্জালী এভাবে ৫১টি তোরণের নাম করণ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদ-ই আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তোরণ।


এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র নায়কদের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো অথবা তার প্রতিনিধি, পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জহরলাল নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠিতে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে তাঁর সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন।


স্বাগত বক্তব্যে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুই ধরনের আলোচনাই রেখেছিলেন। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলেও সামরিক-বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। ৮ ফেব্রুয়ারি মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।


কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক- বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবসমূহ সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সুচারুরূপে সমাপ্ত হয়। ওই সম্মেলনের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও তাঁর সমর্থিত নেতা কর্মীদের আওয়ামী লীগের সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।


প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নীতির প্রশ্নে আপোসের কোন সুযোগ ছিল না। তারা বলেছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থি জোটভুক্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিহা ছিল। আর অন্যদিকে এসব প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপোষহীন। তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোন উচ্চবাচ্চ করেননি।


যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতাই নন- আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেছেন দেশের সকল এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি সত্বেও পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল কাজও করেছে, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল ছাড়ার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শের ও নীতির সঙ্গে আপোষ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না।


সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তাঁর ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ৫৭-র ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলন মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুললেন, পক্ষান্তরে সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন- পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থিদের সাথে একটি বোঝা পড়ার চেষ্টা চালান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।


১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবাবলি যেমন পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি ইত্যাদি নিয়ে ওই সভায় দীর্ঘ আলোচনা চলে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর সমর্থকদের মার্কিন ঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুগতরা অবিচল ছিলেন। উভয় পক্ষই তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কী তাও তারা জানতেন। তবুও আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যসম্ভাবী হয়ে পড়ে।


সম্মেলনের পর ১৯৫৭ সালের ২৬ মার্চ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’- “ভাইসব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের উপর। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতীত সাড়ে চার কোটি বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনে মুক্তি অসম্ভব।… গদির মোহে মুসলীম লীগের সহিত হাত মিলাইয়া সারে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবি বিসর্জন দিয়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাশ করিয়া ছিল, তাহারাই পুনরায় সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সহিত হাত মিলাইয়া বর্তমানে আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোস্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারা দেশময় মিথ্যা প্রচার শুরু করিয়াছে। এসব কুচক্রীদের দেশবাসী ভাল করিয়াই চিনে। তাহারাই গত ৯ বছর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে।”


১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিতে মওলানা ভাসানীর আমন্ত্রণে যে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল আসে তাতে ছিলেন দলনেতা হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার স্যানাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ। সম্মেলনের আয়োজন দেখে তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই বিস্মিত হন।


প্রবোধকুমার স্যানাল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, 'এখানকার সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যে আমি প্রাণের অভিব্যক্তি দেখেছি। সম্মেলনের আশপাশে যে সভা দেখেছি তা অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর। এই সার্থকতার ব্যাকুলতা, স্নেহ ও বন্ধুত্ব, মৈত্রী ও সাম্যের প্রতি অনুরাগের বাঙালি-প্রাণের এত বড় আয়োজন আর কোথাও দেখিনি। পূর্ববাংলা আজ এক আদর্শ মিলন-মোহনায় পরিণত হয়েছে। এখানে এসে এই মিলন মোহনায় অবগাহন করলাম।’


কাগমারী সম্মেলনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দেশে গিয়ে লেখালেখি করেন এবং সভা-সমাবেশে বলেন, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে থেকে কথিকা প্রচার করা হয়। সেগুলোর কিছু বেতার-জগৎ-এ প্রচারিত হয়। তারাশঙ্কর তার সফরের অভিজ্ঞতা অন্নদাশঙ্কর রায় ও অন্যান্যকে বলেন। সে-সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর বহু পরে- তারাশঙ্কর ও মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর কিছু লিখেছেনও।


তারাশঙ্কর কাগমারী সম্মেলন শেষে বলেছিলেন, মওলানা সম্পর্কে কত দুর্নাম শুনেছি। কয়েকদিন কাছে থেকে দেখে বুঝতে পারলাম ওসবের কোনো সত্যতা নেই। প্রতিপক্ষ অনেক কিছু রটায়, তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে। আসলে তিনি সোজা-সরল ধরনের মানুষ। রেখে ঢেকে মেপে বুঝে কথা বলতে জানেন না। মনে যা ভাবেন তাই মুখে বলে ফেলেন। খোলামেলা মানুষ। তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া তিনি মাটির মানুষের একেবারে কাছে আছেন। তাদের সুখ-দুঃখ-অনুভূতি তিনি ভালো বোঝেন, যা উপমহাদেশের আর কোন নেতা অনুভব করতে পারেন না। ভাসানীর রাজনীতি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের রাজনীতি- প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।


অন্নদাশঙ্কর ভাসানীকে নিয়ে লিখেছেন একটি চমৎকার ছড়া। ছড়াটির প্রথম দুই পঙ্ক্তি হলো-


মহান নেতা ভাসানী
ভারতকে দেন শাসানি।


শেষ করতে চাই এইভাবে, বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে অবদান রেখেছেন- তার জন্য যে সম্মান তিনি প্রাপ্য ছিলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসেও সরকারগুলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোন কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।


লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন


বিবার্তা/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com