কবিগুরুর কাবুলিওয়ালার পাশে তালেবান একেবারেই বেমানান
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৩, ২১:০১
কবিগুরুর কাবুলিওয়ালার পাশে তালেবান একেবারেই বেমানান
শামসুল আরেফিন খান
প্রিন্ট অ-অ+

বিগত আড়াইশ’ বছরে বিশ্বের তিনটি ক্ষমতাগর্বী পরাশক্তির দর্পচূর্ণ করে গিরিসঙ্কুল আফগানিস্তানের দরিদ্র জনগণ নিজেদেরকে বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজেদের অলঙ্ঘনীয় দেশপ্রেম ও দুর্দম জাতীয়তাবাদী চেতনাকেও উচ্চমাত্রা দিতে পেরেছে। কিন্তু পারেনি শুধু ক্ষুধা ও দারিদ্র্রকে পরাজিত করতে। সেটার সুযোগ নিয়েও তাদের প্রাচীন ধর্মীয় চেতনাকে জিম্মি করে এই বীর জাতিকে অস্ত্রের ক্রীতদাস বানানো হয়েছে। তাদের ললাটে যে অনপনেয় কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে, তারই নাম তালেবান। একটি ঘৃণিত নাম। সেই দুর্নামের ভিতর হারিয়ে গেছে সদাশয় রহমত কাবুলিওয়ালা। ছোট্ট শিশু মিনির বিশ্বস্ত বন্ধু কাবুলিওয়ালা রহমত। যাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বিশ্বজয়ী কলম দিয়ে। কাবুলিওয়ালার রুক্ষ পাথরের ধুলি ধূসর মাটি বাংলার সেই মিনির আদরে আদরে সুজলা সুফলা হয়েছিল। দুশো বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে কাবুলিওয়ালার মাটি। ঘৃণা আর অসক্তিতে ভুলে গেছে প্রেমের পিপাসা। প্রেমের পথে বিজয়ের বার্তা ভুলে গেছে রহমতরা। রহমতের দেশে রহমতরা আজ অসহায় অবাঞ্ছিত। পুরোনো চেতনার বুক চিরে সেখানে ফণা তুলেছে আজ হিংস্র কৌতুকের মধ্যযুগীয় বর্বরতা। সেখানে এখন প্রাণ ক্ষণস্থায়ী। সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী। বাংলার মেয়ে মিনির আদরে আর্দ্র হয়ে একদা যে আফগানি পিতার শুষ্ক অন্তরে আপত্যপ্রেমের ফুল ফুটেছিল সেই স্নেহময় পিতার হাতে এখন চকচকে রাইফেল।


রাইফেল তাকে রুটি দেয়। অহরাত ফসলের ক্ষেতে গতর খাটিয়ে একসময় প্রিয় সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতো পিতা রহমতরা। তাদের একাংশই, দুঃসহ অনাহারকে বিদায় দিতে রাইফেলের ক্রীতদাস হয়েছে। প্রিয় স্ত্রী কন্যাকে পর্বতের গুহার মতো অন্ধকার কুঠরিতে বন্দি করেছে। অতি দরিদ্র হতদরিদ্র মিলে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার তলায় মানবেতর জীবনযাপন করে। বন্যপশুর মতো হিংস্র শীত আর চিতার আগুনের মত নির্দয় গ্রীষ্মকাল জুড়ে অনাহার অর্ধাহারে বিনিদ্র রাত কাটে গৃহহীন লক্ষ লক্ষ শিশু ও নারীপুরুষের। খরা বন্যায় উপর্যুপুরি ফসল হানি, ঋণদাতা মহাজনের নির্দয় হরণ, তাদের অনন্যোপায় করেছে। তালেবান সর্দাররা দ্বিগুন মজুরি দিয়ে তাদের দিন রাত্রিগুলো কিনে নিচ্ছে। গম, আখরোট, পেশতা ও বাদামের বদলে তারা এখন মহাজনের ক্রীতদাস হয়ে পপি ফুলের চাষ করছে। গাজা হেরোইন হাশিশের রমরমা বাণিজ্যের তারা মেহনতি দাস শ্রমিক হয়েছে। তাদের ঘামে শ্রমে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তালেবান সওদাগর ও মহাজন।


তালেবানি ক্যাপসুলে পুরে চতুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে ক্ষমতাধর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অন্ধধর্মের ত্রিশুল হিসেবে ব্যবহার করেছে।] সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। ‘কাস্তে হাতুড় আঁকা লাল দস্তরখান’ পেতে দিয়েছিল। বলেছিল পেট পুরে খাও। সন্তানকে খেতে দাও। মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে তোলো। তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নতুন জীবন পাক। আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠুক। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া বোধ হয় সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছিল আফগানিস্তানের ইসলামী জীবনবোধ ও সবুজ জাতীয় পতাকায় লাল রঙ ঢেলে দিয়ে। তাই লাল দস্তরখান ফেলে দিয়ে অশিক্ষিত আফগানরা ক্ষুধার জগতে ফিরে ধর্মকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। রাশিয়ার চেচনিয়া ও চীনের উরুগুয়ের জেদি মানুষের মত পেটে পাথর বেঁধে তারা সভ্যতা ও বিজ্ঞানকে পিঠ দেখিয়েছে। ধর্ম বড়ো না বিজ্ঞান বড়ো? সেটাই এখন নতুন ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।


বিজ্ঞানের সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গ্যালিলিও বন্দিশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হেঁটে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। লিওনার্দো দ্রুনো নির্মম কঠিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু ধর্ম চিরন্তন সূর্যটাকে পৃথিবীর উঠোনে টেনে এনে উঠবস করাতে পারেনি মৌলবাদী ধর্মান্ধরা। তবুও বিজ্ঞান হিরোশিমা নাগাসাকিতে মনুষ্যত্বের কবর খুঁড়ে দিয়েছে। সনাতন পৃথিবীর চিরন্তন শোষণযন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে দুরন্ত বেগে মঙ্গলগ্রহের দিকে যাত্রা করেছে।


১৮৪২ সালেই সম্ভবত : কার্লমার্ক্স ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রায় দিয়েছিলেন যে, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একসাথে বসবাস করতে পারবে না। তার ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে, সামন্তবাদ মরে গেলে পুঁজিবাদ আসবে। পুঁজিবাদ মরে গেলে সমাজবাদ ‘আপসে আপ’ মাথা তুলে দাড়াবে। আর এর অন্য একটি ব্যাখ্যা বলে যে, সামন্তবাদী চীনের আশ্চর্য প্রাচীর ভেঙে গুড়িয়ে দাও। এটম বোমা মেরে জাপানি সামন্তবাদকে ধুলায় মিশিয়ে দাও। সেই ধংসস্তুপের উপর পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা কর। কিন্তু তারপর? মুক্তিকামী জনগণ কতকাল ইতিহাস রেশনকার্ড হাতে নিয়ে লাইনে দাড়িয়ে থাকবে? ভৃগুর মত অনন্তকাল তপস্যা করতে থাকবে শ্রীকৃষ্ণের জন্যে? কখনও না কখনও ইতিহাসের তেজি লাল ঘোড়ায় চড়ে সমাজতন্ত্র এসে ভৃগুর তপস্যা ভাঙিয়ে নিজের গর্বিত উপস্থিতি ঘোষণা করবে। কিন্তু সেই অন্তহীন অপেক্ষায় থাকবে কতকাল শোষিত লাঞ্ছিত মানুষ? এ নিয়ে বহু তর্ক বিতর্ক হয়েছে প্লেখানভ ও লেলিনের মধ্যে।


লেনিন সেই অনিশ্চিত স্বতঃস্ফূর্তার জন্যে অপেক্ষা করতে চাননি। কারণ তাঁর সামনে ইতিহাস দাঁড়িয়েছিল কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের মহাউত্থানের এক সফল দৃষ্টান্ত হাতে নিয়ে। জনগণের সেই ঘুমন্ত গিরির অগ্নি লাভার মতো সুপ্ত শক্তির কথাই মহান কার্ল মার্ক্সও বলেছিলেন। সেই শক্তির প্রখম উত্থান ঘটিয়েছিলেন ফরাসী বিপ্লবের মহানায়ক ম্যাক্সমিলিয়েন রোবসপিয়ের। শ্রমজীবী শুদ্র ক্রীতদাসদের ঘুম ভাঙিয়ে তিনি রাজা ষোড়শ লুইকে সস্ত্রীক গিলোটিনে চড়িয়ে নির্মূল করেছিলেন। কিন্তু শুদ্রের উত্থান দমন করতে মহাপ্রভু কৃষ্ণ এসে মহাভারতের মহা রণে অর্জুণের সারথী হলেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে কিঞ্চিত মিথ্যায় কলঙ্কিত করে বিজয় পাইয়ে দিলেন। ধর্মপুত্র ক্ষণকাল নরক দর্শন করে সশরীরে স্বর্গারোহন করলেন। একইভাবে মহাপ্রভু রামের বেশে মর্তে অবতীর্ণ হলেন। দৈব দোসর হুনুমানকে পাঠিয়ে মহাশক্তিধর শূদ্র রাজা দশানন রাবনের সোনার লঙ্কা পুড়িয়ে দিলেন। একই মন্ত্রে কায়েমী স্বার্থের দানবীয় শক্তি ভগবান ‘জিসাসের’ দোসর বিশপের কৃপায় ফরাসী বিপ্লবের মহানায়ক ম্যাক্সমিলিয়েন ও তার বিপ্লবী সিপাহসালারকে শূলে চড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করেছিল। এমনটাই হয়েছে চিরকাল। পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্পৃশ্য শূদ্র যখনই রণভেরি বাজিয়েছে তখনই মানবদেহ নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নেমে এসেছেন মর্ত্যে ব্রাহ্মণের রাজত্ব বাঁচাতে। সামন্তবাদী যুগে রাজা মানেই ছিল ব্রাহ্মণ আর প্রজা মানে শুদ্র। ক্ষত্রিয় বৈশ্য ছিল রাজার বশংবদ গোলাম।


কিন্তু কার্ল মার্ক্স-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর ভবিষ্যতবাণীর বছর সেই ১৮৪২ সালের জানুয়ারি মাসেই কবিগুরুর মানসপটে আঁকা ছোট্ট ‘খোকির’ আদরের মানব সন্তান কাবুলিওয়ালাদের মহা উত্থান ঘটেছিল। তার পায়ের কাছে ব্রিটিশসূর্য এমনভাবে নুয়ে পড়েছিল যে আর কখনও আফগানদের রুদ্র রোষ ভেদ করে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তারপরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ‘সূর্য ডোবে না’ বলে যে প্রবাদ ছিল তা প্রলাপে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ সৌর্য বীর্যের প্রতিভূ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষকে পদানত করে ছুটে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। চেয়েছিল নিকট প্রতিবেশী রাশিয়ার আগে যেয়ে খাইবার গিরিপথে, কান্দাহার, কাবুল, জাললাবাদে এমন দোর্দন্ডপ্রতাপ বসাবে যে শুধু রাশিয়াই না প্রাচ্যের কোন শক্তিই পাশ্চাত্যের অগ্রসরমান আধিপত্যকে খর্ব করতে পারবে না। ২ লক্ষ ৫২ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত আফগান ভূগর্ভে পাহাড় পর্বতের তলদেশে যে তরল সোনার খরস্রোত বয়ে চলেছে তাতে ব্রিটিশ রাজশক্তির আগে কেউ দাঁত গলাতে পারবে না।


কিন্তু অহংকারের পতন না হয়েই পারে না। ১৮৩৯ সালে বাদশাহ দোস্ত মোহাম্মদের হাত ধরে মাত্র ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা বাধায় কাবুল কান্দাহারের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই নাস্তানাবুদ হয়ে শ্বেতাঙ্গদের জন্য রত্নগর্ভ আফগানস্তানকে লুটেপুটে খাওয়ার স্বপ্ন ভয়ানক দুঃস্বপ্নে পরিণত হ’ল। বাদশা দোস্ত মোহাম্মদ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। জানুয়ারি ১৮৪২ প্রথম ইঙ্গ আফগান যুদ্ধে ২০,০০০ বলদর্পী শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধা ও তাদের পদলেহী অগুণতি বেসামরিক রাজাকার আত্মসমর্পন করে পিছু হটার সময় দুর্গম গিরিপথে কচুকাটা হ’ল। ব্রিটিশ সৌর্যের দর্প চিরদিনের মত চূর্ণ হয়ে ধুলায় মিশে গেলো। এরপর ব্রিটেন লিখলো শুধু তার ন্যাক্কারজনক সব পতনের ইতিহাস। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিনকে ছাতা মাথায় দিয়ে বারবার ক্ষমতাধর হিটলারের দরজায় এসে ধরনা দিতে হ’ল আপসের দরখাস্ত নিয়ে। তার উত্তরসূরি অহঙ্কারে উদ্ধত স্যার উইনস্টন চার্চিল মিত্রবাহিনীর শরীক হয়েও ১৯৪২ সালে দুর্ধর্ষ জাপানের এক ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে সিঙ্গাপুরের ন্যাক্কারজনক পতন ঠেকাতে পারলেন না। একশত বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো। কোনো জাতির মনোবল একবার ভেঙে গেলে তা আর ফিরে আসে না। ব্রিটিশ সিংহের কেশর কামিয়ে দিয়ে হৃদয়বান রহমত কাবুলিওয়ালার উত্তর পুরুষ দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী বীর আফগনরা এভাবে শুধু ভারতবাসী না বাঙালি জাতিরও স্যালুট পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।


কিন্তু কবিগুরুর মানসপুত্র রহমতের স্বজাতি সেই কাবুলিওয়ালা আর পরবর্তীকালে ধর্মের অন্ধ সওদাগর মোল্লা ওমরের তৈরি পুঁজিবাদের অন্ধদানব তালেবানকে এক দাঁড়ি দিয়ে একই পাল্লায় মাপা যাবে না। তার আগে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, রক্তচোষা নারীবিদ্বেষী তালেবানকে সম্যক চিনতে সুস্মিতা বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ’ বইটা একবার পড়ে নিতে হবে। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। তিনি এক কাবুলিওয়ালার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে আফগানিস্তানে চলে যান। আফগানিস্তানে তিনি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিবেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতিতে পড়েন। আফগানদের খাদ্যাভাস, পোশাক-আশাক, ভাষা সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। লেখিকার মতে আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যেখানে নারীদের মাত্র তিনটি পরিচয় শয্যাসঙ্গিনী, রাঁধুনি, আর সন্তান উৎপাদন মেশিন।


তার মতো আর একজন ভিকটিম কাকলির কাহিনীও খুবই কষ্টদায়ক। কাকলিও সুস্মিতার মতো বিয়ে করে ভারত থেকে আফগানিস্থানে বসবাস করতে এসেছিল। কিন্তু এসে দেখে স্বামীর আরেক স্ত্রী আছে। তাকে দেখে প্রথমে শাশুড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু শোয়ার ঘর তো একটিই। এক ঘরে সতীনের সঙ্গে রাত্রিবাস, কী বর্বর কী নিষ্ঠুর। ভদ্রসমাজ এটি চিন্তা করতে পারে? সুস্মিতা যখন আফগানিস্তানে গিয়েছিলো, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে বিধ্বস্ত সমগ্র আফগানিস্তান তখন যেন এক ভীত সন্ত্রস্ত শ্মশান ভূমি। তারই মধ্যে তালেবানদের দেশে প্রবেশ। পবিত্র কোরানের দোহাই দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য তালিবানি অত্যাচার। এই সবের মধ্যে দিয়েই এক বাঙালি হিন্দু মেয়ের (ওদের ভাষায় কাফের) জীবন যুদ্ধ। একমাত্র কাছের ভালোবাসার মানুষ স্বামীর বউকে ফেলে পলায়ন, বিপৎসংকুল যুদ্ধবাজ তালেবানের মুঠোর মধ্যে লড়াই করে বাঙালি বধূর স্বদেশে প্রত্যাগমন। এই মোটামুটি এই গল্পের বিষয়বস্তু। ভুল করেও ভাববেন না যে এই গল্পের মধ্যে স্থান পেয়েছে প্রতিকূল পরিবেশে একটি মেয়ের অসহায়তা। এইখানেই এই গল্পের মাহাত্ম্য। শ্বশুরবাড়ির নিত্য অত্যাচারে বিক্ষত এক নারীর প্রতিটি কথায় প্রকাশ পেয়েছে এক বিদ্রোহী মনন। অত্যাচার, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে এক নারী, তার এক হাতে সবরকম চেষ্টার দায়িত্ব, নিজের পালিত কন্যাকে নিয়ে স্বদেশ ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের পন্থা , অন্য হাতে তৎকালীন আফগানিস্তানবাসী প্রত্যেক মহিলার মধ্যে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর মহান চেষ্টা।


তালেবানপন্থিরা ইভান রিডলির ইনদি হ্যান্ড অফ তালেবান বইটা নিয়ে খুব মাতামাতি করেন। কারণ ঐ বইয়ে তালেবানের হাতে বন্দি হওয়া এক নারী তালেবানের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের উচিত এই বইটাও অবশ্যই পড়া। এই বইয়ে তালেবানের নৃশংসতা ও বর্বরতা তুলে ধরা হয়েছে। নামাজ না পড়লে মেরে ফেলতে হবে। দাড়ি না রাখলে হাত কেটে ফেলতে হবে। নারীরা পড়ালেখা করতে পারবে না। এমনকি নারীরা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায় থাকলেও পুরুষ ডাক্তারকে দেখাতে পারবে না। এমন হাজারো ফতোয়া চাপিয়ে দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছিলো। লেখিকার মতে আফগানিস্তানে মানুষের জীবনের চেয়ে গাধার মূল্য ছিল বেশি। কারণ গাধায় চড়ে অন্তত আফগানরা অনেক কাজ করতে পারে। লেখিকার মেডিকেল সাইন্স নিয়ে মোটামুটি ভালো ধারণা ছিলো। তিনি দেখেছেন সেখানে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসার কারণে কত মানুষ মারা যাচ্ছে। সেখানের মানুষরা স্টেথিসকোপকে বলে দূরবীন। জন্ডিস হোক, কলেরা হোক অথবা অন্য কিছু, সব রোগের জন্যই ডাক্তাররা দেন একই ঔষধ।


লেখিকা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্বরতার কথাও উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েতরা কোনো দাড়িওয়ালা দেখলেই তাকে মুজাহিদ সন্দেহ করে ফেলছে। দেশের যুবকদের ধরে নিয়ে জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দিচ্ছে। এছাড়া ভারতের বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় দাঙ্গা, ভারতে মুসলিম হওয়ার জন্য বাসা ভাড়া না দেওয়া এসবের প্রতিও লেখিকা তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। লেখিকার মতে সমাজে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অবশ্যই আছে। কিন্তু ধর্মের নামে মৌলবাদ, হানাহানি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নারীদের প্রতি অত্যাচারের বিরোধিতা তিনি অবশ্যই করবেন।


লেখিকার স্বামী তার সাথে ভালো ব্যবহারই করতেন। কিন্তু তার স্বামী তাকে ছেড়ে হিন্দুস্তানে পালিয়ে গেলেন। যার পর তিনি হয়ে যান শ্বশুরবাড়িতে বন্দি। তার দেবররা তার গায়ে হাত তুলতে শুরু করে। তালেবানদের ফতোয়া নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। লেখিকার প্রশ্ন তাহলে তার মতো যেসব নারীর পুরুষসঙ্গী নেই তারা কি তবে না খেয়ে মরবে? তাদের খাবারের ব্যবস্থা তো তালেবানরা করে দিচ্ছে না। লেখিকা দুই দুই বার বাড়ি থেকে পালিয়ে হিন্দুস্তানে ফিরতে চেয়েছেন। অবাক করা ব্যাপার তিনি পাকিস্তান দূতাবাসে যতটুকু সহায়তা পেয়েছেন ততটুকু ভারতীয় দূতাবাসে পাননি। বরং ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা তাকে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার কুপ্রস্তাব দেয়। অবশেষে লেখিকা অনেক কষ্টের পর ভারতে ফিরতে সক্ষম হন।


১৯৯৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি কলকাতায় ফেরেন। আবার ফিরে যান আফগানিস্তানে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তাঁর বাড়িতে হামলা চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এ সময় স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে বেঁধে রেখে সুস্মিতাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে খুন করে জঙ্গিরা। স্থানীয় একটি স্কুলের আবর্জনার স্তূপে লাশ ফেলে যায় তারা। কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ বই নিয়ে তৈরি হয়েছে হিন্দি সিনেমা ‘ঊংপধঢ়ব ভৎড়স ঞধষরনধহ’২০০৩ সালে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেন মনীষা কৈরালা।


‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’


কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ-এর সাথে পরিচয় ঘটার পর মিনির সুহৃদ সেই হৃদয়বান পিতা কাবুলিওয়ালা রহমতকে খুঁজে বেড়ানো পণ্ডশ্রম হবে। এখন যাদের পাওয়া যাবে তারা হৃদয়হীন তালেবান। তাদের জন্ম ইতিহাস কারও অজানা থাকার কথা না। তারা যে নির্মম, তারা যে নৃশংস বর্বর, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে স্থানকালপাত্র ভেদে নৃশংসতা ও বর্বরতা ভিন্ন ভিন্ন নাম পেয়েছে। তালেবানদের বর্বরতার সাথে বিপ্লবী নৃশংসতাকে এক করা যাবে না। যেমন তরুণ রুশ বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বলশেভিকরা তাদের হাতে বন্দি চার সুন্দরী কন্যা ও এক অসুস্থ পুত্র এবং তাদের মাসহ রাশিয়ার জার নিকোলাসকে হত্যা করলো। সেই বিপ্লবী হত্যাকাণ্ডকে প্রতিবিপ্লবী নৃশংসতার সাথে এক করে দেখা যাবে না। সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট প্রতিবিপ্লবীদের হাতে ১৫ আগস্ট ৭৫-বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে অভিন্ন নাম দেওয়া যাবে না। এমনকি জানুয়ারি, ১৮৪২, আফগান জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের হাতে দখলদার লুটেরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলায়নকামী ২০ হাজার সৈন্যের কচুকাটা হওয়ার নৃশংস ঘটনাকেও এক পাল্লায় মাপা যাবে না। ধর্মের নামে শরিয়া আইনের ভোতা অস্ত্র দিয়ে তালেবান গোষ্ঠী যে বর্বরতার দৃষ্টান্ত রাখছে তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘কাবুলি ওয়ালার বাঙালি বৌ, সেই বর্বরতার যে মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছে, বাস্তবতা তার চাইতেও নিষ্ঠুর। তার চাইতেও নির্মম। এটা জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দেশপ্রেমকে গুড়িয়ে দিয়ে একটি বীর জাতিকে প্রতিবন্ধী কালা বোবা বানিয়ে তাদের সম্পদ লুটে নিয়ে নিঃস্ব করে ফেলার এক নির্মম ষড়যন্ত্র। লুটেরা ব্রিটিশের অভিসন্ধি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের কাছে পরাভব মেনেছিল। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও ভাতকাপড়ের আশ্বাস দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া জেঁকে বসেছিল। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত। বিপ্লবী মুজাহিদ, মাওবাদী ও শিয়া মুসলমানদের গেরিলা যুদ্ধ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। তবুও সোভিয়েতরা সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ১০০ টা কূপ থেকে বিপুল তেল পাচার করতে যেয়ে ধরা খেয়েছিল চিরশত্রু মার্কিনিদের হাতে। মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামী চেতনার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রতিবিপ্লবী কৌশলে তালেবানি শক্তির উদয় ও বিকাশ ঘটিয়েছিল ইঙ্গমার্কিন পরাশক্তি। কিন্তু তালেবানদের ২০ বছর যাবত পর্যাপ্ত দুধকলা খাইয়েও দখলদার পরাশক্তি আফগানিস্তানের ভূগর্ভে অনাদিকাল নিদ্রিত অফুরন্ত সম্পদে হাত দিতে পারেনি। এই সত্যই প্রমাণ করে যে, বর্বর তালেবানের আড়ালে জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আফগানরাও বিরাজমান রয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিন জরিপে আফগান ভূগর্ভে অন্যূন ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৭৪০ পাউন্ড বাজার মূল্যের প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই গুপ্তধনের প্রকৃত মূল্য যে কত শত ট্রিলিয়ণ ডলার হবে তা কেউ কল্পনাই করতে পারে না। হাতের নাগালে পাওয়া যায় সোনার যে মজুদ, তারই মূল্য হবে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। একমাত্র তাই দিয়ে অনুর্বর আফগানস্তানের ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের জীবন সোনা দিয়ে মুড়ে দেয়া যায়। কিন্তু সেই দরদী বন্ধু কৈ?


আফগান ভূখণ্ডে সুপ্ত সম্পদের মধ্যে আরও রয়েছে বিপুল পরিমাণ লোহা, তামা, কোবাল্ট ও লিথিয়াম। তরল গরল সোনা গ্যাস ও তেল তো আছেই। আফগানিস্তানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিথিয়াম ভাণ্ডার। লিথিয়াম ছাড়া ব্যাটারি হবে না। আর ব্যাটারির পর্যাপ্ত উৎপাদন না হলে অতিমূল্যের তেল দিয়ে উৎপন্ন পারমানবিক বিদ্যুৎ একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। সব সভ্যতার আলোই নিভে যাবে। পুঁজিবাদ ধনবাদও দেউলিয়া হয়ে যাবে সামন্তবাদের মত। সমাজতন্ত্রের বাতি জ্বলাও অনিশ্চিত হবে। সব আফগান তালেবান না। মহান একাত্তরে যেমন পূর্ব বাংলার সব মুসলমান রাজাকার ছিল না। সব বাঙালিও মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। এই বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদী আফগান দেশপ্রেমিকদের বাঁচিয়ে রাখা সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি হয়ে পড়েছে। একই কারণে অন্ধ মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধ তালেবানদের বাঁচতে দেওয়াও মানবতার জন্য নিরাপদ হবে না। তালেবান বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের জন্যেই অভিশাপ।


লেখক: শামসুল আরেফিন খান, সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, অন্যদেশ, নিউ ইয়র্ক।


বিবার্তা/এনএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com