কাগজের দাম চড়া, আসন্ন বইমেলায় বই বিক্রিতে ভাটার আশঙ্কায় প্রকাশকরা
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৭
কাগজের দাম চড়া, আসন্ন বইমেলায় বই বিক্রিতে ভাটার আশঙ্কায় প্রকাশকরা
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও এই যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অবস্থানগত ভেদাভেদ— এই সবের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে এক টালমাটাল অবস্থায়। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ফলে সেই প্রভাবমুক্ত নয় কাগজের বাজার।


আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি বছর দেশে দফায় দফায় বেড়েছে কাগজের দাম। ফলে বেড়েছে শিক্ষা ব্যয়। এক্ষেত্রে, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বইয়ের দামও বাড়তি। ধারণা করা হচ্ছে, দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে আসন্ন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বইয়ের মূল্যের উর্ধ্বমুখী গতির কারণে পাঠকরা বই কিনতে আগ্রহ হারাবেন বলে আশঙ্কা করছেন প্রকাশকরা।


সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছর যথাসময়ে অর্থাৎ ফ্রেব্রুয়ারি মাসেই একুশে গ্রন্থমেলা বসবে। মেলা উপলক্ষে প্রকাশনীগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে গেছে নভেম্বর মাস থেকেই।


এদিকে, টনপ্রতি কাগজের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আর বইয়ের দাম বাড়ায় এবারের গ্রন্থমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ কমে যাবে বলে প্রকাশকরা চিন্তায় পড়েছেন। বাড়তি দামে কী পরিমাণ বই প্রকাশ করবেন, সেটাও ভাবছেন। কমিয়ে দিয়েছেন বইয়ের পরিমাণ ও সংখ্যা।



খুচরা বই বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সব ধরনের বইয়ের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলছে। অনেক সময় ফটোকপি করে বই বিক্রি করা হলেও কাগজের দাম বাড়ায় এখন সেটিও করা হয় না। ফলে বইয়ের বেচাবিক্রিও কমেছে।


নীলক্ষেত এলাকার একাধিক বই বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, মেডিকেল ও প্রকৌশলে ভর্তি বা বিবিএ, এমবিএ, এমবিবিএস, চাকুরিসহ সব ধরনের বইয়ের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। আগে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বই পাওয়া যেত ২৫০০-৩০০০ টাকায়। এখন তা দ্বিগুণ বেড়ে ছয় হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক ক্রেতা-বিক্রেতারা বিবাদেও জড়িয়ে পড়ছেন।


নীলক্ষেতের বই বিক্রেতা মো. কামাল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়েছে। গত ৩ মাসের ব্যবধানে মেডিকেলের বইয়ের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। যেখানে আগে দাম ছিল ৮০০০-৮৫০০ টাকা। এখন তা কিনতে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগবে। দেশে কোনো প্রকাশনী না থাকায় এসব বই সবই পাইরেসি করা।


তিনি বলেন, বিডি চৌরাশিয়ার ‘হিউম্যান এনাটামি’ বইয়ের দাম ছিল ৯০০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৫০০ টাকা। বাংলাদেশি লেখক আরিফের লেখা গাইডের দাম ছিল ১০০০ টাকা। এখন ১৫০০ টাকা। নিন্মমানের সাদা-কালো কাগজে এ বইয়ের মানও যাচ্ছেতাই। এনাটমির নিটার এর দাম ছিল ৭০০, এখন তা বেড়ে ১৪০০ টাকা।



মিরপুর থেকে বই কিনতে আসা তানভীর আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, আমার বোনের জন্য একাদশ শ্রেণীর বই কিনতে এসেছি। এখন দেখি সব বইয়ের মূল্য অনেক বেশি। কাগজের সংকট দেখিয়ে নানা অজুহাতে বইয়ের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি বইয়ের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ বা তার বেশি, তাই সব বই কিনতে পারিনি। কিছু বাদ রেখেছি পরে কিনব। বইয়ের এমন বেশি দাম আমাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে যাচ্ছে।


কাগজের ডিলারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত এক বছরে টনপ্রতি বইয়ের ছাপার কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এক বছর আগে যে 'প্রিন্টিং পেপার' এর দাম ছিলো প্রতি টন ৮০ হাজার টাকার আশেপাশে, এখন তা ১ লাখ ২০-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বই ছাপার কাগজগুলো মূলত দেশে উৎপাদিত হলেও কাগজের মিলগুলো নির্ভরশীল বিদেশি কাঁচামালের ওপর। তাই কাগজের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে।


বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির তথ্যমতে, গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে কাগজ কিনতে হচ্ছে প্রকাশকদের। ৮০ গ্রামের এক রিম অফসেট কাগজের গত বছর দাম ছিল এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৫৫০ টাকা। সেই কাগজ প্রতি রিম কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়।


বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি জানায়, বিশ্ববাজারে কাগজের দামের তুলনায় বাংলাদেশে কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ। ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়ায় ফিনিশড একটন কাগজের (৯৫ শতাংশ ব্রাইটনেস) দাম ৮০০ ডলার বা ৮১ হাজার ৬০০ টাকা (কম-বেশি হতে পারে)। চীনে একটন কাগজের দাম ৭০০ ডলার বা ৭১ হাজার ৪০০ টাকা। এই মানের চেয়ে নিম্নমানের (৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস) একটন কাগজের বাংলাদেশে দাম এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।



কাগজের দাম বাড়ায় আসন্ন বইমেলায় বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।


সাহস প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হুদা রতন বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বাড়াতে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। আমরা আগে বই মেলা উপলক্ষে ৩০-৩৫টা বই ছাপাতাম। এ বছর আমাদের এই সংখ্যা ১৫-তে নেমে এসেছে। এটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক। বইয়ের দাম কাগজের দামের রেশিও অনুযায়ী বাড়বে। শুধু তো কাগজ না, বই তৈরির সব উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। যেটা বইয়ের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।


তিনি বলেন, বইয়ের পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের এখানে তো কোনো উদ্যোগ নাই। রাষ্ট্রীয়ভাবেও নাই, ব্যক্তিগতভাবেও নাই। সেক্ষেত্রে দামের ওপর কতটুকু প্রভাব পড়বে তা জানি না, আবার উল্টাও হতে পারে। আমাদের যে চরিত্র, একই জিনিস পাশাপাশি দুইটা দোকানের একটি দোকানে দাম চাইছে ৫০০ টাকা, আরেকটাতে দাম চাইছে ১০০০ টাকা অথচ একই জিনিস। ৫০০ টাকার জিনিস কিনবে না, ১০০০ টাকা দিয়ে কিনবে। সবার ধারণা, যেহেতু বেশি দাম তাহলে ভালো। এ ধরনের একটা মাইন্ডসেট আছে আমাদের।



শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবীন আহসান বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বাড়াতে খুব কম বই প্রকাশ হবে। যেমন আমরা আগে মেলায় ২৫-৩০টা বই ছাপাতাম, এখন ১০টা বই ছাপাব সর্বোচ্চ হয়তো। এ রকম সবাই কম বই ছাপাবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে- বই ছাপানোর পরে বইয়ের দামও বাড়বে। ফলে পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।


তিনি বলেন, এখন এমন একটি খারাপ সময় যাচ্ছে সবার, সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে। সবাই বইপত্র কীভাবে কিনবে। আমরা যে বই প্রকাশ করি, এটা তো প্রয়োজনীয় না। এটা হচ্ছে সৃজনশীল। পাঠকের ইচ্ছা হলে কিনবে, না-হলে কিনবে না। বই কিনে আসলে মধ্যবিত্তরা, দাম বাড়লে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন আগ্রহ হারাবে। এ ছাড়া বইয়ের দাম বাড়লে ছাত্র-ছাত্রীরা বই কিনতে পারবে না। এর একটা বড় প্রভাব সমাজে পড়বে।


রবীন আহসান বলেন, সরকার যদি এখন প্রকাশকদের ভ্যাট, ট্যাক্স ছাড়া কাগজ দেয় তাহলে বইয়ের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। যদিও আমরা এ বিষয়ে সরকারকে আগেই জানিয়েছিলাম।


ইত্যাদি প্রকাশনীর প্রকাশক আদিত্য অন্তরের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, কাগজের দাম বাড়ায় এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় বই কম প্রকাশ হবে। শুধু কাগজের বিষয়টি সবাই জানে, কাগজের পাশাপাশি ছাপা, বাইন্ডিং সবকিছুর দাম বাড়তি। তাই আমাদের ধারণা এবার বইমেলায় কম বই বের হবে।


বইয়ের দাম ২০-২৫ শতাংশ বাড়বে মনে করেন আদিত্য অন্তর। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম ডাবল হয়ে গেছে, আমরা আসলে বইয়ের দাম তো ডাবল করতে পারব না। তাহলে পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, কিনবে না বই। পাঠকের কথা চিন্তা করে আসলে আমরা দাম কম রাখার কথা ভাবছি।


বাবুই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাদের বাবু বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বাড়ায় প্রভাব অলরেডি পড়েছে। আমরা অন্যান্য সময় যে বই বের করি, সেই বই তো এখন করছি না। এবার অনেক বই কম করছি। যে কাগজের দাম ছিল ১৯০০ থেকে ২০০০ টাকা। সে কাগজ এখন আমরা ৪৫০০ টাকা কিনছি। আপনি বুঝতে পারছেন যে ডাবলের চেয়ে বেশি। ফলে কাগজের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে।


কাদের বাবু বলেন, বইয়ের দাম আমরা খুব বেশি বাড়াচ্ছি না। আমাদের লাভ কম থাকলেও আমরা হয়তো ছাড় কম দিব। ৩০ শতাংশের জায়গায় ২০ শতাংশ ছাড় দিব। দাম বাড়ালে পাঠকদের বই কেনা প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। বই পাঠকরা কিনবে না। শুধু কাগজের দাম না, ছাপা থেকে সবকিছুর খরচ বেড়েছে। সে হিসেবে বইয়ের দাম তেমন বাড়াচ্ছি না। কারণ পাঠক এমনিতে সৃজনশীল বই কিনতে চায় না।


এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বেড়েছে এই সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের না। সমস্যাটা সারা পৃথিবীর। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, কাগজের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে মিল মালিকরা হিমশিম খাচ্ছে। মিল মালিকরা আমাদের কাগজ দিতে পারছে না। যার কারণে আমরা সময়মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যবইও দিতে পারি নাই।


আর্ন্তজাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমলে দেশেও কমবে বলে মনে করেন শহীদ সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, তাছাড়া তো কোনো উপায় নাই আমাদের। লোকাল মিলগুলো চাইলেই কি আমাদের কাগজ দিতে পারবে, তা তো আর পারবে না। ইচ্ছা করলেই তো আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারব না। যেহেতু সমস্যাটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। সারাবিশ্বের সমস্যার সাথে আমরাও একাকার হয়ে গেছি।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com