একই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা!
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ১০:৩৪
একই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

আগামী ৫ মে, শুক্রবার আমার ৪ টি সরকারি চাকরির পরীক্ষা। এরমধ্যে ৩ টি ওইদিন সকালে একই সময়ে আর ১ টি একইদিন বিকালে। ফলে আমি ওইদিন সকালে ১ টি আর বিকালে ১টি মিলে মোট দুইটি পরীক্ষায় বসতে পারবো। অথচ আমি এই ৪টি পরীক্ষার জন্য ফি জমা দিয়ে আবেদন করেছি। আমার মতো এমন বিড়ম্বনার শিকার হাজারো চাকরিপ্রার্থী। তারাও একই দিনে ও একই সময়ে একাধিক পরীক্ষা হওয়ায় অনেক চাকরির পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এ বিষয়টি সুরাহা করার যেন কেউ নেই? ফলে দিনের পর দিন এই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে চাকরি পেছনে শিক্ষার্থীরা।


কথাগুলো বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা হাসিবুর রহমান। তিনি ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী হিসেবে ২০১৯ সালে স্নাতক ও ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি সরকারি চাকরি প্রত্যাশায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো দিয়ে যাচ্ছেন।


এই চাকরিপ্রার্থী বলেন, বর্তমানে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় তুমুল প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় চাকরিপ্রার্থীদের যেখানে মানসিক চাপ বেড়েছে, সেখানে তাদের চাকরির পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ফলে তারা এই ঘটনায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ সেশনের বাংলা বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী রেজাউল করিম সুমন বিবার্তাকে বলেন, ৫ মে সকালে আমার স্থানীয় সরকার অধিদফতরে, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পরীক্ষা রয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষাগুলো একই সময়ে হওয়ায় আমি মাত্র ১ টি পরীক্ষায় বসতে পারবো। এ নিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। আবেদন ফি দিয়েও চাকরির পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না! অবিলম্বে এই বিষয়ে সমন্বয়ের জোর দাবি জানাই।


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিমন বিবার্তাকে বলেন, প্রতিবছর যে হারে শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই চাকরির পেছনে ছুটছেন। ফলে এই সেক্টরে জট লেগে গেছে। বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। কখনও কখনও একটি পদের বিপরীতে ১০/২০ হাজার শিক্ষার্থীও আবেদন করছেন। কী করবেন শিক্ষার্থীরা? তাদের তো জব দরকার। এদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরণের পড়াশোনা করানো হয়, পাস করার পরে সেই পড়া তেমন একটা কাজে আসে না। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের চাকরির জন্য নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হয়। এ কারণে চাকরি পেতে সময়ও লাগছে। আবার অনেকে বছরের পর বছর চেষ্টা করে একটি চাকরি জোগাতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ছেন। এতোকিছুর পরেও শুধুমাত্র সমন্বয়ের অভাবে চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে না পারা খুবই বেদনার এবং অমানবিক।


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া হাবিব উল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, এমনিতে ঢাকার বাহিরের শিক্ষার্থীদের রাজধানীতে এসে পরীক্ষা দিতে আর্থিক ব্যয়সহ নানা ধরণের ভোগান্তিও সহ্য করতে হয়। ফলে এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে অনেকে যাচাই-বাছাই করে চাকরির আবেদন করে থাকেন। কিন্তু এরপরেও যদি একই সময়ে একাধিক পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে তারা খুব কম পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে কম পরীক্ষা দিয়ে সফল হওয়ার হারও একেবারে নগণ্য।


এই শিক্ষার্থী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। ভেবেছি, সীমিত সময়ের মধ্যে কোনো একটি ভালো জব করে পরিবারের হাল ধরব। কিন্তু বিধিবাম! ২০২০ সালে কোভিডের কারণে বন্ধ হয়ে গেল চাকরির পরীক্ষাসহ অনেক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এরপর দেশে কোভিডের হার কমলে পুনরায় চাকরির পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু আগের মতো চাকরির পরীক্ষা আর হয় না। আর হলেও অনেক সময় একইদিন ও একই সময়ে একাধিক পরীক্ষা। এদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।নানা অনিশ্চয়তার মাঝেও আমাদের চাকরির বয়সসীমা ঠিকই চলে যাচ্ছে। ফলে চাকরিপ্রত্যাশীরা হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। শুধু তাই নয়, অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে এলাকায় যেতে হীনমন্যতায় ভোগেন। এর কারণ হলো, পেশার কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলবেন? এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকে আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন। দিনকে দিন এ সংখ্যাও বাড়ছে।


তথ্য বিশ্লেষণে করে একই দিন ও একই সময়ে একাধিক সরকারি চাকরির পরীক্ষা হওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়। ৫ মে (শুক্রবার) সকালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) স্কুল ২ ও স্কুল এর লিখিত পরীক্ষা,ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের ডাটা এন্ট্রি/ কন্ট্রোল অপারেটর পরীক্ষা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন পদের পরীক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের বিভিন্ন পদের পরীক্ষা,প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমসিকিউ পরীক্ষাসহ ৭ টি পরীক্ষা রয়েছে। এদিকে আগামী ১২ মে (শুক্রবার) ১০ টির অধিক চাকরির পরীক্ষা রয়েছে বলে জানিয়েছে চাকরিপ্রার্থীরা। এরমধ্যে অধিকাংশ আবার একই সময়ে।


এদিকে একই তারিখে ও একই সময়ে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়াসহ নানা দাবি জানিয়ে আসছে 'চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি'। সংগঠনটির দাবি, চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ বছর এবং অবসরে বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হোক। তাদের অন্য দাাবিগুলো হলো- চাকরির আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে (১ম শ্রেণীতে ২০০ টাকা, ২য় শ্রেণীতে ১৫০ টাকা, ৩য় শ্রেণীতে ১০০ টাকা, ৪র্থ শ্রেণীতে ৫০ টাকা) প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকির উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া একই তারিখে ও একই সময়ে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।



একই দিন ও একই সময়ে একাধিক পরীক্ষার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে 'চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির' আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ বিবার্তাকে বলেন, একজন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থী টাকা দিয়ে চাকরিতে আবেদনের পরেও একই দিন, একই সময়ে পরীক্ষা হওয়ার কারণে অনেক পরীক্ষা দিতে পারে না। এটা কতটা কষ্টের, কতটা হতাশার সেটা কেবল ভুক্তভোগী নিজেই উপলব্ধি করতে পারে। আমার মনে হয় একই দিন ও একই সময়ে চাকরির একাধিক পরীক্ষা নেয়া মানে চাকরিপ্রার্থীদের আবেগ নিয়ে খেলা করা। তবে এই খেলা বন্ধ করা উচিত।



তিনি বলেন, আমরা যেহেতু শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করি সেহেতু এই বিষয়েও আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। তবে তারা এই বিষয়ে পরিষ্কার করে আমাদের কিছু বলতে পারেননি। তারা বলেছেন,স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এসব পরীক্ষা নিয়ে থাকে। ফলে এখানে সমন্বয় করা যাচ্ছে না। তবে আমি যেটা মনে করি বিশেষ করে সরকারি চাকরিগুলোকে একটা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা উচিত। তাহলে চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের এই বিড়ম্বনা লাঘব হবে।


চাকরিপ্রার্থীদের এই সংগঠনটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রাসেল বিবার্তাকে বলেন, টাকা দিয়ে আবেদন করেও কেন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে না? এটা তো চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চনা করা। যার মধ্য দিয়ে তারা হতাশ হয়ে যায়। আমাদের সংগঠনটি ইতোমত্যে এই দাবিসহ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা দাবিতে কাজ করছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বাস্তবায়ন করা।


তিনি বলেন, করোনাকালীন সময় ৩ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ২-২.৫ বছর হারিয়ে গেছে।দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা শেষ করতে ২৬-২৭ বছর লাগে, সেসব শিক্ষার্থীর জীবনে যখন ভয়াবহ মহামারী হানা দেয় তখন তারা চাকরিতে আবেদনের বয়স পেয়েছে মাত্র ১-২ বছর। আর যাদের বয়স ২৮ ছিল তারা কিন্তু চাকরির বয়স হারিয়েছে । ফলে ৩০এর শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার কারণে এই সকল ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জীবন, জীবিকা, সামাজিক মর্যাদা আজ হুমকির সম্মুখীন। তারা আজ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। এদিকে এই পরিস্থিতিতে একই দিন ও একই সময়ে একাধিক পরীক্ষা হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা আজ দিশেহারা! ৩৫ বয়সসীমা বাস্তবায়নসহ শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট সব দাবি মেনে নেওয়া উচিত।


একই দিন ও একই সময়ে একাধিক চাকরির পরীক্ষা থাকার বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্‌ উদ্দিন চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, এই বিষয়ে আমরাও আলোচনা করেছি। তবে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। এটাকে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনাও আমাদের আছে। আর সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের এই বিড়ম্বনার বিষয়টি আমাদেরও ভাবায়। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com