রেকর্ড উৎপাদনেও লবণের দাম দ্বিগুণ, চামড়া সংরক্ষণে আশঙ্কা
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৩, ১৭:৩৬
রেকর্ড উৎপাদনেও লবণের দাম দ্বিগুণ, চামড়া সংরক্ষণে আশঙ্কা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। এই সময়ে চামড়া সংরক্ষণে কাঁচামাল হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন লবণের চাহিদা থাকে। কিন্তু চলতি মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের পরও লবণের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে চামড়া সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।


কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল মালিকরা কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এবার পশুর চামড়া সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।


তবে লবণ মিল মালিকরা বলছেন, কৃষক ও মধ্যস্তত্বভোগীরা লবণ মজুদ করে রেখেছেন। মিলাররাই এখন মিলে লবণের প্রাথমিক উপকরণ পাচ্ছেন না।


বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে লবণের উৎপাদন ২২ লাখ ৩৩ হাজার টন, যা গত ৬২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশে এখন লবণের মজুদ রয়েছে ১০ লাখ ৮ হাজার টন। এ বছর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ টন। গেল বছর লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮০ টন।


চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি গরু বা মহিষের চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে ৮ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত লবণের প্রয়োজন। পরিবহন, শ্রমিক মজুরী, লবণের মূল্যসহ প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে গত বছর ১৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়েছে। কিন্তু লবণ ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবারে প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে খরচ হবে ২৫০০-৩০০০ টাকা।


লবণ মিল মালিক সমিতি ও চামড়া ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এবার লবণের দাম প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে খোলা মোটা লবণ ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা বস্তায় (৭৪ কেজি) বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এর দাম ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। গত বছর ৮ থেকে ৯ টাকা কেজিতে লবণ বিক্রি হলেও এবার বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সংকট না থাকলেও লবণের বাজার এখন ঊর্ধ্বমূখী।


চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত ৭-৮ বছর ধরে চামড়া সংগ্রহকারী ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা নায্যমূল্য না পেয়ে বেশ লোকসানে রয়েছে। এরমধ্যে বর্তমানে বাড়তি দামের লবণ কিনে চামড়া সংরক্ষণ করলে তা বিক্রি করে খরচ উঠে আসবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।


বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, পরিবহন খরচ ও শ্রমিক মজুরী বৃদ্ধি এবং পূর্বের বকেয়া অর্থ ফেরত না পাওয়ায় চামড়া সংগ্রহকারীরা গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে রয়েছে ব্যবসায়ীরা। এবছর লবণের বাড়তি দাম নিয়ে আমরা আরো শঙ্কিত। চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের বিকল্প নেই। তাই লবণের দাম বাড়লে চামড়ার দামও বেড়ে যাবে। কিন্তু ট্যানারিগুলো সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে এক টাকাও বাড়তি দিবে না। তাই লবণের দাম কমানোটা জরুরি।


চাক্তাইয়ের মেসার্স লাল মিয়া সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী আসাদ আসিফ বলেন, বিসিকের হিসাবে ত্রুটি আছে। কারণ তারা এবার যে পরিমাণ লবণ উৎপাদনের দাবি করছে- সে পরিমাণ লবণ চট্টগ্রামের কোনো মিলে নেই। চাষীরাও বলছে তাদের কাছে লবণ নেই। তাহলে এত লবণ গেল কোথায়? চাষীরা কেন বেশি দামে লবণ বিক্রি করছে? বিসিক আমাদেরকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না।


বিসিক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের জরিপ ও তথ্য কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হকও বলেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ লবণের উৎপাদন হয়েছে। কাজেই লবণের সংকট তৈরি হবে না।


তাহলে লবণের দাম কেন বেড়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি এ কর্মকর্তা।


তবে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির জানান, উৎপাদন বেশি হলেই দাম সহনীয় থাকবে এটা ঠিক নয়। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে লবণ পরিশোধনের খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। এ কারণে আগের বছরের চেয়ে এ বছর লবণের দাম বেশি। সম্প্রতি তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণেও মিলগুলোতে ক্রাশিং কার্যক্রম অর্ধেকে নেমে এসেছে।


এসব সংকট দূর করা না গেলে লবণের দাম আশানুরূপ কমবে না বলেই মনে করছেন তিনি।


লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল বলেন, দেশে এখন লবণের দাম সবচেয়ে বেশি এ কথা ঠিক। লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে এ কথাও ঠিক। কিন্তু দেশে সব ধরণের পণ্যের দাম বেড়েছে। সবকিছুর দামই উর্ধ্বমূখী। সে বিবেচনায় লবণের দাম ঠিক আছে।


তিনি বলেন, আগে চীন থেকে লবণের বাই প্রোডাক্ট আসতো। সোডিয়াম সালফেট আমদানি হতো। ডলার সংকটের কারণে এবার সোডিয়াম সালফেটের আমদানি কম। যেখানে লাখ লাখ টন সোডিয়াম সালফেট আসতো এখন এর আমদানি একেবারেই নগণ্য। সোডিয়াম সালফেট খাদ্য লবণ হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। ভারত থেকেও কিছু লবণ আসতো। জাহাজ ভাড়া ও ডলারের সংকট থাকায় এখন সেই অর্থে লবণ আসছে না। ফলে দেশীয় লবণের চাহিদা সব যায়গায় বেড়েছে। এ কারণে লবণের দামও বেড়েছে।


আমাদের দেশে ২৪ লাখ টনের মতো লবণের চাহিদা রয়েছে। এ বছর রেকর্ড ২২ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। গত বছর দেশে ১৮ লাখ টনের কিছু বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছিল। আর আমদানি হয়েছিল দেড় লাখ টন। সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ দিয়ে ওই বছরের চাহিদা মেটানো গেছে। যেহেতু এবার ২২ দশমিক ৫ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে, তাই কোরবানিতে দেশের কোথাও লবণ সংকট হবে না। এছাড়া আগামী নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই নতুন লবণ উঠতে শুরু করবে। তাই লবণের কোনো সংকট হবে না।


এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, এখন লবণের মৌসুম নয়। সাগর থেকে লবণ সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তাই মিলগেটে লবণ পৌঁছে দেওয়ার গতি স্লো রয়েছে। তাই বলে লবণের সংকট রয়েছে তা নয়।


বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপমহাব্যবস্থাপক (লবণ সেল প্রধান) সরোয়ার হোসেন বলেন, লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে এ কথা সত্য নয়। দেশে সব কিছুর দাম বেড়েছে। ১৬ টাকায় এক কেজি লবণ কেনা যাবে না এমনটি তো ঠিক নয়। আর লবণ মিল মালিকরা মিথ্যা বলছেন, যাতে লবণ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। দেশে পর্যাপ্ত লবণের মজুদ রয়েছে। কোরবানিতে লবণের কোনো সংকট হবে না।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com