জঙ্গিদের অভয়ারণ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩, ২২:০৫
জঙ্গিদের অভয়ারণ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে চুক্তি করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর দীর্ঘদিন পাহাড়ে শান্তি বজায় থাকলেও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে পার্বত্য এলাকায় জন্ম হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক সংগঠনের। আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জেএসএস, ইউপিডিএফ, মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এবার পার্বত্য এলাকা নজর পড়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর।


২০১৬ সালের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর রাজধানীর আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২৭টি অপারেশন পরিচালনা করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও র‌্যাব। এসব অভিযানে ৭৩ জন জঙ্গি নিহত হয়। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে জঙ্গিরা। বিশেষত প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আবাস হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নেয় জঙ্গিগোষ্ঠী। আর এজন্য পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ওপর পিএইচডি করাসহ নানা কৌশলে পাহাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে জঙ্গিরা।


গত বছরের অক্টোবরে বান্দরবানের পাহাড়ি তিন উপজেলার দুর্গম এলাকায় চিরুনি অভিযান চালানো শুরু করে যৌথ বাহিনী। এসব অভিযানে বিগত ৬ মাসে সিটিটিসি জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৬৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। যারা জঙ্গি সংগঠন জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত পাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে।



এদিকে গত ২৩ জুন দিবাগত রাতে সপরিবারে গ্রেফতার করা হয় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে। তার স্ত্রী নাজনীনও এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে নারীদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতেন বলে জানিয়েছে সিটিটিসি।



আর মাস কয়েক পর অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ঠিক এ সময়ে পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান, হিজরতের নামে তরুণদের নিখোঁজ হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া, পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের তথ্য পাওয়ার ঘটনা ও আদালত পাড়া থেকে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে- জঙ্গিরা কি পাহাড়ে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে?


পার্বত্য অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গিদের কার্যক্রম বাড়ছে। যার কারণে অশান্ত হচ্ছে পাহাড়। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে অস্থিতিশীল কোনো পরিস্থিতি নেই বলা হলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা পাহাড়ে যাচ্ছে প্রশিক্ষণের জন্য। জঙ্গিদের দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা অতীতে ছিল, এখনো আছে। তাদের বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে সব সময় সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।


জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, জঙ্গি পাহাড়ি অঞ্চলের তৈরি করা বিষয় নয়। তারা মূলত রাষ্ট্র নিয়ে কাজ করে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। এদের বেড়ে ওঠা নির্ভরতা নির্ভর করে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতার উপর। জঙ্গিদের দিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা অতীতে ছিল, এখনো আছে।


তিনি বলেন, যারা বিশেষত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেন, তারা কখনোই জঙ্গিবাদকে নিন্দা বা তিরস্কার করেন না। তারা তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে রাখেন। যারা জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষক, তাদের প্রয়োজন এবং সহযোগিতায় জঙ্গিরা সমতলে সক্রিয় হয়।


চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে অনলাইনে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্চ মাসে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন সদস্য ও তহবিল সংগ্রহে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তৎপরতা বাড়িয়েছে। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেররিজম–২০২১’–এর বাংলাদেশ অংশে এসব কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণ পাওয়া বাংলাদেশ পুলিশের একটি ইউনিট সন্দেহভাজন জঙ্গিদের গ্রেফতারের মাধ্যমে কিছু কিছু হামলা প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়েছে।


আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে সারা দেশে তাদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশেষায়িত সংস্থা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)-সহ সরকারের অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তৎপরতাও বেড়েছে। এ নিয়ে গত ১৩ মার্চ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের বলেন, পাহাড়ে নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ এর তৎপরতা কিছুটা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।


সম্প্রতি র‌্যাব জানায়, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে। ঘরছাড়া তরুণদের অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছে। আর পার্বত্য এলাকায় জঙ্গিবাদের বিস্তারে নেপথ্যের প্রধান কারিগর সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শামিন মাহফুজ (৪৭)। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ওপর পিএইচডি করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শামিন। এর সূত্র ধরে তার নিয়মিত পাহাড়ে যাতায়াত ছিল। তিনি পাহাড়ে গিয়ে গবেষণার আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ২০১১ সালে প্রথম পাহাড় থেকে জেএমবি নেতা ইসমাইলসহ গ্রেফতার হন শামিন। ২০১২ সালে জামিন পান। ওই সময় কারাগারে জেএমবি নেতা রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর জেএমবিতে সক্রিয় হন। দ্বিতীয় দফায় ২০১৪ সালে ঢাকায় গ্রেফতার হন। সর্বশেষ গত ২৩ জুন রাতে সপরিবারে আবার গ্রেফতার হয়েছেন শামিন।


র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিবার্তাকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর ক্যাম্পে শারক্বীয়ার সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বর্তমানের পাহাড়ে তৎপর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান চলমান আছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে র‌্যাব সবসময় জিরো টলারেন্স নীতিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ বিরোধী জনমত গড়তে এবং জনসম্পৃক্ততা অর্জনেও র‌্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে।


এদিকে গত জুন মাসে সন্ত্রাস ও নাশকতা ছাড়াও জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের। মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার বিশেষ কোনও মতামত বা সুপারিশ থাকলে সেটাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখাকে জানাতে বলা হয়েছে।


চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২০ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ১৭ জন নব্য জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সদস্য। অন্য তিনজন ছিলেন পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্য।


বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ক্য সা প্রু বিবার্তাকে বলেন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে জঙ্গিদের কিভাবে নির্মূল করা যায় এ নিয়ে জেলা পরিষদে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। জঙ্গি তো জঙ্গি, তাদের ধর্ম-কর্ম কিছু নেই। তারা এখন পাহাড়ি পরিবেশকে অশান্ত করছে।


জানতে চাইলে থানচি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থোয়াই হ্লা মং মারমা বিবার্তাকে বলেন, এলাকায় জঙ্গি কার্যক্রম বাড়ছে। জঙ্গিদের কাজ বেড়ে যাওয়ার কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।


তিনি বলেন, আমরা যতটুক জেনেছি কুকি চিনের সাথে জঙ্গিদের আঁতাত হয়েছে। এমনকি টাকা-পয়সার লেনদেনও হয়েছে। জঙ্গিরা যাতে বিস্তার না ঘটাতে পারে সেজন্য আমরাও সতর্ক আছি। সরকারও ব্যবস্থা নিচ্ছে।


জঙ্গিরা সমতল ছেড়ে পাহাড়ে কেন যাচ্ছে? জানতে চাইলে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, ওখানে (পাহাড়ে) তারা প্রশিক্ষণের জন্য যায়। সেখানে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে নিরাপদ এলাকা। যেখানে তারা জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে পারে। আগে তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, চরে জায়গা খুঁজে পেতো। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসায় জঙ্গিদের তৎপরতা বিষয়টি জানা হয়ে গেছে। জঙ্গি তৎপরতা জনসমর্থন পায়নি। যার জন্য সমতলে তাদের (জঙ্গিদের) জায়গা সংকুচিত হয়েছে।


তিনি আরোও বলেন, জঙ্গিরা নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের জন্য পাহাড়ে যাওয়ার বিষয়টি সহজ। গভীর জঙ্গলে তারা ঘাটি গাড়তে পারে, ট্রেনিং নিতে পারে। এছাড়া থাকা, ঘুমানোর স্বাধীনতাও পায়। যার জন্য তারা সেখানে গেছে।


কেএনএফ এর সাথে তাদের (জঙ্গি) একটা চুক্তি আছে। কেএনএফ যেহেতু পাহাড়ে থাকে তাই তাদের তারল্য সংকটে থাকে। এরা (জঙ্গি) ওদেরকে টাকা দেয় আর তারা জায়গা দেয়, ট্রেনিং দেয়- বলেন তিনি।


বিবার্তা/সোহেল//এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com