শিরোনাম
সাক্ষাতকার
কণ্ঠই ছিল একমাত্র অস্ত্র, এটা দিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি: শব্দসৈনিক কল্যাণী ঘোষ
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৫৪
কণ্ঠই ছিল একমাত্র অস্ত্র, এটা দিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি: শব্দসৈনিক কল্যাণী ঘোষ
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

"বিভীষিকাময় ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বীভৎসও ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলো। এখন তো আমাদের এই প্রজন্ম তৈরি একটা দেশ পেয়েছে। ওরা তো জানে না কত মূল্যবান প্রাণ, কত কষ্ট, কত ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই দেশটি। একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় কণ্ঠ দিয়ে বাঙালি মুক্তিবাহিনীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছি। ওই সময় যেসকল শব্দসৈনিকেরা গণসংগীত সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি বাঙালির আতঙ্কিত হৃদয়ে স্বাধীন দেশ জয়ের আশা জাগিয়েছিলেন, তাদের সাথে আমিও শুরু থেকে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে সংগ্রাম করেছি। শক্তিশালী কণ্ঠকে হাতিয়ার করে আমরা মা-মাটি ও দেশের কথা ছড়িয়ে দিয়েছি। ইথারে ভেসে রক্তে নাচন তোলা সেসব গান পৌঁছে দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের কানে। সেই জাগরণের শব্দ ও সুরগুলি তাদের হৃদয়ে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে।"


সম্প্রতি বিবার্তার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলি বলেছেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। পারিবারিকভাবেই সঙ্গীতের আবহে বেড়ে উঠেছেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। সঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বেশকিছু সংগঠন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শব্দসৈনিক শিল্পী কল্যাণী ঘোষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শব্দসৈনিক ছিলেন। তাঁর পরিবারের আট ভাই-বোন এবং বড় বোনের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা।



তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের বিশেষ গ্রেডের একজন সংগীতশিল্পী। বিবিসি রেডিও ও টেলিভিশন, ভয়েস অব আমেরিকা ও আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। ১৯৭৬ সালে বিবিসি রেডিওতে সংবাদ পাঠও করেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কন্ঠ দিয়েছেন কয়েকটি ছবিতে। সুদীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন এই বীর শব্দসৈনিক। স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমির অফিসার পদে যোগদান করেন। বাংলা একাডেমির পাঠ্যপুস্তক, গ্রন্থাগার, বিপণন, সংস্কৃতি গবেষণা, সংকলন ও ফোকলোর বিভাগে বিভিন্ন সময়ে ৩২ বছর ধরে কাজ করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে গুরুত্বপূর্ণ অভিধান প্রকাশের কাজে জড়িত ছিলেন। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে উপপরিচালক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।



মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। সে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বিবার্তার। তার সাথে দীর্ঘ আলাপের চুম্বক অংশ বিবার্তার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হল।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোন বিষয়টি আপনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল?


কল্যাণী ঘোষ: ১৯৬২ সালে আমি মেট্রিক পাস করি। একই সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র চালু হয়। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকেই আমি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত গান গাওয়া শুরু করি। তখন থেকে চট্টগ্রাম বেতারে আমি নিয়মিত গান গেয়ে আসছি। ৭ই মার্চে ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন, তখন থেকে আমি বোন উমা খান ও প্রয়াত ভাই প্রবাল চৌধুরী আমরা তিন ভাই-বোন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া আপামর বাঙালিদের গণজাগরণমূলক গানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব।


স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশকে স্বাধীন করতে এবং দেশের মানুষের মনে উৎসাহ উদ্দীপনা জাগানোর জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল বেতার। আমি একজন কণ্ঠশিল্পী। দেশ মাতৃকার তরে আমার দেবার একমাত্র সম্বল ও অস্ত্র ছিল কন্ঠ। তাই গণজাগরণমূলক সংগীতের মাধ্যমে মানুষের মনকে উজ্জীবিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করণের লক্ষ্যেই আমরা তিন ভাই-বোন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলাম। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিকামী ভাই-বোনদের মনে সাহস যুগিয়েছি। এটা রণক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি মনে করি, ওই সময়টাতে এটাই ছিল আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও শ্রেষ্ঠ কর্ম।



বিবার্তা:মুক্তিযুদ্ধে আসা কীভাবে?


কল্যাণী ঘোষ:৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকের পর চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান রেকর্ডিংয়ের জন্য আমাদের ডাকা হয়। তখন আমরা তিন ভাই-বোন ওই গানগুলি রেকর্ডিং করি। আমার প্রয়াত সংগীত গুরু ও শিল্পী মোহন লাল দাস, প্রয়াত সৈয়দ আনোয়ার মুফতির কথা, সুর ও প্রযোজনায় আমরা প্রায় আট থেকে দশটা গান রেকর্ডিং করি। পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্টেশন থেকে ২৬ মার্চ ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলো প্রচার করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি যখন কালুরঘাট থেকে কলকাতার বালিগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেও আমরা তিন ভাই-বোন মিলে ৫০টারও বেশি গণজাগরণমূলক গান রেকর্ড করি।


বিবার্তা: জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজাকারদের অত্যাচারে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ওই সময়কার বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা জানতে চাই।


কল্যাণী ঘোষ: আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। আজ থেকে ৫১ বছর আগের কথা। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ২৫ বছর। আমি তখন সদ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে এমএ পাস করে পাথরঘাটা ‘সেন্ট প্লাসিডস’মিশনারী হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। তখন পাকিস্তানি বর্বর নরপশু হায়নাদের পাশবিক নির্যাতন ও অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর বাঙালি জাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমিও ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে পথে বেরিয়ে পড়ি। পরে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম।


বিবার্তা:পরবর্তী সময়ে কী হলো?


কল্যাণী ঘোষ: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৬মার্চ চট্টগ্রাম আক্রান্ত হয়। তখন চট্টগ্রাম শহরে ছিল শুধু আগুনের লেলিহান শিখা। ২৮ মার্চ পর্যন্ত শহরে থাকার পর আমি মা-বাবা আমার ভাই প্রবাল, বোন উমাসহ সবাই চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি রাউজানের বীনাজুড়িতে। তখন যাত্রা পথে কর্ণফুলী নদীতে বহু মানুষের লাশ ভাসতে দেখেছি। গ্রামে গিয়ে রাজাকার গুন্ডাবাহিনীদের ভয়ে কখনো গোয়াল ঘরে গরু, ছাগলের সাথে, কখনো জঙ্গলে থেকেছি। কখনো বা পাশে গ্রামের কুঁড়েঘরে লুকিয়ে থেকেছি। অনেক জায়গায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সে এক লোমহর্ষক, বর্বর ও ভয়ঙ্কর অবস্থা। সব সময় আমাদের আতঙ্কে থাকতে হত। কখন কাকে ধরে নিয়ে গেল, কাকে পাশবিক নির্যাতন করল, কাকে গুলি করে হত্যা করল। তখন গ্রামে এমন নানারকম পাশবিক ঘটনা ঘটছিল। এর মধ্যে ১৩এপ্রিল পাশের গ্রামে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নুতন সিংহসহ আরো কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল রাজাকার বাহিনী। রাজাকারদের অত্যাচারে সেখানে ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারিনি।


বিবার্তা: পরে কোথায় গেলেন?


কল্যাণী ঘোষ: ২১ এপ্রিল। চারদিকে মুষলধারে বৃষ্টি ও প্রচণ্ড বজ্রপাত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার তাগিদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে এই বৃষ্টির মধ্যেই কাদা-মাটির পিচ্ছিল পথে অসুস্থ বাবা ইঞ্জিনিয়ার মনমোহন চৌধুরী, মা লীলাবতী চৌধুরী, স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সুরঞ্জন ঘোষ, আমার দেড় বছরের কন্যা ইন্দ্রানী ঘোষ শম্পা, প্রয়াত ভাই প্রবাল চৌধুরী, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, বোন উমা খান, দেবী চৌধুরী, পূর্ণিমা দাস চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী খোকাসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মোট ২৩ জন সদস্য গভীর রাতে এক কাপড়ে, স্বদেশ প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে, অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা শুরু করি। আমরা যারা নারী ছিলাম তারা সবাই মুখে কাদামাটি ও কালি মেখে, বোরকা পরে অজানার পথে যাত্রা শুরু করি।


বিবার্তা: তারপর কী হল?


কল্যাণী ঘোষ: যাত্রাপথে রাতে বিশ্রামের জন্য ট্রাকের নিচে সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা হল। কী দুর্ভাগ্য, রাতে যখন সবাই ঘুমে, তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামছে, তখন দুঃখে আর কষ্টে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল সবার বুক। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের রামগড়ের সাবরুমে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন সীমান্তের ওপারে জল বসন্ত, এপারে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করেছিল। হাজার হাজার মানুষের স্রোতে এপার-ওপার একাকার হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। আমার বাবা ছিল ডায়াবেটিস রোগী। পাহাড়ের উঁচু-নীচু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে পায়ের নিচে কাঁচ-পাথরের ঘষাঘষিতে ফোসকা পড়ে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাবা আর হাঁটতে পারছিলেন না। বাবা বারবার বলছিলেন আমাকে রেখে তোরা পালিয়ে যা। না হলে তোরা কেউ বাঁচতে পারবি না। কিন্তু আমরা বাবার কথায় কান না দিয়ে প্রিয়তম বাবাকে ছেড়ে এক পাও যাইনি। আমার স্বামী ও ভাই প্রবাল চৌধুরী ও আরো দুই জ্যাঠাতো ভাই বাবাকে একটি চাদরের মাঝখানে বসিয়ে বাকি পথ বহন করে নিয়ে যায়।


এরই মধ্যে রামগড় বর্ডারে পৌঁছুলে আমার ছোট বোন উমা খান জল বসন্তে আক্রান্ত হয়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই দুঃসময়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্য আমার বন্ধু প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান, ফটিকছড়ির প্রাক্তন এমপি ও বন্ধু নুরুল আলম, ডাক্তার জাফরুল্লাহ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমার মেঝ বোন দেবী চৌধুরীর দশ মাসের একমাত্র ছোট শিশুও তখন রক্ত আমাশয় হয়ে মরণাপন্ন অবস্থা। তখন সবাই বলছিল বাচ্চাটাকে তোমরা ফেলে চলে যাও। আমরা তাকেও ফেলে যেতে পারিনি।


বিবার্তা: জেনেছি আপনারা কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুঁজে না পেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের গানে গানে উজ্জীবিত করেছেন। সেই দিনগুলির সম্পর্কে কিছু বলুন।


কল্যাণী ঘোষ: ১৯৭১ সালের মে মাস। বিপদসংকুল পথঘাট পেরিয়ে সপরিবারে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছি। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঠিকানা খুঁজতে থাকি। কত মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করেও কোন খবর পাইনি। এরই মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ হয় আমাদের তিন ভাই-বোনের। সেখানেই দেখা হয় ড. সানজিদা খাতুনের সাথে। ওই দিন আমাদের গান শুনে তিনি তাঁর সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’তে যোগ দিতে বলেন, যেটা পরবর্তীতে ‘মুক্তির গান’ নাম হয়েছিল। পরদিনই আমরা যোগ দিয়েছিলাম। তাঁদের সাথে ট্রাকে ট্রাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে গান করেছি। এই গ্রুপটা তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান, আলমগীর কবির, মোস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, কলকাতার দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়রা।


বিবার্তা: পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুঁজে পেলেন কীভাবে?


কল্যাণী ঘোষ: এভাবে কেটে যায় মে মাস। জুন মাসের শুরুতে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ সংগঠনের মহড়া থেকে ফেরার পথে গড়িয়াহাটার মোড়ে দেখা হয় প্রখ্যাত গায়ক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার ও সংগীত পরিচালক সমর দাসের সাথে। তখন তাঁরা বলেন, এই সময়ে তোমাদের খুব প্রয়োজন। চল আমাদের সাথে। গানে কণ্ঠ দিতে হবে। তাঁরা আমাদের আগে থেকেই চিনতেন। ওইদিন তাঁরা আমাদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্টুডিওতে নিয়ে যান। সেদিন থেকেই আমরা দেশাত্মবোধক ও গণসংগীত রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে উৎসাহ ও প্রেরণায় নিজেদের নিয়োজিত করি।


বিবার্তা: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাটানো দিনগুলি কেমন ছিল?


কল্যাণী ঘোষ: প্রতিদিন রেকর্ডিং থাকত। একটানা আমাদের দুই-তিনটা গান রেকর্ড করতে হতো। কেউ গান লিখছে, তখনই সুর করছে, তখনই রেকর্ড করতে হচ্ছে। কাদেরী কিবরিয়া, অনুপ ভট্টাচার্য, অরূপ রতন চৌধুরী, লাকী আখন্দ, রমা ভৌমিক, মাধুরী আচার্য এরা ছিল। ফাঁকে ফাঁকে যখন সময় পেতাম তখন সমর দাসের নেতৃত্বে গান গেয়ে চাঁদা তুলতাম। কখনও ছোট মেয়েকে কোলে নিয়েও ক্যাম্পে গান করতে যেতাম। বাসে, ট্রেনে, ট্রাকে করে যেতাম। ঠাণ্ডার মধ্যে তার তেমন জামাও ছিল না। মাঝে মাঝে ওকে বাবা-মার কাছেও রেখে যেতাম, কিন্তু বাবা খুব অসুস্থ ছিল।


বিবার্তা: নারী হয়েও আপনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধে ঠিকই অংশ নিয়েছেন। এতটা মানসিক শক্তি কোথা থেকে পেয়েছিলেন?


কল্যাণী ঘোষ: চোখের সামনে যখন চারদিকে আগুন, ধোঁয়া দেখেছি, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শুনেছি, তখন আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। তারপরেও মনোবল হারাইনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশের জন্য কিছু একটা করব। আমার দেশকে পাকিস্তানী রাজাকারদের হাত থেকে মুক্ত করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। কারণ আমাদের কণ্ঠই হচ্ছে বুলেট। একজন শিল্পী হিসেবে অস্ত্র ছিল আমাদের একমাত্র কণ্ঠ। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণামূলক গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস যুগিয়েছি। জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি কণ্ঠ দিয়ে। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু দেশকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসার কারণে।


বিবার্তা: আপনি একটা সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,সেটি সম্পর্কে জানতে চাই।


কল্যাণী ঘোষ: সময়টা ছিল প্রচণ্ড উত্তাল। চারদিকে মুক্তিযুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা, মনের জোর বাড়ানোর অন্যতম অস্ত্র ছিল এই কণ্ঠ। তাই তখন আমি বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী’ গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। সেখানে ২৫-৩০ জন শিল্পী গান গাইতেন। মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ‘একটি সূর্যের জন্ম’ নামে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। এই স্ত্রিপ্টের মধ্যে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সব গান ও ঘটনা লেখা হয়েছিল। উনি স্ক্রিপ্ট পড়তেন আর আমরা এর ফাঁকে ফাঁকে গণসংগীত করতাম।


এই সংগঠনের শিল্পীরা আসানসোল, জামসেদপুর, বর্ধমান, দুর্গাপুর, নদীয়া, কল্যাণী, বসিরহাট, রানাঘাট, বারাসাত, মেদীনীপুর, ঝাড়গ্রাম, কলামন্দির, রবিন্দ্র সদন, মহাজাতি সদন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনের জন্য গান করতেন। আমরা ভারতের জনতার দরবারে গিয়েছি। কিন্তু এ সংগঠনের অনেকেই এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।


প্রবাল চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী খোকা, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, বিপুল ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম, সারওয়ার জাহান, হরলাল রায়, অরূপ রতন চৌধুরী, উমা খান, পূর্ণিমা দাশ, দেবী চৌধুরী, মিতালী মুখার্জী, সুজিত রায়, এম এ মান্নান, রুপা ফরহাদ, মঞ্জুর আহমেদ, মালা খুররম, প্রমা ভৌমিক, স্বপ্না রায়, ঝরনা ব্যানার্জি, জয়ন্তী লালা, রফিকুল আলম, অনুপ ভট্টাচার্য, প্রয়াত মাধুরী আচার্য, প্রয়াত মৃনাল ভট্টাচার্য, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, আবুল নওশের মনোরঞ্জন ঘোষাল, তপন মাহমুদ, মলয় কুমার গাঙ্গুলীসহ আরও অনেকে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ওরা যে কী কষ্ট করেছে! একটা সিঙ্গারা খেয়ে দিন কাটত। সে বছর ভারতে অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছিল। কোনো গরম কাপড় ছিল না। তাও স্কুল ঘরে ফ্লোরিং করতাম। ফ্লোরে চাদর-টাদর কিছুই থাকত না। ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকতাম। রুমা গুহঠাকুরতার ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’ সংগঠনটির মাধ্যমেও আমরা বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়েছি।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে বীর শব্দসৈনিকদের অবদানের কথা কখনো ভুলবার নয়।


কল্যাণী ঘোষ: তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, প্রণজিদ বড়ুয়া, প্রমুখের সুর ও প্রযোজনায় সমবেত কণ্ঠে আমরা অসংখ্য গান গেয়েছি। এখন দেশসহ সারাবিশ্বে যেসব গণজাগরণমূলক গানগুলি গাওয়া হয়ে থাকে, ওই সময়ে আমরা এই গানগুলোতে সুর দিয়ে রেকর্ডিং করেছি। স্বাধীনতার সময় আমরা সমবেত কণ্ঠে গণজাগরণমূলক গান বেশি গেয়েছি। একক বা দ্বৈত কন্ঠে খুব কম গানই গাওয়া হয়েছে। সমর দাসের সুর করা কালজয়ী গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণ প্রেরণা জুগিয়েছে। মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ।


আমরা তিন ভাই-বোন, সমবেত কণ্ঠে অসংখ্য গান গেয়েছি। আমাদের গাওয়া অসংখ্য কালজয়ী মুক্তিযুদ্ধের গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তুলো তুলো, সময় যে হল হল’, ‘নও জোয়ান সব এগিয়ে চলো’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’, ‘ভেবো না গো মা, তোমার ছেলেরা (প্রবাল চৌধুরী)’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব’, ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি’, ‘সপ্ত সাগর’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ প্রভৃতি।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী গানগুলি রের্কিডিংয়ের সময় না থেকেও এখন অনেকেই দাবি করছেন ওই সময়ে তারা গান করে মুক্তিকামীবাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধ করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কেমন?


কল্যাণী ঘোষ: দেখুন বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। ওই সময়ে প্রত্যেকটা গান আমরা ১০ থেকে ১৫ জন শিল্পী সমবেত কন্ঠে গেয়েছি। যাদেরকে ওই সময় স্টুডিওতে রেকর্ডিং করতে বা সমবেত কণ্ঠে সুর দিতে কখনও দেখিনি, এমন দেড়শ থেকে ২০০ জন শিল্পী বলছেন যে, এই গানগুলো তাঁরা গেয়েছেন। এরা দেশকে এখন হৃদয়ে ধারণ করতে পারেননি। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে কেউ কখনও জাতির সামনে এমন মিথ্যে বলতে পারতেন না। সত্যিকারের দেশপ্রেম নেই বলে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় এমন মিথ্যাচার করছেন। আমরা তো সবাইকে চিনি আর এখনও মারা যাইনি। যারা ওই সময় গান না করেও নিজেদের কণ্ঠযোদ্ধা বলে দাবি করছে তাদের আমি ধিক্কার জানাই।



বিবার্তা: কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?


কল্যাণী ঘোষ: যখন বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি হিসেবে যুদ্ধ করেনি। আমরা সবাই বাঙালি আর বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। পাকিস্তানী হায়নাদের হাত থেকে নিজের মায়ের ভাষা ও বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে, দেশকে স্বাধীন করতে আমরা সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। দুঃখজনক বিষয় হল, স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এখনও এদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নানা ধরনের অত্যাচার এবং তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়ে থাকে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়ে থাকে। আর মুক্তিযুদ্ধ না করেই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। আমি এমন একটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন, দুর্নীতিমুক্ত, দারিদ্র্যতামুক্ত, অসম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ দেশ দেখতে চাই, যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য। সবাই যেন সব অধিকার সমভাবে পেতে পারে।


বিবার্তা/গমেজ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com