
'একা' শব্দটাই একটা অবসাদ! জীবনে যা কিছু হতাশা, অপূর্ণতা তার প্রায় সবটাই ওই শব্দটা ঘিরে। মানুষ একা থেকে অনেক মহৎ কিছু করতে পেরেছে এমন ঘটনা বিরল। ইতিহাস বলে প্রত্যেক সফল মানুষের সাথে কেউ না কেউ থাকে সাথী হয়ে। তবেই না সে পৌঁছোতে পারে তার স্বপ্নের শিখরে। বর্তমান সময়ে একা থাকা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে কখন যে আমরা ডুবে যাচ্ছি গভীর অবসাদে কেউ তা বুঝে ওঠতেই পারছি না।
আবার অনেকেই আছেন যারা পরিবারের ছোট-বড় সদস্যকে সামলাতে নাজেহাল। কিছুতেই বাড়ির পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে পারছেন না। অথচ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা সুন্দর থাকলেই অনায়সেই এই সমস্যা থেকে বের হওয়া যায়। ভালো থাকা যায় সকলে মিলে একসাথে। সামাজিক দূরত্বের নিয়মবাঁধা এই সময়ে এক ছাদের তলায় সপরিবার থাকা বা একা থাকা দুইয়ের সমস্যাই বিস্তর। কীভাবে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আনন্দে থাকা যায় তার উপায়-
• এই অতিমারির সময়ে একা থাকাটা বাইরে থেকে দেখলে আশীর্বাদ মনে হতে পারে। একার ঘর, একাই একটু ফুটিয়ে খাওয়া, বাজারঘাট আর গা-ঘেঁষা আড্ডা সামলে চলা, ব্যাস। কোভিড থেকে নিশ্চিন্ত! তলিয়ে দেখলে, ব্যাপার অত সোজাসরল নয়। সেই যে রবীন্দ্রনাথের গল্পে নিঃসঙ্গ প্রবাসে জ্বরে-পড়া পোস্টমাস্টার নিকটজনের সঙ্গ-স্পর্শের জন্য আকুল হয়েছিলেন, এই করোনাকালে একা-থাকা মানুষটির তেমন আকুলতা সঙ্গত বইকি। এমন সময়ে সামান্য এক গ্লাস জল ঢেলে নিতেও স্বয়ং ভরসা, তাছাড়া এই মহারোগের রাজত্বে নিজের শারীরিক ও মানসিক ভাল থাকা নিশ্চিত করতে তো কাজ আরও ঢের। এক ছাদের তলায় আরও মানুষ মানে আশ্বাসের হাত, ভরসার কাঁধটুকু আছে। করোনা-আবহে একাকীরা কিন্তু একটু বেশিই ‘ভালনারেব্ল’।
• কেউ কেউ একা নন, তবে প্রায়-একা। প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দু’জন মাত্র বাসিন্দা, এমন বাড়ি বা ফ্ল্যাটের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রে অন্য শহরে বা অন্যদেশে। দূর-প্রবাসী সন্তানের বাবা-মায়েরা এমনিতেই ভিতরে ভিতরে ফাঁকা হয়ে থাকেন অনেকটা, সেই শূন্যতা যেন আরও গভীর করে তুলছে এই অতিমারি করোনা। শরীরের বয়স তো ক্রমশ বেড়েই চলে তার সাথে যুক্ত হয় মনের অবসাদ। এগুলো থেকে খানিকটা হলেও মুক্ত হওয়া যেত বিভিন্ন সামাজিকতায়, করোনা সেটুকুও কেড়েছে। উপরন্তু যোগ হয়েছে অজানা ভয়। তাদের কিছু হলে কে দেখবে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কে প্রশ্নগুলো আজ প্রকট।
• আবার এক ছাদের নীচে সকলে থাকলেই কি শান্তি? দেখা যাচ্ছে, তিন প্রজন্মের তিন রকম চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বেশি বয়সি আর সবচেয়ে কমবয়সি, দুই ধরনের সদস্যই খিটখিটে, বিরক্ত। দাদু ও নাতি বা নাতনি, দু’পক্ষেরই বদ্ধমূল ধারণা, ওদের স্রেফ আটকে রাখা হচ্ছে। এদের শরীর-স্বাস্থ্য, খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্তর সামলে যে ছেলেটি বা মেয়েটি নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে, তাদেরও গুচ্ছের চিন্তা। বাবা বিকেলে বেরিয়ে চায়ের দোকানে চলে গেলেন না তো? একে একে সব ফুরোচ্ছে, শিশুটির মন ভোলাতে এর পর কোন জিনিসটা ভাবা যায়?
• বাড়ি বসে ওয়র্ক ফ্রম হোম মানেই কিন্তু মুশকিল আসান নয়। বাচ্চার অনলাইন বা অ্যাক্টিভিটি ক্লাস শেষ হতে না হতে মা বা বাবাকে বসতে হচ্ছে অফিসের কাজ নিয়ে। তারই মধ্যে বাজার হল কি না, সেগুলি স্যানিটাইজ় করা হল কি না, কী রান্না হবে তার খোঁজ। গৃহসহায়িকা এলেও ভাবনা, না এলে তো আরও। করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে বাড়ির বয়স্ক মানুষটি হয়তো বাইরে বেরোতেন। রাস্তায়, পাড়ায়, চা-দোকানে, আবাসনের নীচে সমমনস্কতার দেখা মিলত রোজ। সেই মনের খোরাকও আজ নেই।
• করোনা-সতর্কতায় সামাজিক দূরত্ব বজায়ের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। নিজের বাড়ি, পাড়া, এলাকাতেই রোগাক্রান্ত মানুষটি বা তার পরিবারের সদস্যরা পাড়াপড়শির তোপের মুখে পড়েছেন, সে উদাহরণও কম নয়। কেউ কোভিড-পজ়িটিভ হলে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করা বা তাকে প্রায় একঘরে করার প্রবণতা বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘বন্ধু’ বা ‘প্রতিবেশী’ শব্দের অর্থ। এ সময়ে পরিবারই কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি, যদি বেঁধে বেঁধে থাকে পরিজন। কী করে সমস্যা জয় করে এ সময়ে স্বস্তির পরিবেশ বজায় রাখবেন বাড়িতে, জেনে নিন—
• একা থাকলে আপনার চিন্তাধারার সঙ্গে মানানসই কাজ খুঁজে নিন রোজকার দরকারি কাজের পাশাপাশি। চেনা শখগুলোরও ক্লান্তি আছে, একটু চেষ্টাতেই সেই ক্লান্তি মিটবে। সাহিত্য ভালবাসেন যারা তারা বিভিন্ন লেখা বাংলা বা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারেন। সেটা হতে পারে শেক্সপিয়রের সনেট বা জীবনানন্দের কবিতা। যাদের একটু-আধটু ছবি আঁকা, গান গাওয়ার শখ ছিলো মনে, ছেলেবেলার পুরনো সে শখে ধার দিতে পারেন অনায়াসে। এখন তো অফুরন্ত অবসর! এতে অাপনার সময় কাটবে বেশ আবার মনও থাকবে ফুরফুরে। পরখ করেই দেখুন!
• আট ও আশি, দু’জনকে সামলানো অসম্ভব নয়। বয়স্ক মানুষটির একমাত্র দাওয়াই টিভি, শিশুটির স্মার্টফোন। কিন্তু বাচ্চাকে স্মার্টফোনে অাসক্ত না করানোই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। সেক্ষেত্রে আপনি নিজের রান্নাঘরের কাজে ছোটটিকে হাত লাগাতে বলতে পারেন, মহানন্দে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দেবে, আবার শিখিয়ে দিলে দাদা-দাদীর ওষুধও দিবে ঠিক! এক সঙ্গে চা থেকে শুরু করে খাবার সবই খাওয়ার অভ্যেস করে নেন। আবার করে নিতে পারেন ঘরোয়া বড়দিন বা বিজয় দিবসের উদ্যাপন। কে গান গাইবে, কে বক্তৃতা দেবে, কার কবিতাপাঠ, কীভাবে ঘর সাজানো হবে, জাতীয় পতাকার বন্দোবস্ত এসব বিষয়ে ওদের পরিকল্পনা করতে দিন। ওঁরা তাতে ভাল থাকবেন, আপনিও।
এই সময়ে আপনার প্রতিবেশীর খোঁজটাও রাখুন। এ সময়টা বরং পাশে থাকার। সে পরিবারই হোক বা প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব, সামাজিক দূরত্ব যেন মনের দূরত্ব না বাড়ায়!
বিবার্তা/অনামিকা/জাই
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]