'বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল'
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০৬
'বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল'
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি'র সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালে এই মাসেই ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ লাভ করে বিজয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অকুতোভয় ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছিলেন দীর্ঘ নয় মাস।


বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি কমাণ্ডার হিসেবে জীবন বাজি রেখে পাক হায়েনার বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করেন। তিনি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন।



বাংলার এই বীর সন্তান জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিলের বিলসা গ্রামে। পিতা মো. হায়েতুল্লাহ সরদার পেশায় ছিলেন কৃষক ও মাতা মোছা. গুলেনুর বেগম ছিলেন গৃহিণী।



ছোটবেলায় পিতৃহারা আব্দুল কুদ্দুস গ্রাম থেকে উঠে এসে রাজশাহী কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাস করেছেন। ১৯৬৮-৭২ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানের সময় ছিলেন বৃহত্তর রাজশাহী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি।


বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি (১৯৭২-৭৪) রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী রাজশাহী জেলায় প্রথম গ্রেফতার করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসকে। দীর্ঘ ৫ বছর কারাভোগ করে মুক্তি পান তিনি। কারাগারে থাকা অবস্থায় রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস।


১৯৮২-৮৬ পর্যন্ত রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাজশাহী মহানগর গঠিত হলে ১৯৮৬-১৯৯০ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।


১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রথমবার সংসদ সদস্য হন। তার নির্বাচনী এলাকা ৬১, নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর)। সর্বমোট ৭ বার দলীয় মনোনয়ন পেলেও ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস। বর্তমানে তিনি নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।


সম্প্রতি বিবার্তা প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দিনগুলো নিয়ে কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি। বিবার্তা২৪ডটনেটের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে রাজশাহীতে আপনি প্রথম পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। সেই ঘটনাটি জানতে চাই।


মো. আব্দুল কুদ্দুস: ১৯৭১ সালের ১ মার্চ। আমরা রাজশাহীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিশাল মিছিলের আয়োজন করি। রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের ছাদে উঠি আমি, খুরশিদ ও সাব্বির রহমান মতিন। আমরা ৩ জন ছাদের ওপর উঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। এরপরে ফায়ার ব্রিগেড, জেলখানা, রেল স্টেশনে, বাংলাদেশ ব্যাংকে, কমিশনার অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা পুড়াইছি। ঢাকায় কিন্তু ২ তারিখে পুড়ানো হইছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হয়তো পুড়াইছে, তবে বিভাগীয় শহরে হিসেবে আমরাই প্রথম পুড়াইছি।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোন বিষয়টি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?


মো. আব্দুল কুদ্দুস: পাকিস্তানের ওইখানে এক ভূখণ্ড আর এইখানে আরেক ভূখণ্ড। মাঝখানে ভারত। ভারত আবার একটা স্বাধীন দেশ। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন উদাহরণ নাই। পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের ভাষার কোনো সম্পর্ক নাই। খাওয়া-দাওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। আমাদের পোশাক-আশাক, কালচারের সাথেও কোনো সম্পর্ক নাই। একটা মাত্র সম্পর্ক হচ্ছে আমরা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান। তো এরকম তো বিশ্বে ৫৪টি দেশ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে তো আরব ভূখন্ড। একই ভূখন্ড তো। ভাষা আরবি, আরবীয় কালচার, সব কিন্তু মুসলমান। তাও দেখেন সৌদি আরব, ইরান ইরাক, আমিরাত, কাতার, কুয়েত ইত্যাদি সবাই কিন্তু একেকটা রাষ্ট্র।


আর আমরা পূর্বে মুসলমান, পশ্চিমে মুসলমান আর তার মাঝখানে ভারত। দুইটা মিলাইয়া একটা দেশ। ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট ভাগ হওয়ার চার মাসের মাথায় ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের জন্ম। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম। যারা পাকিস্তান মুভমেন্ট করেছিল তারা বুঝতে পেরেছিল যে এসব ভুয়া। মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে এসব করা হয়েছে। তাই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের চলতে হবে। প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে মুসলিম শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লড়াই, সংগ্রাম শুরু হলো।



ছাত্রলীগ সবসময় শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠায় কাজ করতো। এই ছাত্রলীগের রাজনীতে করেই বড় হয়েছি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমার নেতা। তিনি ছিলেন অদম্য, দুর্বার ও বিদ্রোহের অগ্নিশিখা। তার বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল। দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরু‌দ্ধে তার আহ্বানে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মু‌ক্তিযু‌দ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।



বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্ব থেকেই খুব সাহসী ও আন্তরিকভাবে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, শুরুর গল্পটা জানতে চাই।


মো. আব্দুল কুদ্দুস : ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানোর গল্প শোনানোর আগে ১৯৬৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার আগের একটা ঘটনার কথা বলে নিতে চাই। আমি যে স্কুলে লেখাপড়া করতাম সেটি ছিলো তখনকার সময়ে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার সবচেয়ে ভালো স্কুল ‘কাছিকাটা স্কুল’। ১৯৬২ সালে ৪টি মহকুমাকে নিয়ে ছিলো বৃহত্তর রাজশাহী জেলা। রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর এবং নবাবগঞ্জ (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ)। মহকুমা প্রশাসক পিএ নাজির সাহেবের সাথে স্কুলের সভাপতির আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো। নাজির সাহেবের ভাই ছিলেন দিদারুল আলম আজিজ। তিনিও দক্ষিণাঞ্চলের মহকুমার কর্মকর্তা ছিলেন। তো সভাপতি তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছেন স্কুলের কিছু কাজ করানোর জন্য। তখন আমি নবম থেকে দশম শ্রেণীতে পড়ি। ওই সময়ে স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। মিটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া ছিলো কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে তারা কোনো কমেন্ট করেননি। কমিশনার সাহেবও না, ডিসি সাহেবও না।


আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন আকবর হোসেন সাহেব, তিনি বিএসসির টিচার ছিলেন। উনি আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। হঠাৎ করে দেখি যখন লাঞ্চের সময় হয়েছে, নাটোর থেকে খাওয়ার নিয়ে আসা হয়েছে। মিষ্টি, কাঁচাগোল্লা ইত্যাদি আনা হয়েছে। এসব দেখে এমএসসি নিতাই স্যারকে বললাম, স্যার সংবর্ধনা দিলাম আমরা। কমিশনার সাহেব, ডিসি, তার ড্রাইভার, তার পিএসকে নাস্তা দিচ্ছেন। ছাত্রদের দিবেন না। তিনি প্রতি উত্তরে বলেন, তোমাদের কেন দিতে হবে? সব কষ্ট করলো ছাত্ররা আর এখন ছাত্ররাই বঞ্চিত। তখন বিষয়টা আমাদের মাথায় লেগেছে।


আমরা কয়েকজন মিলে যেখানে খাবার রাখাছিলো সেখান থেকে সরিয়ে আমরাও সরে পড়েছি। খাওয়ার সময় দেখে যে খাওয়ার কিছু নাই তখন তো সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সবাই খুঁজতেছে। কে করলো, কে করলো? হেডমাস্টার সাহেব, এমএসসি স্যার বললো যে, কুদ্দুস ছাড়া কেউ এ কাজ করেনি। তখন আমাকে খোঁজে বের করে নিয়ে আসা হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এই কাজ করেছো? উত্তর দিলাম- না, আমি এই কাজ করিনি। স্যার বললেন, তাহলে কার সাহস আছে এ কাজ করে?


আমি বলি, সাহসের তো বিষয় না। আপনারাই বলতেন আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করে ক্ষমতা দখল করে রাখছে। আজকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের বন্দি করে রাখছে। আপনারাই তো তার কমিশনার, ডিসিকে ডেকে নিয়ে আসছেন। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, ছাত্রদের জন্য কিছুই রাখেন নাই। খাওয়ার আয়োজন যখন করছেন সবার জন্যই করতেন। এখন কে করেছে না করেছে আমার ওপর দায় দিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে অনেক ভয়ভীতি দেখানো হলো। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম প্রতিবাদ করতে হবে। আমি আসলে ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী। আমি কৃষকের সন্তান, গ্রামে থাকি। ১১ বছর বয়সে যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। তখন থেকেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান।


এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে আর্টসে ভর্তি হলাম। আইয়ুব খানের একটি সংগঠন ছিলো এনএসএফ (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন)। তারাই রাজনীতিতে গুণ্ডামী নিয়ে আসছে। কলেজে ভর্তি হয়ে আমরা ১১-১২ জন ছাত্রলীগে নাম লেখাই। ৯-১০ জন ছাত্র ইউনিয়নের ছিলো। তখনকার সময়ে রাজশাহী কলেজের এ ও সি ব্লকে যারা থাকতো তারাই ছাত্রলীগের কথা বলত।


তখনই আমরা জানি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন নেতা আছে। যে নেতা এই ছাত্র সংগঠনটা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা। ১৯৬৪ সালের মে মাসে কামারুজ্জান সাহেব উনাকে রাজশাহীর মাদরাসা মাঠে জনসভা করতে নিয়ে আসছেন। আমরা চিন্তা করলাম বঙ্গবন্ধুকে রাজশাহী কলেজের গেটে সংবর্ধনা দিবো। আমরা ১০-২০ জন্য গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমরা স্লোগান দিচ্ছি- ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব লও সালাম’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি। এসময়ে এনএসফের জাফর, সেন্টোর নেতৃত্বে হকিস্টিক, চেইন, ড্যাগার ইট নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে ওরা স্লোগান দিচ্ছিলো- ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আইয়ুব খান জিন্দাবাদ, মোনায়েম খান জিন্দাবাদ’। এরকম করে তাদের সাথে আমাদের সাংঘর্ষিক একটা অবস্থার তৈরি হয়।



রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের পাশে টেনিস কোর্ট আছে। টেনিস কোর্টের নিচ তো পাকাই থাকে। ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই পাকার ওপর ইট বসালো। এরপর সেই ইটের ওপর আমার মাথা রেখে আরেকটা ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করতে লাগলো। পুরো মাথা থেতলে দিয়েছে, সেই সময়ে আমার মাথা ২৯ টা সেলাই দিতে হয়েছে। মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সেই থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হই।



বিবার্তা : আপনি ভারতে ট্রেনিং নিয়ে মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। সে সম্পর্কে জানতে চাই।


মো. আব্দুল কুদ্দুস : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের পর থেকে আমরা মনে করতাম একটা সময় যুদ্ধে যেতে হবে। ওই সময়ে গেরিলা সংগঠন ছিলো- বিএলএফ। বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট। পরে ওইটা মুজিব বাহিনী বলে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা যেন ইন জেনারেলভাবে ক্যাম্পে না যায় সেজন্য আমাদের খেয়াল রাখতে হতো। ওই ক্যাম্পে সরকারের থেকে পলিটিক্যাল নিয়োগ পাই আমি। ওই সময়ে ইশ্বরদী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পযন্ত ছাত্রদের সংগঠিত করতে কাজ করেছি।


১৯৭১ সালের মার্চে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হলো ওই মাসে রাজশাহীতে কোনো ক্যাম্প করা হলো না। পরে এপ্রিল মাসে থিয়েটার রোডে কামারুজ্জামান হেনা ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, দেশের সব জায়গায় ক্যাম্প হয়েছে রাজশাহীতে হলো না কেন? ওসমানী সাহেব যখন তাজউদ্দিন সাহেবের রুমে গেলেন তখন তিনিও গেলেন। তিনি বললেন, বহরামপুর-মালদহ একটা ক্যাম্প হবে। ওই ক্যাম্পের নেতৃত্ব দেবে কুদ্দুস।



মালদাহ জেলার পদ্মার এইপাড়ে রাজশাহী ওইপাড়ে ভারত। ক্যাম্প হয়ে যাওয়ার পর ২ মাস পরপর ট্রেনিং হতো। তারপর আমি ওখানে গেলাম- গিয়ে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার সাহেবকে বললাম, দুই মাস পর পর ট্রেনিং হয় এগুলো ছেলে খেলা হচ্ছে না-কি? পরে ছেলেদেরকে বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হলো। তারপর ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সেখান থেকে ১২টা মিলিটারি গাড়ি নিয়ে আসছি। আর ১০-১২ জন নিয়ে আমি চলে গেলাম দেরাদুমে। যেখানে মুজিব বাহিনী ট্রেনিং নিত। জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে সেখানে গেরিলা ট্রেনিং হত। ট্রেনিং নিয়ে চলে গেলাম শিলিগুড়িতে তারপর সেখান থেকে কলকতায় চলে গেলাম। গেরিলা ট্রেনিংয়ের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান হত।



রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় রাখা, সংঘটিত করা, নতুন করে রিক্রোটমেন্ট করা এইসব করতাম। নানা জায়গায় বহু ছেলে আহত হলো, মারা গেলো। এইভাবে হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলতে থাকলো। এক সময় সহযোদ্ধাদের বীরত্বে স্বাধীন দেশ পেয়ে গেলাম।


বিবার্তা : স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে কীভাবে নির্মূল করা সম্ভব?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। বিএনপি মাশাল ল’জারি করে রাস্তার রাজনীতি, ভিখারীদের টেনে নিয়ে এসে দলে পদ দিয়ে দল করেছে। দল করে ক্ষমতায় কিন্তু আসে নাই। আমরাই একমাত্র দল যারা রাজনীতি করে ক্ষমতায় এসেছি। ১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে সবগুলো নির্বাচনই গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। জিয়া, এরশাদ, খালেদার সময় রাজনীতির যে ক্ষতি হয়েছে এর থেকে বের হতে পারতেছি না। আপনারা দেখছেন সাম্প্রদায়িক শক্তি কিন্তু এখনো বিলীন হয়নি। আমাদের উচিত বঙ্গবন্ধু যেটা চেষ্টা করেছিলেন সেই দিকে যাওয়া। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন।


স্বাধীনতা মানেই বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে সরকারি দল হবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, বিরোধী দলও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হওয়া উচিত। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য এটা যে, আমাদের এই দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ২৯ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলো স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। এখনও কিন্তু সেই শক্তি শেষ হয়নি। বিএনপি, জাতীয় পাটি, জামায়াত, যদিও হাইকোর্ট এদের অবৈধ ঘোষণা করছে, তারপরেও কিন্তু নির্বাচন কমিশন এখনও নিষিদ্ধ করছে না। তারা বলছে সরকার করলে পরে আমরা করবো।


কিন্তু হাইকোর্টের ওপরে তো আর সরকার না। তারা কিন্তু এখনও আছে, তাদের কমিটি আছে, ছাত্রশিবির আছে। বাংলাদেশকে যারা বিশ্বাস করে না তারা কিন্তু এখনো রাজনীতি করছে। সেখানে কেন আমরা স্ট্রেইট অ্যাকশনে যেতে পারছি না সেটা কিন্তু আমারও একটা প্রশ্ন।


আমি বলব যে, আমাদের দেশকে আরো বহু দিন, বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। আদর্শিকভাবে এক ও অভিন্ন থাকলেও আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বিরোধী দলে থাকবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরে ভুলগুলো চিহ্নিত করে দিবে। আমরা কিন্তু বিএনপির সবক, জাতীয় পার্টি-জামায়াতের তথাকথিত সবক চাই না।


বিবার্তা :ব্যক্তিজীবনে কোনো আফসোস রয়েছে কি?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : আমি কৃষকের সন্তান। গ্রামে কৃষি কাজ করে বড় হয়েছি। আমার রক্তে বইছে প্রচণ্ড রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফসল উৎপাদন করা কৃষকের কষ্ট।



আমার জীবনে কোনো আফসোস নাই। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলের সঙ্গে সেই ছোটোবেলা থেকে জড়িত। আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতাম, এখন আওয়ামী লীগ করি। কৃষকের সন্তান হয়ে এমপি হইছি, মন্ত্রী হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিছি। মুক্তিযুদ্ধে ১ বছর ৪ মাস বয়সী আমার বড় ছেলে কল্লোল মারা গেলো।



আমি নিজে জীবনে কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি তার হিসেব নাই। দল থেতে ৭ বার নমিনেশন দিয়েছে। কিছু পাই বা না পাই এই নমিনেশন পাওয়া তো একটা স্বীকৃতি। এর চেয়ে জীবনে আর বেশি কি প্রয়োজন। যদি আমি মন্ত্রী না হতাম তাহলে হয়তো শিক্ষক হতাম। রিটায়ার করতাম এই তো।


বিবার্তা : কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : আমি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ দেখতে চাই। দেখতে চাই এমন একটা সোনার বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ সুখে, শান্তিতে থাকবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু চিরদিন সবার কাছে বঙ্গবন্ধু হয়েই থাকবে। আমি এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই।


বিবার্তা/সোহেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com