সাক্ষাতকার
'যারা ভাষা আন্দোলনকে অস্বীকার করবে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করবে'
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:১১
'যারা ভাষা আন্দোলনকে অস্বীকার করবে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করবে'
রুদ্র শুভ ও সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

'আমাদের যে অর্জন এর সিংহভাগই পেয়েছি ভাষা অন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তাই যারা ভাষা আন্দোলনকে অস্বীকার করবে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করবে, তারা বাঙালি সত্তাকে অস্বীকার করবে।'



কথাগুলো বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। বর্তমানে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনে সংগ্রামের ও গৌরবময় ঐতিহ্যের বড় একটি অধ্যায় ২১ ফেব্রুয়ারি।


বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আদায়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ভাষা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে। ভাষা আন্দোলনের সেই বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে হাতে ফুল নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবে।


১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।


একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে জাতীয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বিবার্তা ২৪ এর প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন নানা কথা এবং বাংলার ইতিহাস।


সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা প্রতিবেদক রুদ্র শুভ। যার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল।


বিবার্তা : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকাই কি মুখ্য?


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎসমূল ভাষা অন্দোলন। ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৫ সাল থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হয়েছিল। তবে আমাদের ইতিহাস হচ্ছে কমিউনাল হিস্টোরি।


কারণ কংগ্রেস যে উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি থেকে সরে গিয়ে অচিরেই হিন্দু জাতীয়তাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় মুসলিমরা ছিল উচ্চবর্গীয় আশরাফ, আতরাফ।


এদের মধ্যে যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল কংগ্রেস অচিরেই একটি হিন্দু সংগঠনে পরিণত হবে। কেননা তারা একসময় 'বন্দে মাতরম' কে দলীয় সঙ্গীত হিসেবে চূড়ান্ত করে। মূলত এইসকল কারণেই স্যার সৈয়দ আহমদ এর মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, মুসলিমদের কংগ্রেসে যোগদানে বারণ করলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ও তার অনুসারীদের মধ্যে নওয়াব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ব্রিটিশ পন্থী। এরা সকলেই অনুধাবন করেছিলেন, কংগ্রেসে যোগদান করে মুসলিমরা তেমন লাভবান হবে না।


কিন্তু এদিকে রাজনৈতিকভাবে মুসলিমদের জন্যে কোনো সংগঠনও ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়, এবং ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯২১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এর সবগুলোর পিছনেই সাম্প্রদায়িকতা আছে।১৯৪৭ সালের দেশভাগের পূর্বে এই অঞ্চলের মানুষের কোনো জাতীয়তাবাদ ছিল না। যা ছিল জাতীয়তাবাদহীন ইতিহাস। তবে এইসময়ে মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তত্কালীন এই অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বলতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি মুসলিমদের মধ্যে বিশ্ব মুসলিম উম্মার একটা চেতনা লক্ষ্য করা যেত।


ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় যখন মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন তুরস্কের খিলাফাত আন্দোলনের সাথে এই অঞ্চলের মুসলিমরা মার্চ করে হিন্দু মুসলিম ঐক্য সৃষ্টি করে। এই ঐক্যের ভিত্তিতে ১৯১৬ সালের লখনৌ প্যাক্ট , ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট এর মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলিমের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তবে তা কখনোই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল না।


ভাষা অন্দোলনের ইতিহাস ১৯৪৮-৫২ চার বছরের। এই সময় বাঙালিরা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। যা ড. মো. শহীদুল্লাহ এর একটি কথায় প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, 'আমরা বাঙালি যেমন সত্য, তার থেকেও বেশি সত্য আমরা বাঙালি' এই উক্তির মধ্যেই বাঙালির জাতীয়তাবাদের বীজ অন্তর্নিহিত ছিল। আর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎস। '৪৭-'৭১ পর্যন্ত ২৩ বছরের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, এর পূর্বে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল বাংলাকে আরবী হরফে লিখার বিরোধিতা নিয়ে। এইসময় রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৬৯ গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই সকল কালপর্বেই ভাষা অন্দোলন আমাদের সাহস যুগিয়েছে। মূলত একটি জায়গায় ঐক্য লাগে, সেটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।


বিবার্তা : ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকার শুরু মূলত কখন?


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত পাকিস্তান নামের দুইটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউর আহমেদ ভাষা অন্দোলন নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখেন। এর প্রতিউত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন ড. মো. শহীদুল্লাহ এবং কাজী মোতাহের হোসেন। কেননা এদের পরিশ্রম ও চিন্তার ফসল আমাদের ভাষা আন্দোলন। আর এই চিন্তার ফসলটি গ্রহণ করেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি যখন ঢাকায় আসলেন, তখন ঢাকা ছিল তার কাছে অপরিচিত। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন এই আন্দোলনটি ছিল ভ্রান্ত আন্দোলন এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব একটি ভ্রান্ত তত্ত্ব।


বিবার্তা : আমরাই সেই জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এর পরে আরো যত আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রাপ্তি এমনকি আমাদের মহান স্বাধীনতাও ভাষা আন্দোলনের ফসল, এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : জিয়াউর রহমান বাঙালি নাকি বাংলাদেশি প্রশ্নে জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাংলায় কথা বললেও তাদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয়। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ আমরা বাঙালি। তবে আমাদের কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে, যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। তাদেরকে আমরা বাঙালি না বলে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতে পারি। এই একটি প্রশ্ন জিয়াউর রহমান উস্কে দিয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল বিতর্কের বিকৃত ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি ক্ষমতা লাভ করেছিল এবং তারা আমাদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে, স্লোগানকে পরিবর্তন করা হয়েছিল।


তাই আমাদের যে অর্জন এর সিংহভাগই পেয়েছি ভাষা অন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তাই যারা ভাষা আন্দোলনকে অস্বীকার করবে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করবে, তারা বাঙালি সত্তাকে অস্বীকার করবে।


বিবার্তা : একুশের চেতনা এখন কতটা ধারণ করছি আমরা এবং কতটা ধারণ করলে কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব?


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : ভাষা অন্দোলনের চেতনা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে সরকার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কেননা আমরা নিজেরা নিজেদের ইতিহাস না জানলে আমাদের মধ্যে দেশাত্ববোধ কাজ করবে না, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবো না।


আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অল্প সাউন্ডে শুনতে হতো। ১৯৯১ সালে যখন এরশাদ সরকারের পতন হয়, সেই পতনের দিনই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উচ্চ শব্দে প্রচার করা হল। এই সময়টাতে ইতিহাসের দীর্ঘ কালপর্ব অন্ধকারে রাখা হয়েছিল, যেমন আমার বাড়ির লোকেরা জানতই না বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফুটেজ আছে।


তাই সরকার উচ্চ শিক্ষার প্রতিটি স্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু ৯ মাসের ইতিহাস নয়, এই ইতিহাস হচ্ছে ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস।


যা লক্ষ্য করা যায়, বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম তুলে ধরেছেন। সরকার খুবই সুচিন্তিত ভাবে উচ্চশিক্ষায় আমাদের এই ইতিহাসকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। বর্তমান সময়ের বই মেলায় যে সকল বিক্রয় করা হয় তার সিংহভাগই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।


তাই আমাদের কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে হবে, আর আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করি বলেই, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোনো দলের বর্তমানে সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে পারছে না।


বিবার্তা : বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে? যদি সেটা কম হয় তাহলে করণীয় কি?


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : এখনকার তরুণ প্রজন্ম বেশ সচেতন, তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং আমি মনে করি এই যে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি হয়েছে তা ভবিষ্যতে আর কেউ নিমজ্জিত করতে পারবে না।


বিবার্তা/রুদ্র/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com