প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার শুধু পরিবেশকে রক্ষা করছে না বরং বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষ অবদানও রাখছে। আর রিসাইক্লিংকেই ত্বরিত সমাধান হিসেবে বিবেচনা করছে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
বর্তমানে দেশে প্লাস্টিক শিল্পের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার। এই বিশাল বাজারে বছরে প্রায় সোয়া আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার ৬৪ শতাংশই পরিবেশ দূষণ করছে। বাকি মাত্র ৩৬ শতাংশ রিসাইকেল করা হয় বলে এক সেমিনারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের উপস্থাপিত 'প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার: বিনিয়োগের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া' প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এই বিপুল প্লাস্টিকের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিক। নতুন উদ্যোক্তারা যেন এই খাতে আসে সে ব্যাপারে সরকারকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান রিসাইক্লিং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
পুরানো প্লাস্টিকের পাইপ, কাটিং প্লাস্টিক পাইপ, ওয়েস্টেজ প্লাস্টিক সামগ্রী ও খালি প্লাস্টিকের বোতল এখন আর ফেলে দেওয়ার জিনিস নয়। এসবের এখন চাহিদা এবং মূল্য রয়েছে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে পাইপ তৈরি হচ্ছে ও বোতলের গুঁড়ো বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, লালবাগসহ ৩০০ কারখানায় রিসাইক্লিং থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য। মাত্র ১০ বছরে এ ধরনের কারখানা হয়েছে প্রায় ৩০০। প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাতে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকার। শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ৩৮১ দশমিক ৩৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। যা ১ বছরে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার টন। আমাদের দেশে প্রতি বছর এক থেকে দেড় হাজার টন প্লাস্টিকের গুঁড়ো উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত প্লাস্টিকের গুঁড়ো বিদেশে রফতানি করে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।
পরিত্যক্ত প্লাস্টিকগুলো রিসাইক্লিং করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৫ হাজার কারখানা রয়েছে। আর এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের গুঁড়ো রফতানি হচ্ছে।
আগে শুধু ঘরের টুকিটাকি কাজে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে নিত্যপণ্যের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। খেলনাসামগ্রী, অফিসে ব্যবহারের জিনিসপত্র, পোশাক খাতের সরঞ্জাম, ঘরে ব্যবহারের তৈজসপত্র, গৃহনির্মাণসামগ্রী, জানালা-দরজা, চিকিৎসা উপকরণ, গাড়ি, সাইকেলের যন্ত্রাংশ, কৃষি খাতের জন্য পাইপ ও বড় চৌবাচ্চা, পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতের বিভিন্ন পণ্য, কম্পিউটারের উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের একদিকে যেমন দাম কম অন্যদিকে টেকসইও। এছাড়া প্লাস্টিকের পাত্র ভেঙে গেলে তার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় না। ভাঙা বা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পাত্র আবারও নতুন হয়ে আমাদের হাতে পৌঁছে।
বিশ্বের অব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপন্ন হলেও দেশের প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানাগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য যেমন পিইটি ফ্লেক্স, পিএসএফ (পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার), পলিয়েস্টার ইয়ার্ন এবং পলিয়েস্টার ফেব্রিক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করতে পারছে না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ লাখ ২১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হলেও এর মাত্র ৩৬ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। অন্যদিকে, পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডফিল ও উন্মুক্ত পরিবেশে ফেলা হয় বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি গবেষণা।
রিসাইক্লারদের দাবি, দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় অর্ধেক রিসাইক্লিং করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাবে তাদের কার্যক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বিবার্তাকে বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর জিনিস। এগুলো যদি সমন্বিতভাবে রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে একটা সমাধান করা যায় সত্যি উপকার হবে। অনেকের আয়ের উৎসও তৈরি হবে। কাজটি এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারকেই প্রথম ভূমিকা রাখতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, সরকারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তৃতীয় জাতীয় পলিসির লক্ষ্য হলো উন্মুক্ত জমি, নদী, নালা, খাল এবং সমভূমিতে বর্জ্য নিষ্পত্তি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা। বর্জ্যের বাধ্যতামূলক পৃথকীকরণের মাধ্যমে বর্জ্য পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যগুলির জন্য একটি বাজার তৈরি করা।
অন্যদিকে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক পরিত্যক্ত টায়ার আর ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে উৎপাদন হচ্ছে গ্রিন ওয়েল যা ফার্নেস ওয়েল, ডিজেল, পেট্রোল ও ব্ল্যাক কার্বন। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব চাইনিজ প্রযুক্তি নির্ভর একটি প্লান্ট। চায়নায় পড়াশোনা শেষে পরিত্যক্ত কাঁচামালকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে কাজ করতে থাকে তরুণ উদ্যোক্তা নেহাল। একসময় বাইরের প্রযুক্তি ও দেশীয় গবেষকদের সাহায্যে গড়ে তোলেন টি এইচ টি রিসাইকেল প্লান্ট, যার মূল কাজ প্লাস্টিক থেকে গ্রিন ওয়েল উৎপাদন করা।
ফোনে বিবার্তার সাথে কথা হয় এই উদ্যোক্তার। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আগে ফার্নেস ওয়েল ছিল, এখন এটা কিন্তু গ্রিন ওয়েল হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছ। রিজেনেবল প্রাইজে আমরা এটা পাচ্ছি যা আমাদের ডিজেলের চাহিদা কিছুটা হলেও কমাবে।
দশটন একটি প্লান্ট প্রতিদিন ১০০০ লিটার তেল উৎপাদন করে। যেখানে কাঁচামাল ও উৎপাদন বাবদ খরচ লিটার প্রতি ৭০ টাকা। মাসে মোট উৎপাদন হয় ৩০০০০ লিটার। মোট খরচ হয় ২১ লাখ টাকা। বর্তমানে দেশে দুইটি অটোমেটেড পাইরোলাইসিস প্লান্ট ছাড়াও ছোট ও মাঝারি আকারের প্রায় ১০৮টি প্লান্ট গড়ে উঠেছে।
প্লাস্টিক থেকে জ্বালানী উৎপাদনে ঝুঁকছে বিশ্ব। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে এই প্লান্ট। এরমধ্যে চায়নায় ১৪০০টি , ভারতে ৬০০ টি, বাংলাদেশে ১১০টি।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, আয় বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্র বর্জ্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বর্ধিত বর্জ্য নিষ্পত্তি করতে না পারলে দেশের সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিবে। সেজন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে গৃহস্থলী বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে সারাদেশে বর্জ্য নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য এক যুগান্তকারী অর্জন।
গত ১৫ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট’ এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণ বিষয়ক এক সভায় সভাপতিত্বকালে এ কথা বলেন তিনি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ঢাকার আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে এই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট নির্মাণ করা হবে। ৩০০০ টন মিক্সড বর্জ্য থেকে প্রতিদিন ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ প্রকল্প আগামী ২৪ মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ২৫ বছর পর্যন্ত ক্রয় করবে।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধারণা ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি জানান, টেকসই উন্নয়নের জন্য এ ধরনের প্রকল্পের কোন বিকল্প নেই। এ প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন আমাদের বর্জ্য নিষ্পত্তি হবে তেমনি বিদ্যুতের মত অতি প্রয়োজনীয় শক্তিও আমরা উৎপাদন করতে পারব, যা আমাদের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার কিছুটা সংকুলান হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এক প্রশ্নের জবাবে বিবার্তাকে বলেন, টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এছাড়াও পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা এবং একই সময়ে প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি ৩০ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যেও কাজ করা হচ্ছে।
সম্ভাবনা ছড়িয়ে দিতে যুক্ত হচ্ছে বড় বড় কোম্পানি
নতুন উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বড় কোম্পানিরাও প্লাস্টিক পণ্য রিসাইক্লিংয়ে যুক্ত আছে৷ ২০১২ সাল থেকে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে যুক্ত আছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তারা বাতিল প্লাস্টিকের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে। কোম্পানির বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বিবার্তাকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে আমদানি করা রেজিন ও অন্যান্য প্লাস্টিক দানা থেকে উন্নত মানের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০ হাজার টন পুরোনো ও বাতিল প্লাস্টিক সংগ্রহ করে আরএফএল, যা দিয়ে ২৭ হাজার টন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়।’
তিনি জানান, রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে যে প্লাস্টিক কাঁচামাল পান, তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে গেলে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লাগত। বলা যায়, পুরনো বা বাতিল প্লাস্টিক সামগ্রীর পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ওই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।
বিবার্তা/ সানজিদা/ রোমেল /মাসুম
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]