তরিকায়ে সোহরাওয়ার্দীয়া ও বাংলায় আগমন
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ২১:২২
তরিকায়ে সোহরাওয়ার্দীয়া ও বাংলায় আগমন
মৌলভি মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রিন্ট অ-অ+

সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা হলো একটি আধ্যাত্মিক মতবাদ। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি ইরানের শেখ নাজীবউদ্দীন আবদুল কাদির (রহ.) (মৃ. ১১৬৯ খ্রি :) এই মতবাদ প্রচার শুরু করেন। তাঁর জন্ম ইরানের জীবাল প্রদেশের সুহরার্দ নগরে। এ কারণেই এ তরিকার নাম হয়েছে সোহরাওয়ার্দীয়া।


আবদুল কাদিরের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ শাহাবউদ্দীন আবু হাফ্স উমর ইবন আবদুল্লাহ (রহ.) এ তরিকার বিশেষ উৎকর্ষ সাধন করেন। এজন্য তাঁকেই সোহওয়ার্দীয়া তরিকার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। ইরানের শাসকগণ তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন; ফারসি কবি হযরত শেখ সাদী (রহ.)ও তাঁর শিষ্য ছিলেন।


সাধক শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী ১১৪৫ সালে তার জন্ম হয়। তার জম্ম নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পাওয়া যায়। পিরদের জীবন বৃত্তান্তে এ ধরনের অসংলগ্নতা ও অসামঞ্জস্যতা প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে যারা শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর (র.) জীবনবৃত্তান্ত রচনা করেছেন তাদের মধ্যে ইবনে খালেকানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার নাম আহমদ, কনিয়াত বা উপনাম আবুল আব্বাস। তিনি আহমদ বারমাকী নামেও পরিচিত। আব্বাসীয় যুগে খালেদ বারমাকীর বংশে জন্মগ্রহণ করায় তার নামের সাথে বারমাকী ব্যবহার করা হয়। মোসেলের নিকটবর্তী ইরবিলে হিজরি ৬০৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষায় সুফীতত্ত্বের ওপর প্রচুর বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে এবং তরিকতের আলোচনায় সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার বর্ণনাও স্থান পেয়েছে। শেখ শাহাবুদ্দীন এর জীবনবৃত্তান্ত অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত এবং সংক্ষেপে আলোচিত হলেও সর্বত্র সঠিক ও যথার্থভাবে বর্ণিত হয়েছে বলে দাবি করা যায় না।


আবদুল্লাহ তাসাওউফ বিষয়ে আওয়ারিফ-উল্লমা’আরিফ গ্রন্থ রচনা করেন। তাতে সুফিদের খানকাহ, খানকাহর জীবনযাপন পদ্ধতি এবং প্রচলিত নিয়মকানুন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থখানি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে। ভারতে এ তরিকার আদি পুরুষ ছিলেন শেখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানি (১১৬৯-১২৬৬)। সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ তাঁকে ‘শায়খ-উল-ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। শেখ শাহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ও শেখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার বন্ধু শেখ জালালুদ্দীন তাবরেজী (র.) লক্ষ্মণ সেনের সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং প্রথম সোহরাওয়ার্দীয়া মতবাদ প্রচার করেন। এখানে তাঁর শিষ্যগণ ‘জালালিয়া’ নামে পরিচিত।


শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (র.) এর মতে এই তরিকার ভিত্তি হইলো :
১) জওক (আধ্যাত্মিক স্বাধ গ্রহণ)
২) ওয়াজস (উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা)


এই তরিকার সাধকগণ কখনো জাহির আবার কখনো বাতিন থাকেন। সিলেটের হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী মুজাদ্দেদী (রহ.) সোহরাওয়ার্দী তরিকার অনুসারী ছিলেন। হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী রহ. এই তরিকার জাহেরী ও বাতেনি উভয় অবস্থার ইমাম ও কুতুব ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সম্প্রদায়ের মধ্যে সামা একটি প্রচলিত বিষয়। তারা এর মাধ্যমে হৃদয়কে উজ্জীবিত করে ও আধ্যাত্মিকভাবে বিভোর হয়। এরূপ ভাবোন্মত্ত অবস্থায় কখনো কখনো তারা নৃত্যও করে থাকেন।



সোহরাওয়ার্দী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর চাচা আবু নাজিব সিদ্দিকী সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে নেন। তিনি তাঁর বাগদাদে যান ও সেখানে ইসলামী আইনশাস্ত্র, আইন, যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, কুরআন ও হাদিস শিক্ষা অধ্যয়ন করেন এবং আবদুল কাদের জিলানীর কাছ থেকেও আধ্যাত্মিকতার জ্ঞানার্জন করেন। তিনি দ্রুত তাঁর অধ্যয়নে পারদর্শী হন এবং অল্প বয়সেই শাফেয়ী ও হাম্বলি মাযহাব আয়ত্ত করেন। আব্বাসীয়দের অধীনে খলিফা আল-নাসির দ্বারা সোহরাওয়ার্দীকে অবশেষে শায়খুল ইসলাম হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল।



শেখ শাহাবুদ্দীনের তাসাওফ শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণকারী ভক্ত-অনুসারীদের মুখে তার বহু কারামাত বা অলৌকিক ঘটনার বিবরণ শোনা যেত। বর্ণিত আছে যে, তিনি বহুবার পবিত্র হজ পালন করেন। যাত্রাপথে তাঁর সমসাময়িক সুফী মাশায়েখ লিখিত চিঠিপত্র প্রশ্নাকারে তাঁর হস্তগত হতো এবং তাঁর কাছে জবাব প্রার্থনা করা হতো। তিনি জবাবে বলতেন : এ মাল, ওয়াস্তাগ ফিরিল্লাহা মিনল উজুবি। অর্থাৎ আমল কর এবং অহংকার হতে আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা কর।


সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা বাংলাদেশে আগমন :


বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায়, শেখ শাহাবুদ্দীনের অনেক ভক্ত-অনুসারী বাংলাদেশসহ পাক-ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। তাদের মধ্যে শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মূলতানে অবস্থান করেন এবং সেখানে ইসলাম প্রচার করেন। সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার কোন সাধক প্রথম বাংলাদেশে আগমন করেন? এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলা যায়, প্রথম আগমনকারী সাধকের নাম শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী। তিনি সরাসরি শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য বলে বর্ণিত হয়ে থাকে। তিনি মুলতান ও দিল্লির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। বাংলাদেশে তাঁর শিষ্যরা জলিলিয়া বা জালালিয়া নামে পরিচিত।



একটি বর্ণনা অনুযায়ী বঙ্গ বিজয়ের পরপরই তিনি এদেশে আসেন। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকালের পর তাকে দেওতলায় সমাহিত করা হয়। তাঁর জন্ম সাল জানা না গেলেও ১২১৩ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন বলে জানা যায়। এটি রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালের ঘটনা। শেখ জালালউদ্দিন তাবরেজীর পর সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা বাংলাদেশে কীভাবে বিস্তার লাভ করে তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে পঞ্চাদশ শতকের জৌনপুরের বিখ্যাত সুফী মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কর্তৃক জৌনপুরের শর্কি সুলতান ইবরাহিম শর্কির নিকট লিখিত এক চিঠিতে বাংলাদেশের কয়েকটি সুফী তরিকার নাম পাওয়া যায়। রাজা গণেশের অত্যাচার থেকে বাংলাদেশের সুফিদের রক্ষা করার জন্য এই চিঠিখানা লিখিত হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, দেবগাঁও (দেবকোটে)-এ শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর সওরজন শিষ্য সমাহিত আছেন এবং দিনাজপুর জেলায় মাহী সন্তোষেও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার কয়েকজন সুফী সাধক সমাহিত আছেন।



সকল অলি-আউলিয়া কম-বেশি আহমদী নূরের বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। তবে সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকায় এর অনেক বর্ণনা খোলাখুলিভাবে রয়েছে। এই তরিকার জ্ঞান সম্পন্ন অলি-আউলিয়ার কিছু কিছু রীতিনীতি, কাজ-কর্ম্ম শরিয়তের বা সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির গণ্ডিভুক্ত না-ও হতে পারে। এটি বেলায়েতের প্রভাব মুক্ত এবং শরিয়তের আদেশ-নিষেধ সাময়িকভাবে রহিত হওয়ার অবস্থা। এটিকে খিজিরী বেলায়েত বলে।


হযরত শেখ শিহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) স্বীয় তরিকার বিস্তারিত দর্শন বিষয়ক একাধিক কিতাব রচনা করেছেন। তন্মধ্যে ‘হেকমতে আশরাক’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ। তাঁর তরিকার বিস্তারিত মূলনীতি ও দর্শন এই কিতাবে রহিয়াছে। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে যুক্তিবাদ ও দর্শন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে আনোয়ারে এলাহীর বর্ণনা রয়েছে। এতে তাজাল্লিয়াতে রব্বানীর বিশেষ বর্ণনা রয়েছে।


এটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত :
১. নূর ও হাকিকত সম্বন্ধে আলোচনা।
২. নূর বিষয়ক শৃঙ্খলা।
৩. নূরুল আনোয়ার, আনোয়ারে কাহিরা, আনোয়ারে মুর্জারাদা সম্পর্কে আলোচনা।
৪. বরজখের প্রকার ভেদ ও নমুনা।
৫. নবুয়াত, মনামত, মা’আদ (প্রত্যাবর্তন) বিষয়ক আলোচনা।


উক্ত পাঁচ বিভাগে রমুজ ও ইশারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। নূর ও জুলমাত সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি নূর বলতে রূহ, জুলমাত বলতে শরীর এবং আনোয়ার আক্লকে বুদ্ধিবৃত্তি বলে ব্যক্ত করেছেন। আক্ল দ্বারা উকুলে আফলাক- এর দ্বারা আনোয়ারে কাহিরা এবং আনোয়ারে মুর্জারাদার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে হয়েছে। আলমে বরজখ দ্বারা আলমে আজসাম বুঝিয়েছেন। এইভাবে: জাতে এলাহি, সিফাতে আফয়াল, লজ্জত (স্বাদ), মারেফাত, হেকমতে ইলমে কালাম, দর্শন ও তাসাউস ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন।


কুরআন-হাদিসের সূক্ষ্ম রহস্যপূর্ণ আয়াত ও হাদিস শরীফের উপর প্রতিষ্ঠিত দর্শন ও তরিকা প্রচারের সময়ে ইমাম হযরত শিহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) বিভিন্ন উলামা ও মাশায়েখের বিরোধিতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সর্বশেষে ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ইরান, ইরাকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই তরিকার অনুসারী রয়েছেন।


লেখক: মৌলভি মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া শিবপুরী, আল-চিশতী, আল-কাদরী, আল ওয়াইসী; পরিচালক, বিশ্ব আশেকান মজলিশ পাক দরবার শরীফ, শিবপুর, নরসিংদী


বিবার্তা/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com