টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব: তোপের মুখে পোস্ট সরাল ভারত
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৬:৪০
টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব: তোপের মুখে পোস্ট সরাল ভারত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের বহুল পরিচিত একটি পণ্য ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’। টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে নামটি জড়িয়ে আছে এই শাড়িটির। সম্প্রতি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। ভারত দাবি করেছে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ তাদের পণ্য।


এ নিয়ে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ বৃহস্পতিবার একটি পোস্টও দেয়া হয়। পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উল্লেখ করা হয়। পোস্টে বলা হয়, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বহিঃপ্রকাশ। তবে ফেসবুকে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এমন দাবি সম্বলিত পোস্ট নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। অনেকেই এর সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এই পোস্ট সরিয়ে নিয়েছে ভারত।


ওই ফেসবুক পোস্টের নিচে হাজারো বাংলাদেশি প্রতিবাদ জানান। সবারই একটিই প্রশ্ন ছিল, টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের হয়? ভারত কীভাবে এ দাবি করে? শেষ পর্যন্ত তবে বিতর্কের জেরে পোস্টটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রবিবার থেকে এ-সংক্রান্ত পোস্টটি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে দেখা যাচ্ছে না।


ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, ‘‌টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন। ’


কিন্তু এই বিতর্কের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল আরো একমাস আগে। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।


ভারতের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রির তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ এর জন্য আবেদন করেছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে।


টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তিস্থল


বিভিন্ন গবেষণা এবং এই শিল্পের আদি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্তদের মতে, এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের এমন বাইশ-তেইশটি গ্রামের নাম। একসঙ্গে এগুলোকে বাইশগ্রাম বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিল তাঁতিদের। যাদের পদবি ছিল ‘বসাক’।


ওই তাঁতিদের বংশধর হরিপদ বসাক জানিয়েছেন, জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায়।


হরিপদ বসাক জানান, ১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতি বসবাস করতেন। সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীর পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়। এসব গ্রামের মানুষরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।


২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতিদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিন।


গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান পর্বে তো বটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।


নলশোধা গ্রামের উদাহরণ টেনে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতার পর পুরো গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে তাঁত থাকলেও ২০১৪ সালে সরেজমিন তারা দেখতে পান মাত্র ২২টি পরিবার এই পেশায় যুক্ত আছে।


পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন নিলয় কুমার বসাক। তিনিও ওই তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উত্তর প্রজন্ম।


নিলয় বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে। তাদের হাত ধরে নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ পরিচিতি লাভ করে।


বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও ভারতের জিআইর তালিকায় টাঙ্গাইল শাড়ির উপস্থিতির কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।


জাতিসংঘ শুভেচ্ছাদূত ও ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ ধারণার প্রবক্তা বিবি রাসেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এটি এক উদ্ভট ও ভিত্তিহীন দাবি। এটি একেবারে বর্তমান বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ।


বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের দাবি কোনোভাবেই ভারত করতে পারে না। কারণ, ভৌগোলিকভাবে টাঙ্গাইল কোনোকালেই পশ্চিমবঙ্গের ছিল না। তারা অন্য নামে তাদের শাড়ির জিআই স্বীকৃতি দিতে পারে, কিন্তু সেটির সঙ্গে টাঙ্গাইল নাম থাকলে কোনোভাবে যৌক্তিক হবে না।


বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি নিয়ে ভারত যা করেছে, তা মেনে নেয়ার সুযোগ নেই।


টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ভারতে পেটেন্ট রাইট করেছে। তারা এটি কীভাবে করেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের জানা নেই। তবে আমরা এটি নিয়ে আজ জরুরিভাবে মন্ত্রণালয়ে বসেছি। আমরা বৈঠক করেছি। টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের থাকার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেয়ার, আমরা খুব দ্রুত সে ব্যবস্থা নিচ্ছি।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com