বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপকার: শেখ হাসিনা (পর্ব-৩)
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২২, ১১:২৯
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপকার: শেখ হাসিনা (পর্ব-৩)
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) মো. মফিজুল হক সরকার
প্রিন্ট অ-অ+

বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতার বঙ্গকন্যা


শ্বাশত ধারায় প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার পুঁথিগত পরিচয় দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে অন্য পথেই হাঁটতে হলো। শেখ হাসিনার পরিচয় তো তাঁর কর্মে। তবে ১৯৮১ থেকে যে শেখ হাসিনার কর্মযজ্ঞ শুরু তা নয়। মূলত ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশের আরেক জন্মের শুরু। সেই জন্মের রূপকার শেখ হাসিনা।


বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে জন্ম থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে আছেন বাংলার প্রতিটি আন্দোলনে, প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিটি প্রাপ্তির ইতিহাসে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার মতো বলতে হয়,


'দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা নারী


পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্ব, সে নহি নহি


হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে, সে নহি নহি


যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটে, সম্পদে


দুরূহ চিন্তার যদি অংশ দাও


সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতের সহায় হতে


পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।'


জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলার কতখানি, কতটা জুড়েই বা শেখ হাসিনাই এক বাংলাদেশ সেসবই উপলব্ধ সম্ভব যদি তার সম্পূর্ণ জীবনকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। দ্বিধাহীন মেনে নিতেই হবে, শেখ হাসিনা নিজেই একটি ইতিহাস— বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতিটি মুহূর্তে আশীর্বাদের মতো তিনিই একজন— ছিলেন, আছেন, থাকবেন।


বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা এর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ তিনি। টুঙ্গিপাড়ায় (বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া) ১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।


রূপসী বাংলার চোখজুড়ানো স্রোতস্বিনী এক নদী মধুমতি। বাইগার শাখা হয়ে মধুমতির পাশ কাটিয়ে বয়ে যায়। মধুমতি-বাইগার এমনই সব নদীর স্রোতে স্রোতে বয়ে আসে পলি। পলি বয়ে আনা নদীজলে সুজলা সুফলা এই বাংলা। বাংলার ছোট অথচ ছায়া সুনিবিড় গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। সেই টুঙ্গিপাড়াতেই জন্মেছেন বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।


'স্মৃতির দখিন দুয়ার' প্রবন্ধে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'নদীর পাড় ঘেঁষে কাশবন, ধান-পাট-আখ ক্ষেত, সারি সারি খেজুর, তাল-নারিকেল-আমলকি গাছ, বাঁশ-কলাগাছের ঝাড়, বুনো লতা-পাতার জংলা, সবুজ ঘন ঘাসের চিকন লম্বা লম্বা সতেজ ডগা। শালিক-চড়ুই পাখির কল-কাকলি, ক্লান্ত-দুপুরে ঘুঘুর ডাক। সব মিলিয়ে ভীষণ রকম ভালোলাগার এক টুকরো ছবি যেন। আশ্বিনের এক সোনালি রোদ্দুর ছড়ানো দুপুরে এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম। গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল-সাধারণ জীবনের মাধুর্যের মধ্যে দিয়ে আমি বড়ো হয়ে উঠি।'


'আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।'


'পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমরা ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমার দাদার একটি বড়ো নৌকা ছিল। যার ভেতরে দুটো ঘর ছিল, জানালাও ছিল বড়ো বড়ো। নৌকার জানালায় বসে নীল আকাশ আর দূরের ঘন সবুজ গাছপালা ঘেরা গ্রাম দেখতে আমার বড়ো ভালো লাগত। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই নৌকা ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। শৈশবের ফেলে আসা সেই গ্রাম আমার কাছে যেন সুভাষিত ছবির মতো।'


টুঙ্গিপাড়ায় পড়ালেখার হাতেখড়ি। বাল্যশিক্ষা নেন বাড়িতেই। তাদের পরিবারের জন্য মৌলভি, পণ্ডিত ও মাস্টার বাড়িতেই থাকত। বাড়ির সব ছেলেমেয়ে সকাল-সন্ধ্যা তাঁদের কাছে লেখাপড়া শিখত। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন শেখ হাসিনা।


১৯৫৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় পরিবারের সাথে মোগলটুলির রজনী বোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে স্থানান্তরিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। শেখ হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।


তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।


বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। শেখ হাসিনার সজীব ওয়াজেদ জয় (পুত্র) ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (কন্যা) নামে দুই সন্তান রয়েছেন। ওয়াজেদ মিয়া ৯ মে, ২০০৯ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।


সাতচল্লিশের উত্তাল সময়ে শেখ হাসিনার জন্ম। যখন জন্মগ্রহণ করেন, তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কলকাতায়। রাজনীতির অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু পিতৃত্বকে সবসময়ই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর প্রথম কন্যা শেখ হাসিনার জন্মানোর বেশ পরে তাকে দেখার সুযোগ মেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।


মূলত বঙ্গমাতার আদর-শাসন ও স্নেহসান্নিধ্যেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বেড়ে ওঠা। মায়ের আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গমাতার আড়াল থেকে চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কাজে অনুপ্রেরণা আজকের বাংলাদেশ গড়তে সবচেয়ে বড়ো অনুসঙ্গ। আর বাবা-মায়ের প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলন কাছে থেকে দেখেছেন। শেখ হাসিনা পিতার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন, তার পিতাই তার শিক্ষক আর মা তাকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে যেতে।


লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) মো. মফিজুল হক সরকার


(বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপকার: শেখ হাসিনা গ্রন্থ থেকে)


http://www.bbarta24.net/literature/202962


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com