শিরোনাম
অমর কবিতাঃ পটভূমি ও শিকল ভাঙার ডাক......
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২০, ২১:৫২
অমর কবিতাঃ পটভূমি ও শিকল ভাঙার ডাক......
মোঃ আলিফ হাসান অভি
প্রিন্ট অ-অ+

৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন, সংগ্রামের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক '৭ মার্চের ভাষণ'টি দিয়েছিলেন। ১০৯৫টি বজ্রকঠিন শব্দে তৈরি ১৯ মিনিটের এ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শিকল ভেঙে বেড়িয়ে আসার আহ্বান জানান।


১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাঞ্জাবী এবং পাঞ্জাবী সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দেশের শাসনক্ষমতায় অপাঞ্জাবীদের, বিশেষত বাঙালিদের দেখতে ইচ্ছুক ছিল না। যেকোনো উপায়ে নিজেদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করেন। একইসাথে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শোষণ-নিপিড়ন ৭০-এর নির্বাচনের পর আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।


এমন সন্ধিক্ষণে ৩-জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রেসকোর্সে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সংবিধান রূপায়িত করার প্রতিজ্ঞা করেন।


১২-জানুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক, ১৭-জানুয়ারি লারকানায় ইয়াহিয়া-পীরজাদা-হামিদ-ভুট্টো বৈঠক এবং ২৭-২৯-জানুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে ভুট্টোর বৈঠকের মাধ্যমে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যথাসম্ভব বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার প্রয়াস চালায়। এক পর্যায়ে ভুট্টো ৬-দফাতে পরিবর্তন এনে পাকিস্তানে একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করে পিপিপি’র সাথে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বললে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন।


১-মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচনার লক্ষ্যে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের ঢাকার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরো কয়েকটি দলের যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ঢাকাতে জোরাল বিক্ষোভ হয় এবং বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন।


২-মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত হরতাল পালন করার জন্য নির্দেশ দেন সাথে ৭ মার্চ দুপুর ২টায় রেসকোর্স ময়দানে এক গণসমাবেশের ডাক দেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকায় শাসকগোষ্ঠীর জারি করা কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ করতে থাকে। ২- মার্চ বিভিন্ন স্থানের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকায় ২৩ জন এবং চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হন।


৩-মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভা ও গণমিছিলে বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করে বলেন, ‘হয়তো ইহাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেয়া হইতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলিয়া যাইতেছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।’


বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘বাংলার ভাইয়েরা আমার- আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি- বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দিবেন। আর যদি কেউই না থাকে, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে- যে কোনো মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে হইবে।’


পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার দিনকে দিন সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল সমাবেশে পুলিশের গুলিতে ৪-মার্চ চট্টগ্রামে ১৩৮ ও খুলনায় ৬ এবং ৫-মার্চ টঙ্গীতে ৪ জন নিহত হয়। ৬-মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদী, রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে ১ জন ও খুলনায় পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৮ জন নিহত হয়।


এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থায়ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় লক্ষ লক্ষ জনতা একত্রিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন ও আশা-আকাক্ষা এবং তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবচিত্র একসূত্রে গেঁথে আত্যন্তিক হিম্মতের সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যার মধ্যে নিহিত ছিল বাঙালির সাপেক্ষতা পরিত্রাণের ডাক। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও এর পুর্বাপর উপাখ্যান কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কাব্যিক নিপুণতায় অত্যান্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-


শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,


রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে


অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷


তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,


হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার


সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?


গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর - কবিতা খানি:


"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ,


এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "৷


বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির সকল দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন ইতিহাস তুলে ধরেন, বাঙালিকে দেখিয়েছেন পাকিস্তানি শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্ন। যে স্বপ্নে পৌঁছার জন্য নিম্নবর্গীয় থেকে শুরু করে উচ্চবর্গীয় সকল মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ৭ মার্চের ভাষণের ক্রমিকতায় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।


বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটির বিশালতা চিন্তন করে মার্কিন ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিহিত করেন 'পয়েট অব পলিটিক্স' বা 'রাজনীতির কবি' হিসেবে। ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে 'বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল' হিশেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ''মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার” - এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।


বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির রাখাল রাজাই ছিলেন না, ছিলেন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ ঐতিহাসিক ভাষণসমূহ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সকল মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে।


লেখক: মোঃ আলিফ হাসান অভি, ক্রীড়া সম্পাদক, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com