আঁখির মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা: তদন্ত রিপোর্ট
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১৯:৫৭
আঁখির মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা: তদন্ত রিপোর্ট
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

সেন্ট্রাল হাসপাতালের পাশাপাশি তিনজন চিকিৎসককে আঁখির মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে আঁখির স্বামী ইয়াকুবকেও দায়ী করা হয়েছে তদন্ত রিপোর্টে।


তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে হাসপাতালের অবকাঠামো, জনবল, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো অসামঞ্জস্য রয়েছে কি না, তা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে।


গত ২ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে হাবিবা স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু দায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল এড়াতে পারে না। কারণ, বিএমডিসির নিবন্ধন নবায়ন না থাকার পরেও চিকিৎসকদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।


পরিষ্কারভাবে বলা হয়, প্রয়াত মাহাবুবা রহমান আঁখির চিকিৎসাজনিত ত্রুটির ক্ষেত্রে ডা. সংযুক্তা সাহার অনৈতিক কর্মকাণ্ড দায়ী। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণামূলক ভিডিওর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রোগী ও তার অভিভাবককে স্বাভাবিক প্রসবের পক্ষে অতিরঞ্জিতভাবে আকৃষ্ট করেছেন।


এদিকে, উপজেলার নিবন্ধিত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অগ্রাহ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও দীর্ঘায়িত প্রসূতি রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াই দীর্ঘ পথ সাধারণ গাড়িতে নিয়ে আসার জন্য আঁখির মৃত্যুতে তার স্বামী ইয়াকুব আলীকেও দায়ী করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি মনে করে তিনি সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত দেখাতেন না। রোগীর দেরিতে প্রসবের কারণে সিজার লাগতে পারে, তিতাস উপজেলার নিবন্ধিত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ না মেনে স্বাভাবিক প্রসব করাতে দৃঢ় থেকেছেন।


স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন।


ইয়াকুব আলী সুমন তার স্ত্রী মাহাবুবা রহমান আঁখি গর্ভধারণের পর থেকেই ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার (গাইনি) কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। ৯ জুন আঁখির প্রসব বেদনা শুরু হয়। সেই রাতেই ডেলিভারির জন্য ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ডা. সংযুক্তা সাহার বদলে ওই নারীর ডেলিভারি করান অন্যরা।


এসময় ডাক্তাররা ওই প্রসূতির পেট কাটতে গিয়ে মূত্রনালি ও মলদ্বার কেটে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান অবস্থায় সিজার করে বাচ্চা বের করা হয়। এতে বাচ্চার হার্টবিট কমে গেলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নবজাতককে মৃত ঘোষণা করে।


এ ঘটনায় ১৪ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন ইয়াকুব আলী।


মামলার আসামিরা হলেন- সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডা. মুনা সাহা (২৮), ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা (৩৮), অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমির, ডা. এহসান, ডা. মিলি ও সেন্ট্রাল হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজসহ আরও অজ্ঞাত ৫-৬ জন। এর মধ্যে বুধবার এজাহারনামীয় দুই আসামি ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।


তদন্তের ভিত্তিতে ইয়াকুব আলীর স্ত্রী আঁখি ও সন্তানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেদিন রাতের ঘটনার বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল আদালতকে বলেন, গত ৯ জুন মাহাবুবা রহমান আঁখির প্রসব বেদনা শুরু হয়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় তিনি (সংযুক্তা সাহা) হাসপাতালে আছেন কি না। জমির আঁখির স্বামীকে জানান ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন এবং তাদের দ্রুত আসতে বলেন। পরে ইয়াকুব আলী তার স্ত্রীকে বাসা থেকে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার চেম্বারের সামনে পৌঁছান।


সে সময় হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মুনা সাহা ইয়াকুব আলীকে জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা লেবার ওয়ার্ডে আছেন। এই কথা বলে ডা. মুনা সাহা মাহাবুবা রহমানকে লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে যান। সেসময় তাদের পেছনে পেছনে বাদীও লেবার ওয়ার্ডের সামনে যান। এর কিছুক্ষণ পর একজন নার্স লেবার ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। নার্সের এমন কথা শুনে, ইয়াকুব আলী ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি বাবদ ক্যাশ কাউন্টারে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে মানি রিসিট লেবার ওয়ার্ডের নার্সের কাছে জমা দেন।


তিনি জানান, এর কিছুক্ষণ পর ডা. শাহজাদী গাহিনী ওয়ার্ডে এলে তার কাছে ইয়াকুব আলী নিজের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান। কিন্তু ইয়াকুবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলেন ডা. শাহজাদী।


এরপর রাত ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ইয়াকুবের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কোনো খবর না পেয়ে একপর্যায়ে জোরপূর্বক লেবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন কয়েকজন নার্স মিলে তার স্ত্রীকে দ্রুত গতিতে হাঁটাচলা করাচ্ছেন। এসময় ইয়াকুব নার্সদের জিজ্ঞেস করেন ডা. সংযুক্তা সাহা কোথায়। কিন্তু নার্সরা ইয়াকুবের কথার উত্তর না দিয়ে তাকে লেবার ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন।


তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো বলেন, এরপর রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে ডা. শাহজাদী আঁখিকে লেবার ওয়ার্ড থেকে বের করে অপারেশন থিয়েটারে (ওটিতে) নিয়ে যান। এ সময় ডা. এহসান নামে আরও একজন চিকিৎসক ওটিতে প্রবেশ করেন। ওটিতে সিজারিয়ান অপারেশন শেষে ডা. শাহজাদী ইয়াকুব ও আঁখি দম্পতির নবজাতক শিশুকে (ছেলে) জীবিত অবস্থায় এনআইসিইউ নিয়ে যান। পরে রাত সাড়ে ৪টার দিকে একজন নার্স ওটি থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক তাই কিছু কাগজে তাকে সই দিতে হবে। কাগজে কেন সই দিতে হবে জানতে চাইলে নার্স ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে বাঁচাতে হলে এই কাগজে সই করতে হবে। অন্যথায় ইয়াকুবের স্ত্রী আঁখি ও তার নবজাতকের চিকিৎসা তারা করবেন না। এই কথা শুনে নিরুপায় হয়ে স্ত্রী ও সন্তানের জীবন বাঁচাতে সেই কাগজে সই করেন ইয়াকুব আলী।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে বলেন, অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ওই রাতে আঁখির সিজারিয়ান অপারেশন কোন চিকিৎসক করেছেন তা ইয়াকুব আলীকে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ পারভেজকে মৌখিকভাবে জানান।


এরপর ইয়াকুব তার স্ত্রী ও নবজাতকের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো তথ্য না দিয়ে আঁখিকে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য বলে। ইয়াকুব সেন্ট্রাল হাসপাতালের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরে তার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করান। পরদিন অর্থাৎ ১০ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ইয়াকুবকে জানায়, তার সন্তান বিকেল ৪টার দিকে এনআইসিইউতে মারা গেছে।


এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল বলেন, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে যেকোনো একজন চিকিৎসক সেদিন রাতে আঁখির সিজার করেছিলেন। এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অফিশিয়াল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে জানা যাবে আসলে অপারেশনটি কোন চিকিৎসক করেছেন।


প্রসূতির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন জানান, গত তিন মাস ধরে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে আমার স্ত্রী নিয়মিত চেকআপ করাচ্ছিলেন। তার অধীনেই ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডেলিভারির দিন ডা. সংযুক্তা দেশেই ছিলেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গোপন করে এবং ডেলিভারি করে।


এ ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে বুধবার (১৪ জুন) রাতে ধানমন্ডি থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন ইয়াকুব আলী সুমন।


পরে ১৫ জুন ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনাকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। এ ঘটনায় তারা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু এবং মায়ের মৃত্যুঝুঁকির জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com