কে হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী রানিংমেট?
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৮
কে হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী রানিংমেট?
বাণী ইয়াসমিন হাসি
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭৫ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি-ক্লাস পার্টি। আমি তার নামের আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনও বদলাতে পারিনি, রাতারাতি সব সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের সুযোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে, তাহলে দলকে কবজা করে ওরা আরও লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এমনকি শত্রুপক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্র, এমনকি আওয়ামী লীগের চরিত্র ও নীতি পাল্টে ফেলতে পারে। যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সে জন্য আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না।'


না, 'বিস্মৃতির অন্ধকারে' বঙ্গবন্ধুকে যেতে হয়নি; হবেও না। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যুগুলোতে হাত দিয়ে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর সেসব বক্তৃতায় তিনি প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে ভূমিস্বত্ব পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের কতগুলো অচল ব্যবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।


নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল ঘোষণা করা হবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে। বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ সমীকরণে এবারের নির্বাচনের হিসেবটা বেশ জটিল। প্রস্তুতি হিসেবে ঘর গোছানোর কাজে হাত দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ বছরের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। তার আগেই সব জেলা-উপজেলার সম্মেলন শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলটি।


আমরা গণমাধ্যমে প্রায়ই কমিটি গঠন নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ, বাণিজ্য, হট্টগোল, মারামারি, গোলাগুলির খবর পড়ি। যদিও ফিল্টারিং এর কারণে সব খবর গণমাধ্যমে আসে না।


নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে চরম হট্টগোল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও ভাঙচুর। এটি ১৯ অক্টোবরের খবরের শিরোনাম। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পরপরই পদ বঞ্চিত বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মী ও তাদের অনুসারীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই বিশৃঙ্খলা, চরম হট্টগোল ও চেয়ার ছোড়াছুড়ি এবং ভাঙচুর করেছে। এতে বহু নেতাকর্মী আহত হয়।


সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব কাউন্সিল অধিবেশনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আগামী তিন বছরের জন্য খালিয়াজুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এডভোকেট অজিত বরন সরকার ও সাধারন সম্পাদক হিসেবে সাদেকুর রহমান সাদেকের নাম ঘোষণা করার পর পরই পদবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মী ও তাদের অনুসারীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে বিশৃঙ্খলা, চরম হট্টগোল, চেয়ার ছুড়াছুড়ি ও ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পুলিশ পাহারায় মঞ্চ ত্যাগ করে। অনেক চেষ্টার পর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।


এই সম্মেলনের ভিডিওটি দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। খুব উৎসবমুখর পরিবেশে সম্মেলন চলছিল সেক্রেটারির নাম ঘোষণার পর একজন দাঁড়িয়ে বলছেন, আমি আমি আমি। সমাবেশস্থলের কেউই সেক্রেটারিকে চেনে না তাই তিনি নিজে দাড়িঁয়ে বুক থাবড়ে নিজেকে পরিচিত করছেন! মুহূর্তের মধ্যেই ভাঙচুর শুরু হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় নেতাদের জান হাতে নিয়ে দৌড়াতেও দেখলাম। ভিডিওটি দেখে খারাপ লেগেছে। সেই খারাপ লাগা থেকেই ঘটনার সবিস্তারে জানার চেষ্টা করলাম।


দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে একজন আমলার পছন্দের লোকজনকে নিয়ে কমিটি ঘোষণা করায় এই বিপত্তি। যিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল নিয়ে এলাকায় যান এবং রাষ্ট্রের টাকায় নিজের নির্বাচনী প্রচারণা চালান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্বোধন নিজে করেন। স্থানীয় প্রশাসনকে বাধ্য করেন তাকে প্রটোকল দিতে। শুধু তাই নয় প্রটোকলে সামান্য ঘাটতি হওয়ায় এক ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয় জেলা প্রশাসককে স্ট্যান্ডরিলিজ করান। এমনই তার ক্ষমতার দাপট!


এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব: স্বাস্থ্য সচিব অবরুদ্ধ, এসি ল্যান্ড পুকুরে। ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির একটি খবরের শিরোনাম। এবার ঘটনার গভীরে যাওয়া যাক। তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের বাড়ি একই গ্রামে। গ্রামের নাম চানপুর। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার এই জনপদে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ নিয়ে তাদের মধ্যে চলছিলো দ্বন্দ্ব। এরই জেরে ঘটে তুলকালাম ঘটনা। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে যায় র‍্যাব। অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ সেই সময়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্লিনিকের রাস্তা করা নিয়ে স্থানীয়রা ভোগান্তির শিকার হওয়ায় তাকে (স্বাস্থ্যসচিব) জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল। তখন স্বাস্থ্যসচিব তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। এতে তারা ক্ষুব্ধ হন। যাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যসচিবের গণ্ডগোল হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করলেই এই ঘটনা এড়ানো যেত।'


মূলত আমলা তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়েই সেদিনের প্রতিটি গণমাধ্যমে জায়গা করে নেন। আমি এখনকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বলি কর্পোরেট লীগ। একদল আমলা এবং ব্যবসায়ী পুরো সংগঠনকে কব্জা করছে। প্রকৃত রাজনীতিবিদরা কোনঠাসা।


সুদিনের পাখিরা উড়াল দেবেই। একটা সংকট এলে সুবিধাভোগীরা কেউই থাকবে না। ঘুরেফিরে সেই পরীক্ষিতরাই মাঠে থাকবেন। ওয়ান ইলেভেন অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। চাপের কাছে বশ্যতা বা নতি স্বীকার যেমন দেখেছি। তেমনি কারো কারো ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তাও দেখেছি। বিএনপি জামাতের আগুন-সন্ত্রাসের সময় অনেকেই গর্তে ঢুকে গিয়েছিল। আবার কেউ কেউ বুক চিতিয়ে প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিল।


চারদিকে বাণিজ্যের মহোৎসব চলছে। বেশিরভাগ নেতা যাদের সাথে সংগঠনের জেলা পর্যায়ের অনেকের যোগাযোগ আছে তাদের অধিকাংশই মনোনয়ন এবং পদ বাণিজ্যের সাথে সরাসরি জড়িত।


সাজসাজ রবে অনেক জেলা এবং উপজেলায় কাউন্সিল হচ্ছে। প্রথম অধিবেশনের পর মন্ত্রী এমপির বাসায় বসে কমিটি সাইন হয়। এরপর সম্মেলনস্থলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন কমিটি ঘোষণা হচ্ছে তখন কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা ধাওয়ার শিকার হচ্ছেন, কোথাওবা আবার চেয়ার ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করে যে মহান দায়িত্বটা দিয়েছেন, সেটা ঠিকমতন পালন করুন। কমিটি বাণিজ্য বন্ধ করুন। মন্ত্রী এমপির পকেট থেকে বের হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী দিয়ে কমিটি করুন।


টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে নেতাদের মধ্যে আত্মঅহমিকা ভর করেছে, সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একজন সত্যিকারের নেতা দরকার, যিনি দলকে সংগঠিত করবেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করবেন না। যে-কোনো সংকটে জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন। এক্ষেত্রে সৈয়দ আশরাফের একজন যোগ্য উত্তরসূরিই বেটার চয়েজ হতে পারে। যিনি কমিটি বাণিজ্য করবেন না, সংগঠনকে বিক্রি করবেন না।


এই ২৪ ডিসেম্বরের কাউন্সিলে মনোনীত নেতৃত্বই বলে দেবে দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কোন পথে হাঁটবে? যে রাজনৈতিক দলের হাত ধরে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম সেই দলের ভাগ্যের সাথে দেশের ভাগ্যও জড়িয়ে থাকে বৈকি। আগামী নির্বাচন এবং সামনের দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলার জন্য সৎ, সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীই নয়, গোটা দেশ চেয়ে আছে, কে হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী রানিংমেট?


লেখক: বাণী ইয়াসমিন হাসি,
সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট ও
পরিচালক, জাগরণ টিভি।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com