সেলিম আল দীন ও বাংলা থিয়েটারের বহু যুগের প্রতীক্ষার অবসান
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:০৪
সেলিম আল দীন ও বাংলা থিয়েটারের বহু যুগের প্রতীক্ষার অবসান
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা নাটকে নতুন ধারার প্রবর্তক নাট্যকার সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মাত্র ৫৯ বছরে মৃত্যুবরণ করেন। ক্ষণজন্মা এই প্রতিভাবান নাট্যকার রেখে গেছেন তার অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টিসম্ভার। তার নাটক বাংলা থিয়েটারের বহু যুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়েছিল।


নাট্যরচনা কিংবা নাট্যবিষয়ক তৃণমূল গবেষণা তাঁর নিরীক্ষাধর্মী সৃজনশীল বৈশিষ্ট্যকে করে তুলেছে অনন্য ও অসাধারণ।


সেলিম আল দীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার এবং ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন।


১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন। তার সৃষ্টিশীলতার কিরণচ্ছটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।


সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য।


সেলিম আল দীন অনুভব করেছিলেন বাঙালি যতক্ষণ পর্যন্ত না শিল্পে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে ততক্ষণ পর্যন্ত একদিকে যেমন তার নিজস্ব পরিচয়ে সে উদ্ভাসিত হবে না— ঠিক একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিগোষ্ঠীগুলোও বাঙালিকে গ্রহণ করবে না— অন্তত শিল্পের নিজস্ব আঙ্গিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাঙালির তাবৎ জীবনাচার মন্থনকৃত একজন শ্রেষ্ঠ মনীষা হিসেবে যথার্থই বলেন— 'আমরা ঘরের হতে পারিনি পরের দুরাশায়; আর পর আমাদের গ্রহণ করে না আমরা ঘরের নই বলে।'


বাঙালির সমুদয় জীবনবোধকে বিশ্বশিল্প পরিচয়ের গগনবিস্তারি মর্মমূলে স্থাপন করতে কী অসাধারণ এ তত্ত্বকথা। বাঙালি সংস্কৃতির আদিঅন্ত লৌকিক শিল্পমন্থনে এমন শিল্পসমুন্নতি যিনি তাঁর বোধে ধারণ করবেন— তিনিই তো প্রয়াসী হবেন জাতীয় নাট্যাঙ্গিক নির্মাণে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। এরপর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হতে থাকে। একদিকে সৃজনশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন তার নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে, অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে যান সমান্তরালে।


১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে এই বিভাগকে তিনি অধিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে। শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।


ছোটবেলা থেকেই তার লেখকজীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কালো মানুষদের নিয়ে তার প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। তার প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তার নাটক প্রদর্শিত হয় মঞ্চ ও টেলিভিশনে। শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষাকে ভর করে; কিন্তু দ্রুত তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে তোলেন নিজের জগৎ। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী এবং নিচুতলার মানুষেরই ভিড় তার নাটকে। পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি, যার নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব’।


জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন।


সেলিম আল দীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার এবং ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। বর্ণময় কর্মজীবনে দেশে-বিদেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন তিনি।


২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। আজ এই মহান শিল্পস্রষ্টার জন্মদিনে তাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com