২০২৫ সালের আগে কি দেশ 'শিশুশ্রম' মুক্ত হবে?
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৩, ০০:১১
২০২৫ সালের আগে কি দেশ 'শিশুশ্রম' মুক্ত হবে?
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে ২০১০ সালে নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। সেই সময়ে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। পরে তা পিছিয়ে ২০২১ সাল করা হয়। এর মধ্যেও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ না হওয়ায় নতুন করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। বারবার সময়সীমা বৃদ্ধির পরও শিশুশ্রম মুক্ত দেশ গড়তে পারছে না সরকার।


জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রায় শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ ও ব্যবহার, শোষণ, পাচার এবং সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতনের অবসান ঘটানো এবং সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। শিশুশ্রম নির্মূল করার জন্য জাতিসংঘ কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেছে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আদৌ কি ২০২৫ সালের আগে দেশ 'শিশুশ্রম' মুক্ত হবে?


দেশের শিশুশ্রম নিরসন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ৬টি শিল্পকে ইতোমধ্যে ‘শিশুশ্রম মুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সেক্টরগুলোকে শিশুশ্রম মুক্ত করার ঘোষণা প্রক্রিয়াধীন আছে। শিশুশ্রম হ্রাস এবং নির্মূলের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। এছাড়া শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) গ্রহণ করা হয়েছে।


চার বছর ধরে মগবাজারের একটি দোকানে প্লাস্টিক পোড়ানোর কাজ করছে সাদিকুর রহমান। ১১ বছর বয়সী সাদিকুরের গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। এতো অল্প বয়সে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কেন? জানতে চাইলে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে সাদিকুর জানায়, বাসা থেকে কাজে পাঠাইছে। মা’য় বাসায় আর বাবায় কারওয়ান বাজারে কাজ করে।


পড়ালেখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাদিকুর বলেন, টু পর্যন্ত পড়ছি। এরপর আর পড়া হয় নাই। প্লাস্টিক পোড়াতে ভয় করে কি-না? জানতে চাইলে সাদিকুর বলেন, না। ওস্তাদে কাছে থাকে।


রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের সিহাব মটরসে তিন বছর ধরে কাজ করছে ১৩ বছর বয়সী মো. রিয়াদ হোসেন। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। গ্রামে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা রিয়াদ ঢাকায় এসে মটর মেকানিকের দোকানে কাজ শুরু করেছে।


জানতে চাইলে রিয়াদ বিবার্তাকে জানায়, সকাল ৯ থেকে রাত্রে ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। থাকা-খাওয়া নিজের। আর মাস শেষে ৫ হাজার টাকা মজুরি দেয় মালিক।


২০১০ সালের মার্চে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী রিয়াদ ও সাদিকুর দু'জনই 'শিশুশ্রমিক'। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যে শিশু দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ কর্মঘন্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করে, নিরাপত্তাহীন ও অস্থাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বল্প মজুরি, সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন ও শিক্ষা জীবনকে ব্যাহত করে তাহলে, উক্ত কর্মপরিবেশ শিশুর জীবনের জন ‌'ঝুঁকিপূর্ণ' এবং 'অমর্যাদাকর'। এ পরিবেশ থেকে শিশুকে উদ্ধারে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


কিন্তু রিয়াদ ও সাদিকুরের মতো লাখো শিশু প্রকাশ্যে 'অস্বাস্থ্যকর' ও 'ঝুঁকিপূর্ণ' কাজ করলেও এমন পরিবেশ থেকে তাদের উদ্ধারে যেন দায়িত্ব নেই কারো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সিগনেটরি দেশ। আর তাই জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিশুশ্রম নিরসনে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ, প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ শিশুশ্রম মুক্ত হবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন তারা।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।


শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শিল্প-কারখানা, বাণিজিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, জাহাজ ভাঙ্গা, কৃষি, পশুপালন, মৎস চাষ, গৃহকর্ম, নির্মাণকর্ম, ইটভাঙ্গা, রিকশা-ভ্যান চালনা ইত্যাদি সেক্টরে শিশুরা কাজ করে থাকে।


চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, দেশে বর্তমানে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন বা ১৭ লাখ। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন বা ১২ লাখ।


শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী এর আগে ২০০৩ সালের সমীক্ষায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন।


জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) ঢাকার সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) সাবিহা মুক্তা বিবার্তাকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে।


কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) ঢাকার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, ঢাকায় কেরাণীগঞ্জে ও লোকাল গার্মেন্টসে কিছু শিশু শ্রমিক আছে। তাও সর্ব্বোচ্চ ১৫-২০ হাজার হবে। এর বেশি না। শিশুশ্রম যাতে না থাকে সেই লক্ষ্যে আমাদের অফিসাররা নিরলসভাবে কাজ করছে।


তিনি বলেন, কর্মকর্তারা লক্ষ্য অর্জনে দিন-রাত পরিশ্রম করছে। নিয়মিত ইনসপেকশন করছে, মালিকদের নোটিশ দিচ্ছে সর্বশেষ স্টেপ হিসেবে মামলাও দিচ্ছে। শিশুশ্রম বন্ধে নিয়মিত উদ্বুদ্ধকরণ সভা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য ঝুকিপূর্ণ সেক্টর থেকে আগে শিশুশ্রম নিরসন করা। তারপর ২০২৫ সালের মধ্যে সকল সেক্টর থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা আমাদের টার্গেট। প্রধানমন্ত্রীর টার্গেটকে লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে আমরা শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করে যাচ্ছি।


এ কে এম সালাউদ্দিন বলেন, ঢাকায় আমরা অ্যাকশন প্ল্যান করেছি। সেই অ্যাকশন প্ল্যান ধরে ধরে কাজ চলছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের ওভারঅল অ্যাচিভমেন্ট ভালো। আমরা আগে যে পজিশনে ছিলাম তার চেয়ে অনেক ভালো পজিশনে আছি।


জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (শ্রম শাখা) ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বিবার্তাকে বলেন, মানুষ মারা যায় আবার জন্মও নেয়। জনসংখ্যা বাড়ছে। কম মারা যায়, বেশি জন্ম নেয়। যার কারণে আমরা একদিকে শিশুশ্রম নির্মূল করি, অন্যদিকে আবার কাজে আসে।


তিনি বলেন, লাখ লাখ শিশু শ্রমিক বারবার চলে আসছে। আমরা নিরসন করছি। গার্মেন্টস সেক্টরে অনেক কমে গেছে। কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশুশ্রম আছে। আমরা জাতিসংঘের সিগনেটরি কান্ট্রি। আশা করছি ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূল হবে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com