সাক্ষাতকার
'বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারবে নতুন প্রজন্ম, তাদের প্রতিই প্রত্যাশা'
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১৭:৫৯
'বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারবে নতুন প্রজন্ম, তাদের প্রতিই প্রত্যাশা'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজকর্মী জয়ন্তী রায়ের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলার রায়পুরায়। তাঁর বাবা ডা. বিনোদ বিহারী পাল এবং মা সরোজ নলিনী পাল। মেঘনা পারে জন্ম হলেও জয়ন্তীর বেড়ে ওঠা ব্রহ্মপুত্রঘেরা ময়মনসিংহ শহরে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা- সবই ময়মনসিংহে।


কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে প্রগতিশীল আন্দোলনে হাতেখড়ি। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে পরিচয় হয় বিশিষ্ট বাম রাজনৈতিক নেতা ও অর্থনীতিবিদ অজয় রায়ের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় নাটকীয়ভাবে অজয় রায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হন।


নতুন জীবন শুরু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর ময়মনসিংহ শহরে ফিরে আসলে স্বামী অজয় রায় সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় জীবিকার জন্য জীবন বীমা করপোরেশনে চাকরি নেন জয়ন্তী রায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাজেও জড়িত হন তিনি। ১৯৭৩ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।


মানুষের সঙ্গে থেকে মানুষের সুদিন-দুর্দিনে সঙ্গী হওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখেন না। তাই নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে ব্যস্ত সময় কাটান।


বিবার্তা২৪ডটনেটের প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় জয়ন্তী রায় বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও তার জীবনের নানা গল্প। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অলক দাশগুপ্ত। লিপিবদ্ধ করেছেন সামিনা বিপাশা।


বিবার্তা: শৈশব থেকে আপনার বেড়ে ওঠা এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, সেসময়ের গল্প শুনতে চাই।


জয়ন্তী রায়: সত্যিকারার্থে আমি গ্রামের মেয়ে, মেঘনা পাড়ের মেয়ে। নরসিংদীর রায়পুরায় আমার জন্ম। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। আমাদের পরিবারের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। পুরো গ্রাম্য পরিবেশ যেটাকে বলে সেটা আমি পেয়েছি। নদীতে পাল দিয়ে নৌকা যেত, মাঝিরা সাঁতার কাটত, ছেলে-মেয়ে একসাথে নদীতে গোসল করতাম। পৌষের পিঠা, আখড়ায় গান, গ্রামীণ এই খোলামেলা উদ্দাম আনন্দের পরিবেশে আমরা বড় হয়েছি। বিশেষ করে ছোটোবেলাতেই আখড়াতে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ দেখেছি। একটু বড় হওয়ার পর মা আমাকে আর নরসিংদী রাখতে চাইলেন না, পড়াশোনার জন্য ময়মনসিংহে পাঠিয়ে দিলো। সেখানেও দারুণ পরিবেশ ছিল। স্কুলে সরস্বতী পূজা হত, সবাই মিলে এত আনন্দ করতাম...


ছাত্রজীবনেই অজয় রায়ের মতো ডাকসাইটে কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে পরিচয়। গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কিছু কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং এক পর্যায়ে অজয় রায়ের প্রতি প্রেম-প্রণয়।


আসলে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে আমার এই সামান্য জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়েছে। আমি ছাত্র ইউনিয়ন না করলে, আমাদের পরিবারে অজয় রায়ের উপস্থিতি না ঘটলে কিংবা তাঁর সঙ্গে আমি জীবন বেঁধে না নিলে কী হতো, সেটা এখন কল্পনার বিষয়। কী হতো সেটা আর এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়। কী হয়েছে সেটাই বিষয়।


আমি অজয় রায়ের সঙ্গে জীবন জড়িয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজ আমার যে পরিচয় সেটা অন্য পথে হাঁটলে সম্ভব না-ও হতে পারতো। আমি রাজনীতি করবো– এমন ভাবনা কখনোই ছিল না। তবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আগ্রহ ভেতরে ভেতরে ছিল।


বিবার্তা: ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত- এরকম বিপ্লবীদের দেখেই কি দেশপ্রেমের চেতনা নিজের মধ্যে অনুভব করলেন?


জয়ন্তী রায়: তারা তো আছেনই, তাদের বিপ্লবী চেতনা অনুপ্রাণিত করেছে। আসলে পরিবেশটাই আমাদের জাগিয়ে তুলছিল। তখন পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। মুসলিম লীগ করত যারা ওদের কাছে চাঁদা চাইতাম, ওরাও দিত। পাঁচ পয়সা, চার আনা যে যা পারত তাই দিত। ভালো কাজ করলে দিবেই। আমরা যে সময় রাজনীতি করতাম, মিটিং মিছিল করতাম, কোন ছেলে কখনো কোনো অশালীন কথা বলেনি। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল শিববাড়ি ক্লাব, মৃদুলদা, ভুলাদা, চন্দনদা, এরা অভিভাবকের মতো আমাদের দেখে রাখত।


স্কুলজীবনের শেষদিকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কার প্রভাবে, কীভাবে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিলাম, তা এখন আর মনে নেই। তবে ছাত্র ইউনিয়ন যে আমার চোখ খুলে দিয়েছিল, জীবন ও জগৎকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল, সেটা বেশ মনে আছে।


বিবার্তা: যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আপনি কি কলকাতা চলে গেলেন?


জয়ন্তী রায়: প্রথমে কলকাতা যাই, তারপর গোহাটি। সেখান থেকে ময়মনসিংহ বর্ডারের কাছে মেঘালয়ের তুরা। ওই ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতাম। একা থাকতাম।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধের কোন ঘটনাটি আপনার মনে এখনো গেঁথে আছে?


জয়ন্তী রায়: তখন শীতের সময় চলে এসেছিল। অজয় রায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাপড় সংগ্রহের কাজে গিয়েছে। আমার ভাইটাও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। রাতে আমার কাছে এসে ঘুমাত। সেসময়ে একদিন, আমার বিয়ের যিনি সম্বন্ধ করেছিলেন সেই দাদা এসে বললেন, প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছি না। কী উপায় হবে বুঝতেছি না। তখন মাথায় এলো আমার হারটার কথা। বিয়ের সময় দাদু আমাকে তিন ভরির একটা হার দিয়েছিলেন। যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের সুযোগ ঘটেনি তাই বিয়ের গয়নাগাটি ছিল না। ছিল শুধু সেই হারটা, কানের দুটো দুল আর টাইটানের একটা ঘড়ি। আমি যখন দাদাকে বললাম হারটা নিয়ে যেতে, তিনি বললেন- এটা তো তোমার বিয়ের। আর তো কিছু নেই। এটা কেন দিবে? আমি বললাম, হার দিয়ে কী হবে, যখন মুক্তিযোদ্ধারা খেতেই পারছে না। দেশ স্বাধীন হলে হার অনেক পাওয়া যাবে।


বিবার্তা: তখন কি সেই হার বিক্রি করা হলো?


জয়ন্তী রায়: হ্যাঁ, হারটা দুইশ-আড়াইশ টাকায় বিক্রি করা হলো। তারপর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা হলো। ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেক মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থী শিবিরের অনেকেই যারা সেদিক দিয়ে গেছে তারা সেই গল্পটা বলে এখনো।


বিবার্তা: সেই ক্যাম্পে আপনারা কতদিন ছিলেন? স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন, তারপর কী হল সেই গল্পটা বলুন।


জয়ন্তী রায়: যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ক্যাম্পে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আগরতলায় চলে এলাম। পরে অজয় রায় বলল, দেশে ফিরে চলো। দেশে ফিরে এলাম। দেশে এসে ময়মনসিংহ শহরে গেলাম। দাদুর বাড়িতে গিয়ে দেখি সব লুটপাট হয়ে গেছে।


এরপর জামালপুরের গান্ধী আশ্রমের রাজিয়া খালাম্মা উনি মহিলা পরিষদ করতেন- থাকার জায়গা দিলেন। খুব খারাপ অবস্থা ছিল। টাকা নাই পয়সা নাই, কী যে অবস্থা! তখন যে রিলিফ আনতাম, আমার একটুও খারাপ লাগত না। দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।


বিবার্তা: মহিলা পরিষদে যুক্ত হওয়ার পেছনের গল্পটা বলুন।


জয়ন্তী রায়: আমি মহিলা পরিষদে যুক্ত হই ১৯৭২ সালে। এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে দেশ স্বাধীন হলো, তখন এরকম একটা সংগঠনের চিন্তা করা হলো যারা মহিলাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে। সুফিয়া কামাল প্রেসিডেন্ট। পার্টির সিদ্ধান্ত হলো মহিলাদের সংগঠন হবে, মহিলাদের জাগরণে কাজ করবে, সেই জায়গা থেকে মহিলা পরিষদ করা এবং আমি যুক্ত হই।


বিবার্তা: নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলুন।


জয়ন্তী রায়: মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। নতুন প্রজন্ম দেশকে ভালোবাসবে এই প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারবে নতুন প্রজন্মই।


এই দেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে, এই দেশ রবীন্দ্রনাথের, এই দেশ নজরুলের, এই দেশ জীবনানন্দের। এই দেশকে ভালোবেসে গড়ে তুলতে হবে, আর সেটি পারবে নতুন প্রজন্মই।


বিবার্তা/অলক/এসবি/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com