বিশ্বসভ্যতা ও মানব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে পবিত্র আশুরা। সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কারবালা প্রান্তরে ফোরাতের তীরে ৬১ হিজরির ১০ মর্হরম তারিখে সংঘটিত পৈচাশিক, মর্মন্তুদ ও বিয়োগান্ত ঘটনা পর্যন্ত বিশ্ব-ইতিহাসের নানান বাঁকে সংঘটিত হয়েছে তাৎপর্যমণ্ডিত অজস্র ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় সমসাময়িক সমাজ-সভ্যতা নতুন নতুন বার্তা পেয়েছে, বুদ্ধিমানেরা সেসব ঘটনা থেকে জীবন-ঘনিষ্ঠ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং গোটা বিশ্বলোক কোনো না কোনোভাবে একেক ঘটনা থেকে একেক ধরনের পয়গাম নিয়ে সভ্যতার উৎকর্ষ বিধানে কাজে লাগিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘঠিত ঐসব ঘটনার কোনোটি হৃদয়বিদারক, কোনোটি চমকপ্রদ আবার কোনোটি বর্বরতা, অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন।
তবে মানব ইতিহাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণা হয়েছে তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই জানা-অজানা গভীর তাৎপর্য, অনুপম শিক্ষা আর মহান ঐতিহাসিকতা রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, আশুরা দিবসে মহান আল্লাহ তাঁর নির্বাচিত দশজন নবি-রাসুলকে বিশেষ অনুগ্রহ ও উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বিধায় এ দিবসকে ‘আশুরা’ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা যায়, পরিকল্পিত বা কাকতালিয় হলেও বিশ্ব-ইতিহাসের ঘটনাসমগ্রের উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়েছে পবিত্র আশুরা তথা মর্হরম মাসের দশম তারিখে। গোটা বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম জগতের কাছে খুবই পবিত্র ও তাৎপর্যময় আশুরার বিধান এবং এ দিবসের শিক্ষা ও ঐতিহাসিকতাই এখানে তুলে ধরা হবে।
আশুরা শব্দটি আরবি আশরুন, আশারা থেকে উদ্গত; যার আভিধানিক অর্থ দশ, দশম বা দশমী। শব্দটি ছিল মূলত ‘আশানুরা’ অর্থাৎ আশুরা দিবসের মর্যাদা রক্ষার বদৌলতে আলোকজ্জ্বল জীবনের অধিকারী। ‘আশানুরা’ হতে ‘নুন’ বাদ দিয়ে শব্দটিকে ‘আশারা’ বা ‘আশুরা’-তে রূপান্তরিত করা হয়।
ভূমিতে উৎপাদিত শষ্য তথা ফল ও ফসলাদির খাজনা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সাথে সংযুক্তির কারণে এক দশমাংশকে বুঝাতে ‘উশর’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয় আবার পৃথিবীতে জীবন-যাপন করা অবস্থায়ই পরম স্বর্গের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন অতীব পূণ্যবানকে বুঝাতে ধর্মীয় পরিভাষায় ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ বলা হয়। তবে পবিত্র আশুরার ক্ষেত্রেই সমগ্র বিশ্বে এই শব্দের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়; কেননা আশুরার ঘটনা যেমন অনেক বেশি, মানবইতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্যও তেমনি অপরিসীম।
পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সকল ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে ‘আশুরা’ শব্দের প্রতি সুবিচারবশত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দশটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত, আল্লাহপাকের বাণী— ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ’ অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করবো। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদম (আ.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এই দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, হজরত নুহ (আ.)-এর সময়কালে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ংকারী মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক বিশ্ববাসী মানুষ নবি নুহের (আ.) নৌকায় আরোহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করেন।
তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তাঁর ঘটনাবহুল জন্ম, ‘খালিলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল।
চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নীল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিল সমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তাঁর প্রিয় রাসুল মুসা (আ.)-এর সাথে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই।
পঞ্চমত, নবি ইদ্রিস (আ.)-কে মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই উত্তোলন করে নেন।
ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আঁধার নবি ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ চল্লিশ বছর স্বীয় পিতা নবি ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে।
সপ্তমত, আঠারো বছর টানা কঠিন কুষ্ঠরোগ ভোগের পর নবি হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে।
অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহী হারানো নবি হজরত সোলায়মান (আ.) পুনরায় মহান সত্তার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে।
নবমত, টানা চল্লিশ দিন মৎসের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তি লাভ করেন নবি হজরত ইউনুস (আ.)।
দশমত, মহিয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাঁকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। দশজন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানবেতিহাসের আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণ হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কারবালার মর্মন্তুত বিয়োগান্ত ঘটনা; যা আহলে বাইত তথা নবি-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবি (সা.)-এর কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের শাহাদতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর একটি মর্মস্পর্শী শোকগাথা কবিতায় কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনার হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরেছেন।
তিনি ইমাম হোসাইনের ভাষায় বলেন, হে কুফাবাসী, আমাকে মুসাফির মনে করো না; আমি নিজে থেকে আসিনি, আমাকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে। আমি অতিথি হয়ে এসে অত্যাচারিত হয়েছি; আমি স্বেচ্ছায় ক্রন্দন করিনি, বরং আমাকে কাঁদানো হয়েছে। আমার খোদা তায়ালাই জানেন এ কেমন আতিথেয়তা, যেখানে বাহাত্তর জন তৃষ্ণার্ত মানুষের জন্যে পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাউজে কাউসারের সুপেয় পানি পান করা আমার নিয়তিতে ছিল; আমি তো পিপাসিত নই বরং আমাকে পিপাসার্ত বানানো হয়েছে। যে শির শুধুমাত্র খোদার দরবারে নত হয়েছিল, সেই শির আজ কারবালার ময়দানে কর্তন করা হলো; আমি তো শাহাদতের মর্যাদাই পেয়ে গেলাম, আমি তো মৃত নই বরং আমাকে তো সম্মানের জীবন দান করা হয়েছে। সুতরাং আমাকে শুধুই একজন মুসাফির ভেবো না, আমি নিজ থেকে আসিনি, আমাকে আমন্ত্রণ করেই আনা হয়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত অলিয়ে কামেল খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি তাঁর এক কবিতায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর উচ্চমর্যাদা সম্বন্ধে বলেছেন— ‘শাহ আস্ত হোসাইন, পাদশাহ আস্ত হোসাইন, দ্বীন আস্ত হোসাইন, ওয়া দ্বীনে পানাহ আস্ত হোসাইন’ অর্থাৎ হোসাইন রাজা, হোসাইন সেরা বাদশাহ, হোসাইন হলেন দ্বীন এবং দ্বীনের আশ্রয়ও হোসাইন! তিনি আরো বলেন, হোসাইন মাথা দিয়েছেন, তবুও ইয়াজিদের হাতে হাত দেননি; বস্তুতপক্ষে হোসাইন হলেন লা ইলাহার বুনিয়াদ। আর সেজন্যই ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে বলা হয়েছে— ‘সাইয়্যেদা আশবাবে আহলুল জান্নাহ’ অর্থাৎ ইমাম হোসাইন হলেন জান্নাতের সকল যুবকের সর্দার।
মর্হরম মাস মুসলিম মিল্লাতের কাছে অতীব পবিত্র ও বরকতময় মাস। কুরআনুল কারিমে যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মর্হরম তার অন্যতম। এ মাসে কোনো জুলুম বা অন্যায় আচরণ করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরকম এক সম্মানিত মাসে আশুরার অবস্থান একে নিঃসন্দেহে আরো মহিমান্বিত করেছে। আর সেজন্যই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বমানবতার কাছেই আশুরার বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে।
মদিনায় হিজরতের পর মহানবি (সা.) যখন দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরা দিবসের সম্মান করে, এ দিবসে রোজাব্রত পালন করে। তখন তিনি মুসলমানদেরকেও নির্দেশনা দেন আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করার; এমনকি রাসুল (সা.) আশুরার আগের দিন বা তার পরের দিনও রোজা পালনের আদেশ করেন। এতে করে আশুরা দিবসের ধর্মীয় গুরুত্ব অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর চাইতে মুসলমানদের কাছে অধিক বেড়ে যায়। মুসলিম শরিফের হাদিস মতে, রমজানের রোজার পরেই মর্যাদার দিক থেকে সর্বোত্তম হলো আশুরার রোজা।
বুখারি শরিফের বর্ণনা মতে, মহানবি (সা.)-কে আশুরা দিবসের রোজা আর রমজানের রোজা পালনের চাইতে অধিক আগ্রহী আর কখনো দেখা যায়নি। সহিহ মুসলিমের অপর হাদিসের ভাষ্যমতে, রাসুল (সা.)-এর প্রত্যাশা হলো— আশুরা দিবসে রোজা পালনের পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের অপরাধ মার্জনা করে দেবেন।
ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আশুরার পবিত্র দিবস। এমনকি পৃথিবীর মহাপ্রলয়ও ঘটবে এই দিবসেই; যা মহানবি (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীতে বিবৃত রয়েছে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের সাথেও জড়িয়ে আছে এই মহান দিবস। যে-কোনো মূল্যে সত্য-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং সুবিচার তথা আদল-ইনসাফের অনুপম সৌধ নির্মাণের অমোঘ শিক্ষা দেয় এই আশুরা। ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক মূল্যবোধে, সামাজিক রীতিনীতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তথা সামগ্রিক পরিমণ্ডলে সত্য, ন্যায়-নীতি-নিষ্ঠা আর সুবিচারের মানদণ্ডের উত্তীর্ণ হওয়ার শিক্ষা পাই আশুরা থেকে। মহাসত্যে বিশ্বাস স্থাপন, সর্বশক্তিমান পরম স্রষ্টার অপার মহিমায় নিজেকে সমর্পণ, তাঁর ক্ষমতার বিশালত্বে আত্মসমর্পণ, নির্ভরশীলতা ও সুদৃঢ় আস্থাজ্ঞাপন, যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন, সর্বোতভাবে খোদাতাআলার ঐশী সাহায্যের মুখাপেক্ষিতা, তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ, রহমত আর বরকতের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা এবং জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে খোদার নির্দেশাবলির সামনে মস্তকাবনত হওয়ার শিক্ষা দেয় আশুরা। আমরা যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আশুরার বিধান ও ঐতিহাসিকতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরম সত্তার যাবতীয় হুকুম-আহকামের ফরমাবরদার হওয়ার যোগ্যতায় উপনীত হতে পারি— সে তাওফিক প্রার্থনা করছি (আমিন)।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন, চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]