বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারতের, সমালোচনার ঝড়
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:৩৯
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারতের, সমালোচনার ঝড়
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার তাঁতিদের হাতে বোনা শাড়ি জেলার নামেই নামকরণ হয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতিদের শাড়িগুলোকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ হিসেবে সবাই এক নামে চেনে। হঠাৎই টাঙ্গাইল শাড়ি হয়ে গেল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পণ্য, যা স্বীকৃতিও পেয়ে গেছে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে। সম্প্রতি এর ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই স্বত্ব) নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার।


বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভারতের সরকারের মিনিস্ট্রি অব কালচারের অফিশিয়াল ফেসবুক পোস্টে জানানো হয়, টাঙ্গাইল শাড়ি যার উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গে।


এরপর থেকেই আলোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের জিআই স্বত্ব ভারত পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশিরা।


ফেসবুক পোস্টটিতে লেখা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত টাঙ্গাইল শাড়ি একটি ঐতিহ্যগত হাতে বোনা সেরা শিল্পকর্ম। এর সূক্ষ্ম গঠন, স্পন্দনশীল রং এবং জটিল জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।


প্রতিটি টাঙ্গাইল শাড়িই দক্ষ কারুকার্যের প্রমাণ, নির্বিঘ্নে ঐতিহ্য এবং কমনীয়তাকে একত্রিত করে।


এই পোস্টটি ফেসবুকে সৃষ্টি করে বিতর্কের। নেটিজেনরা কমেন্টের মাধ্যমে এর বিরোধিতা জানায়। পোস্টটি শেয়ার করে অনেকেই ভারতের মন্ত্রণালয়কে ক্ষমা প্রার্থনা করেও পোস্ট দিতে বলে।


পোস্টের কমেন্টে অনেকেই লেখেন, টাঙ্গাইল যে বাংলাদেশে অবস্থিত সেটি মনে হয় ভারত ভুলে গিয়েছে।


গত মাসে সুন্দরবনের মধুর পাশাপাশি আরও চারটি সম্পদের জিআই স্বত্ব পেয়েছে ভারত। এরমধ্যে রয়েছে- গরদ, কড়িয়াল, টাঙ্গাইল শাড়ি এবং উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির সুগন্ধি কালোনুনিয়া চাল।


টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


তিনি লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের তাঁত শাড়ি আইটেম তিনটি- নদীয়ার টাঙ্গাইল, পূর্ব বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের কড়িয়াল ও গরদ নিবন্ধিত হয়েছে এবং জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।


মমতা আরও লেখেন, আমি কারিগরদের তাদের দক্ষতা ও কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানাই। আমরা তাদের জন্য গর্বিত। তাদের প্রতি আমাদের অভিনন্দন!!


ভারত থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব পাওয়ার খবরে বাংলাদেশের সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর নিজের ফেসবুক একাউন্টে শুক্রবার (২ জানুয়ারি) লিখেছেন, টাঙ্গাইলে শাড়ি পশ্চিমবাংলার শাড়ি হয় কী করে!


প্যারিস প্রবাসী চিত্রশিল্পী জান্নাতুল নাঈম প্রীতি লিখেছেন, তেইশ ঘণ্টা আগে ভারতের কালচারাল মিনিস্ট্রি তাদের অফিশিয়াল পেজে ঘোষণা করেছে, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব বা আঞ্চলিক নির্দেশক স্বত্ব এখন ভারতের। এর আগে জামদানিরও অর্ধেক দাবিও তারাই নিয়েছে। এখন এককভাবে টাঙ্গাইল নামের অঞ্চল থাকবে বাংলাদেশে এবং পরিচিত হবে ভারতীয় শাড়ি হিসেবে! …অস্ট্রেলিয়ার এক ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নিবাস লেখা ছিলো ভারত, এই জিনিস দেখে আমার ভাই হতভম্ব হয়ে গেছিলো। লেখা বেঙ্গল টাইগার, কিন্তু লোকেশন লেখা ভারত। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কারণ, অধিকার ছেড়ে দিলে, অন্যেরা এভাবে নিয়েই যায়। যেমন আগের কালে ময়ূর সিংহাসন নিয়ে গেছিলো সুলতান মাহমুদ। শুধু সময় বদলেছে, দখলদারিত্ব বহাল আছে। ...বাংলাদেশের ২১-২২টা পণ্যের কেবল জিআই স্বত্ব আছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত আরও অনেককিছুই এখনো দাবি করা বাকি। অথচ সেসব দাবি করার কেউ কি আছে? আপনার দিক থেকে প্রতিবাদ নাই, দাবিদাওয়া নাই, আপনি সবসময় মাথা নিচু করে রাখবেন, আপনার এলাকার জিনিস নিয়ে গিয়ে আরেকজন নিজের এলাকার দাবি করবে না তো কী করবে?


স্বত্ব পাওয়ার ঘটনায় পোশাক সংশ্লিষ্ট অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পোশাক ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন সাইফুর রহমান।


তিনি বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল এই নামে ভারত শাড়িগুলো মূলত তৈরি হয়, পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার ফুলিয়া দুটো জায়গা পূর্ব বর্ধমান এবং নদীয়া থেকে।


সাইফুর রহমান জানালেন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের পাওয়ার ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না বাংলাদেশের তাঁত বোর্ডের। তিনি বলেন, “এটা নিয়ে আমি তাঁত বোর্ডের সাথে কথা বলতে গেলে আমার কাছ থেকে বিষয়টা তারা প্রথম জানতে পারে। কেন আবেদন করেনি টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য, এই প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছিলেন যে তাদের লোকবল কম, তাদের হাতে সময় ছিল না, সেজন্য তারা আবেদন করেননি। তাদের ফাইল পড়ে আছে।


হাল ফ্যাশনের সম্পাদক সাইফুর রহমান আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, এটা আসলে আমাদের চরম ব্যর্থতা। আমাদের চরম ঔদাসীন্যের একটা উদাহরণ। ঠিক একইভাবে জামদানি জিআইটাও আমাদের হাতছাড়া হতে বসেছিল। তখন রুবি গজনবী বেঁচে ছিলেন, তিনি লড়াইটা না করলে হয়তো সত্যি সত্যিই জামদানির জিআই আমরা পেতাম না।


সাইফুর রহমান যোগ করেন, এখন টাঙ্গাইল শাড়ি নামেই আমরা জিআই পেতে পারি এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগ নিয়ে আবেদন করতে হবে। ইতিমধ্যে তাঁত বোর্ড অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। আমি চেষ্টা করেছি আমার কাছে যত তথ্য-উপাত্ত আছে তাদের দিয়ে সাহায্য করতে। এখন দেখা যাক তারা কী করে। তবে শুধু টাঙ্গাইল শাড়ি নয় বরং সিরাজগঞ্জ এবং মিরপুর বেনারসির জিআই নেওয়া উচিত এবং যত দ্রুত সম্ভব এই আবেদন গুলো করা উচিত।


ভারতের গণমাধ্যমগুলোতেও স্বীকার করছে শুধু টাঙ্গাইল শাড়ি নয়, কড়িয়াল সিল্ক শাড়িও তৈরি হয় বাংলাদেশে।


যেমন কলকাতা ভিত্তিক সংবাদ প্রতিদিনে বলা হয়, …কড়িয়াল সিল্ক শাড়ি মুর্শিদাবাদের মির্জাপুরেই শুধু রয়েছে। যা বিশ্ববিখ্যাত। তবে এই শাড়ি তৈরি করার শিল্পী ক্রমশই কমে আসছে। বাংলাদেশও এই শাড়ি তৈরি করে। টাঙ্গাইল ও গরদ শাড়িরও সুনাম রয়েছে বাংলা ছাড়িয়ে ভিন রাজ্যেও। এখন বিশ্ববাংলার বিভিন্ন স্টলেও রাখা হচ্ছে এইসব দামি শাড়ি। বিদেশেও যা সমাদৃত।


সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নেটিজেনরা তো বটেই অনেক গবেষকও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়, সে দাবি জানিয়েছেন।


১৯ শতকে মসলিনশিল্পীদের একাংশ কাপড়ের ঘাটতি ও অনুকূল জলবায়ুর সন্ধানে টাঙ্গাইলে যান। সেখানে গিয়ে নতুন ধরনের কাপড় বুনতে শুরু করেন। ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশি পণ্যের প্রচারকালে এ তাঁত শিল্পের প্রসার বেড়ে যায়। ১৯২৩-২৪ সালের দিকে নকশা করা কাপড় তৈরি শুরু হয়। এরপর তাঁতে বোনা শাড়ি তৈরি শুরু হয়। দেশবিদেশে পরিচিতি পেতে শুরু করে টাঙ্গাইলের শিল্পীদের তৈরি কাপড়।


১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু তাঁতি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। সেখানে তারা নতুন করে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি শুরু করেন। তবে এর নাম পাল্টে যায়নি। এখন সেই টাঙ্গাইল শাড়িই নিজেদের উদ্ভুত শাড়ি হিসেবে দাবি করছে পশ্চিমবঙ্গ।


উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতাভিত্তিক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হ্যান্ডলুম উইভারস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের একটি আবেদনের জবাবে ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেশন ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত হয় বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি। ওই আবেদন পরবর্তীতে নিবন্ধিত করে দেওয়া হয় এবং বলা হয়, এই দাবি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০৩০ পর্যন্ত বৈধ থাকবে।


জিআই হচ্ছে কোনো সামগ্রী ব্যবহার করার বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নির্দিষ্ট সামগ্রিক ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস (যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর) অনুসারে নির্ধারণ করা হয়। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্রিক নিদিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট বিশেষত্ব নিশ্চিত করে।


আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com