শিরোনাম
‘কোয়াকের অপচিকিৎসায় মুখের ক্যান্সার বাড়ছে’
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:১২
‘কোয়াকের অপচিকিৎসায় মুখের ক্যান্সার বাড়ছে’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পশ্চিম ছাগলনাইয়া গ্রামের আফজল মুন্সি বাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্ম হয় অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুলের। তিনি মরহুম মো. আমিনুল ইসলাম ও মরহুমা নুরের নাহারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ডা. হুমায়ুন কবীর ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে বিডিএস সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে উদ্ভাবনী গবেষণায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (আইবিএসসি) থেকে ডেন্টিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। অধ্যাপক ডা. বুলবুল বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব ও প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কার্যকরী নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করে আসছেন।


তিনি দীর্ঘ দিন ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান এবং ডেন্টিস্ট্রির অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। সেইসাথে তাকে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ডেন্টাল সার্জনদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন ডেন্টাল স্বাস্থ্য সেক্টরের উদ্যমী এই নেতা। তার একান্ত চেষ্টাতেই বিডিএস কোর্স ৪ বছরের স্থলে ৫ বছরে উন্নীত হয়। তিনি ৬টি মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেগুলোতে এখন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে।


সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে নিজের অফিসে বিবার্তা২৪.নেটের সাথে কথা বলেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল। দীর্ঘ আলাপে জানালেন বাংলাদেশের ডেন্টাল স্বাস্থ্যসেক্টরের শুরু কথা, অতীতে কি হয়েছে, বর্তমানে কেমন চলছে, ডেন্টাল শিক্ষা, চিকিৎসাখাতে অবকাঠামোগত সমস্যা ও সমাধানসহ নানান বিষয়। দীর্ঘ আলাপের বিষয়গুলো বিবার্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।




বিবার্তা : বাংলাদেশে ডেন্টাল চিকিৎসার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল:
১৯৬১ সালে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে যাত্রা শুরু হয় ডেন্টাল প্রফেশনের। এটা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের ঘটনা। সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমির মর্গের উপরে ছোট একটি কক্ষে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই প্রফেশনটির। স্বাধীনতার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোরে এটি স্থানান্তরিত হয়। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল সেখান থেকে এটাকে যেনো একটা পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাসসহ ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু যখন দেশে স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, বিশেষ করে ছাত্রদের ১১ দফার দাবির যে আন্দোলন ছিল, সেই দাবির একটা ছিল দেশে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা। তখন থেকে পর্যায়ক্রমে আমাদের দাবি আর সরকারি উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকা মিরপুর ১৪ নম্বরে বর্তমান কলেজটির জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে মিরপুরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এটি ক্যাম্পাসসহ পূর্ণাঙ্গ একটা ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিডিএস ডিগ্রি অর্জনের সেরা প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম ডেন্টাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ডেন্টাল কলেজ। এটা বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ডেন্টাল কলেজ যেটি ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে নামকরা ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম।


বিবার্তা : ডেন্টাল চিকিৎসা সেবা খাতের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল:
১৯৬১ সালে ডেন্টিস্ট্রি পেশার যাত্রা শুরু হয় ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে ডেন্টাল চিকিৎসা পেশা হিসেবে অনেকটা অবহেলিত ছিলো। তবে এখন স্বাস্থ্যবান্ধব সরকারে কল্যাণে এ পেশাটি একটি ভাল অবস্থানে পৌঁছেছে। শুরুতে বিডিএস কোর্সটি ছিলো চার বছরের। ফলে বাংলাদেশ থেকে এই কোর্স শেষ করে উন্নতবিশ্বে উচ্চশিক্ষার জন্য গেলে তেমন সুযোগ পাওয়া যেতো না। যে কারণে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটু অবহেলিত ছিলাম। বর্তমানে বিডিএস কোর্সটি ৫ বছর মেয়াদী করা হয়েছে। ফলে আমাদের দেশের ডেন্টাল সার্জনরা এখন বিশ্বমানের। আমাদের দেশে এখন সুলভ মূল্যে ডেন্টাল সম্পর্কিত সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমনকি উন্নত বিশ্বে উদ্ভাবিত যেকোনো ডেন্টাল পদ্ধতি খুব সহজেই আমাদের দেশে এখন চলে আসছে। আমাদের দেশের ডেন্টিস্টরা নিজ উদ্যোগে দেশের বাইরে গিয়ে ট্রেনিং করছেন, উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসছেন। ১০ বছর আগেও আমাদের দেশে একটি ধারণা ছিল, দাঁতের সমস্যা মানেই দাঁত ফেলে দেওয়া। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসাসেবা দেয়ার ফলে এখন সে ধারণা বদলে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখন দাঁত ফেলে দেওয়ার চিকিৎসাটি আর নেই। একমাত্র আক্কেল দাঁত ছাড়া মুখের সব দাঁতই আগের অবস্থাতেই রাখা যায়। এ ধরনের সব চিকিৎসা এবং চিকিৎসার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমাদের দেশে আছে।




বিবার্তা : আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশী ডেন্টিস্টদের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাই?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল:
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের ডেন্টাল শিক্ষায়, চিকিৎসা অবকাঠামোগতভাবে, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ছিল। সময়ের বিবর্তনে সেসব উতরে গিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ডেন্টাল শিক্ষা পদ্ধতি ও চিকিৎসার ধরনের বদল হয়েছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ডেন্টাল চিকিৎসা পদ্ধতিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। যোগ্যতায় ও দক্ষতায় সব দিক থেকে দেশের ডেন্টিস্টদের উন্নতি হয়েছে। আর সে কারণেই বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ডেন্টিস্টদের অবস্থান অনেক ভাল। দেশের ডেন্টিস্টরা চিকিৎসাসেবায়ও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছেন। গত তিন-চার বছরে আমাদের সক্ষমতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে বর্হিবিশ্বের কাছে বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছি। আমাদের কাজ ও অবস্থান সম্পর্কে তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছি।


বিবার্তা : দেশে ডেন্টাল চিকিৎসার খরচ বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল:
দেখুন, একটি কথা সবাইকে বিশেষভাবে বলাটা জরুরি। সেটি হলো, ডেন্টাল চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রতিটি যন্ত্রপাতি এখনও আমাদের দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। আমরা সব সময় চেষ্টা করি দেশের মানুষের অবস্থা বুঝে যতটা সম্ভব কম পয়সায় চিকিৎসা দেয়ার। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। ইন্টারনেটে ঢুকলেই মানুষ দেখতে পারে আশপাশের দেশে এ ধরনের চিকিৎসায় কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়ে থাকে। আপনি একটু খেয়াল করলেই একটা বিষয় দেখবেন, সেটি হলো, আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার কারণে সে সেবাটি নেওয়ার জন্য এখন শুধু প্রবাসীরা নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে ভিনদেশি মানুষরাও বাংলাদেশে আসছেন। তারপরও দেশের মানুষের কাছে ডেন্টাল চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল বলে মনে হলেও আমি বলব, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা খুব অল্প খরচে বিশ্বমানের ডেন্টাল চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে বেসরকারি মেডিকেলের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালেও এখন অত্যাধুনিক ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারছে।


বিবার্তা : গ্রামাঞ্চলে যারা ডেন্টাল ডাক্তারের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা কী আসলে ডাক্তার?
ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল :
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী একটা প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট বা বিএমডিসি আইন, ২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশে শুধু এমবিবিএস এবং বিডিএস ডিগ্রিধারীরাই নিজেদের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। পদবি হিসেবে ডাক্তার লিখতে পারেন। অন্য কেউ নয়। বাংলাদেশে সাড়ে ১২ হাজার গ্র্যাজুয়েট ডেন্টিস্ট রয়েছেন। এর বাইরে শহর ও গ্রামাঞ্চলে লক্ষাধিক ‘কোয়াক’ বা অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত হাতুড়ে চিকিৎসক রয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের ডিপ্লোমাধারী বা নানা ধরনের সনদ নিয়ে অবৈধ প্র্যাকটিস করেন যারা, তারাই মূলত ‘কোয়াক’। এরা চিকিৎসার নামে মূলত অপচিকিৎসা দিচ্ছেন। মানুষও বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। এটা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়।


সারা পৃথিবীতেই ডেন্টাল সার্জারিতে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনকারীরাই ডেন্টিস্ট হিসেবে সম্মানিত। এই ডিগ্রিটি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন নামে দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ডেন্টাল সার্জারিতে একই নামে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি দিয়ে থাকে, যাকে বলে ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস)। বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়েছে যে, ‘এমবিবিএস এবং বিডিএস বাদে কেউ ডাক্তার নন’। এর ফলে এই কোয়াকরা এখন আর ডাক্তার লেখেন না। তবে হালে তারা নামের আগে ডেন্টিস্ট পরিচয় দিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন। ‘কোয়াকরা’ আসলে ডেন্টিস্ট না। এটা একটা ডেন্টাল চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও অপকৌশল। তারা জানে দেশের মানুষ অসচেতন, ডাক্তারদের ডিগ্রি সম্পর্কে জানেন না। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ও ধোকা দিতে এই উপায়টা অবলম্বন করে। ঠিক তখনই জনগণকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রচারণা শুরু করি যে, ‘বিডিএস নয়, তো ডেন্টিস্ট নয়’। দীর্ঘ দিন ধরে এই প্রচারণা চালানো হয়। মানুষও এখন অনেকটা বুঝতে পারে যে যারা বিডিএস নয় তারা ‘কোয়াক’।


বিবার্তা : কোয়াক বা হাতুড়ে ডাক্তার কারা? তাদের চিনবো কীভাবে?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
কোয়াকরা তো সাধারণ কথায় অবৈধ প্র্যাকটিশনার । ধরেন, অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বাপে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে শিক্ষা পেয়েছেন, কেউ টেকনিশিয়ান, কেউ ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান, কেউ বিএসসি টেকনিশিয়ান, যারা নিজেদের ডেন্টিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, কোয়াকরা অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা দেন, কারণ তারা শিক্ষিত না, জানেন না। হাফ ডান চিকিৎসা দেন। এই চিকিৎসায় আপাতত হয়তো সমস্যার মুক্তি মিলে। যেমন, আপনি কোন ব্যথার জন্য কোয়াকের কাছে গেলেন, সেখান থেকে কোন পেইন কিলার দিলো বা তার জানা মতে কোন ইন্টারভেনশন করলেন। তাতে আপনি তাৎক্ষণিক ওই ব্যথা মুক্ত হলেন। কিন্তু আপনি চূড়ান্তভাবে ভয়াবহ এবং দীর্ঘ মেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হলেন। হয়তো বলবেন, কেন বা কীভাবে? দেখেন, প্রথমত, তার ডেন্টাল চিকিৎসা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়ত, ভুল চিকিৎসার ফলে অথবা আনস্টেরিলাইজড ইন্স্ট্রুমেন্ট ব্যবহারের ফলে এইডস বা অন্য কোন ভাইরাস সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এসব জায়গায় তারা জটিল বিষয়গুলো সহজে বুঝেন না বা জানেন না। ফলে অনেকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরো ঝুঁকিতে পড়ে যান।


বিবার্তা : কোয়াকদের অপচিকিৎসার ফল কেমন হতে পারে সে বিষয়ে একটু যদি ধারণা দিতেন. . .
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
কোয়াকের অপচিকিৎসার ফল যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটার কিছু তথ্য আপনাকে দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের ওরাল সার্জারি বিভাগ, বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে যে ওরাল সার্জারি বিভাগ আছে, করপোরেট হাসপাতালগুলো, বেসরকারি মেডিকেল হাসপাতালগুলোর ওরাল সার্জারি বিভাগ সবগুলো হাসপাতালেই মুখের ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সাউথ এশিয়ায় এখন মুখের ক্যান্সার একটা জটিল রুপ ধারণ করেছে। আর এ উপমহাদেশে এর প্রকোপ খুব বেশি। বাংলাদেশেও এ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মুখের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ রোগীই কোয়াকের অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা কোয়াকের কাছে অর্ধেক চিকিৎসা নিয়েছেন। পরে আর খেয়াল করেননি। আস্তে আস্তে সংক্রমিত হতে হতে একটা সময় সেটি ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে। সুতরাং জনগণকে কোয়াকের অপচিকিৎসার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।



বিবার্তা : এই কোয়াক প্র্যাকটিস বন্ধ করার কোন উপায় আছে কী?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
এই কোয়াক প্র্যাকটিস নিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমাদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই বিএমডিসিকে দিয়ে চেষ্টা করছি তাদের আইনের যে প্রয়োগ সেটা যাতে ঠিক মতো হয়। আর আইনটা তারা কার্যকর করলেই কোয়াক প্র্যাকটিস এমনিতে বন্ধ হয়ে যাবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিএমডিসির সাথে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। বিএমডিসিও তার সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি যে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে সারাদেশের সিভিল সার্জনদের হাতে। প্রতি জেলায় স্বাস্থ্যসেক্টরে যে সিভিল সার্জন আছেন তারা চাইলেই বিষয়টা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কেননা তাদের নাকের ডগা দিয়েই কোয়াকরা প্র্যাকটিস করে যান। এ ক্ষেত্রে তারা যদি দায়িত্বশীল হন, তাহলেই কোয়াকরা আর প্র্যাকটিস করার সাহস পাবে না। আমরা সে জায়গাটায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।


আমরা জেনেছি যে, এই কোয়াকরা কোথাও কোথাও প্রশাসনকে অবৈধভাবে ম্যানেজ করে চোখের সামনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এটা যেমন আইনীভাবে নিষিদ্ধ, তেমনি এটা আদালতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে আদালতে গিয়েছি এবং বিষয়টা নিয়ে লড়েছি। আদালত কোয়াকদের প্রাকটিসের কোন অনুমোদন দেয় নাই। এছাড়াও অন্যান্য জনসচেতনতামূলক সোশ্যাল মুভমেন্ট পরিচালনা করছি। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া, আইপি টিভিসহ স্যাটেলাইট টিভিতে ব্যাপকভাবে প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সেগুলোতে ‘বিডিএস নয় তো ডেন্টিস্ট নয়’ বিষয়টাতে বেশি জোর দিচ্ছি। মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। মানুষ যাতে কোয়াকের অপচিকিৎসা থেকে মুক্ত হতে পারে। তবুও কোনো ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার আগে জেনে নেয়া ভাল যে, ওই ডাক্তারের সত্যিকার অর্থে বিডিএস ডিগ্রি রয়েছে কিনা।


বিবার্তা : দেশে ডেন্টাল শিক্ষা-চিকিৎসা নিয়ে গবেষণার কোন প্রতিষ্ঠান আছে কী? আর এ সেক্টর নিয়ে গবেষণার গুরুত্ব কতটুকু রয়েছে বলে মনে করেন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
দেখুন, আমাদের দেশে ডেন্টাল শিক্ষা ও চিকিৎসা আছে, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় যে এ সেক্টর নিয়ে তেমন কোনো গবেষণার ব্যবস্থা নেই। ডেন্টাল শিক্ষা ও চিকিৎসা সেক্টরে কোন কার্যকর গবেষণা আছে বলে আমার জানা নেই। এই সেক্টরের গবেষণার বিষয়টি আমরা দীর্ঘ দিন ধরে চিন্তা করছিলাম। আমার ব্যক্তিগত অনুভবে মনে হয়েছে এই সেক্টরে পেশাদারি শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে এবং দেশে ডেন্টাল শিক্ষা ও চিকিৎসায় পেশাদারিত্ব আনতে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। একটা পেশার ভাল-মন্দ, নতুনত্ব, উদ্ভাবন, চমৎকারিত্ব, পেশাদারিত্ব এসব বিষয়গুলো উঠে আসে গবেষণার মাধ্যমে। এই গবেষণার দরজা খুলতে গেলে একটা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আর সেটা নিয়ে পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই অনেকদূর এগিয়েছে। তবে আমাদের শিক্ষার্থীরা, চিকিৎসকরা তাদের অ্যাকাডেমিক প্রয়োজনে কোথাও কোথাও কোন রিসার্চের সাথে সম্পৃক্ত হলে সেটি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। একেবারে প্রফেশনালি সিডিউল ওয়াইজ কোন গবেষণা হচ্ছে এমন বিষয় আমার জানা নেই। সেজন্যই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তাটা খুবই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।


বিবার্তা : সরকারিভাবে সারাদেশে ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ নিয়ে একটা অসন্তোষ ছিল, বিষয়টা যদি একটু বলতেন. . .
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
দেশে মহামারি করোনার আঘাত হানার আগেই ৩৯তম স্পেশাল বিসিএস-এ আড়াই শ’ ডেন্টাল সার্জনের একসাথে নিয়োগ হয়েছে। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল এক সাথে ৫০০ জন ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের। বাকি আড়াই শ’র নিয়োগ এখন পর্যন্ত হয় নাই। করোনাকালে সরকারিভাবে হাজার হাজার চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ দেয়া হলো, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত আমাদের বাকি আড়াই শ’ ডেন্টাল সার্জনের নিয়োগটা আসেনি। তবে এ বিষয়ে আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় বরাবরই চেষ্টা করেছিলেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুরাল এবং কলেজ অডিটোরিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে যখন আমাদের এখানে (ঢাকা ডেন্টাল কলেজে) আসেন তখন তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, আপনারা সত্যিই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিষয়টা বিবেচনা করে আগামী দিনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। এখন আমরা সে অপেক্ষায় আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলা আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে আমাদের যেসকল বেকার ডেন্টাল সার্জন আছেন তারা আশা করছেন যে, সামনে বড় ধরনের একটা নিয়োগ হবে।


বিবার্তা : ডেন্টাল স্বাস্থ্যখাতের অর্জন নিয়ে কিছু বলুন।
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
আমাদের সরকার স্বাস্থ্যবান্ধব সরকার। ২০০৯ সাল থাকে আজ পর্যন্ত আমাদের এমডিজিতে অর্জনের মেক্সিমামই স্বাস্থ্যখাতের অর্জন। সেসাথে এই মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাবিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। মূলত স্বাস্থ্যখাতের অর্জনগুলোই বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছে। এমডিজিকে সাসটেইনেবল করার জন্য এসডিজির (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) যে গন্তব্য সে জায়গাটাতেও কিন্তু স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে আছে। আশার কথা হলো, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে আগের থেকে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। একইসাথে প্যারালালি আমরাও শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে থেকে নিজেদের অনেক উন্নত করেছি। এই জায়গাটাতে আমাদের ইউনিট, পদ সংখ্যা, ডেন্টাল কলেজও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই তো গত ১৫ দিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিটকে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজে পরিণত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।


গোপালগঞ্জে লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। খুলনা ডেন্টাল কলেজের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা অনেক বড় বড় কাজ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কলেজগুলোকে নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, নতুন কলেজগুলো হবে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে সারাদেশের মেডিকেল কলেজের ইউনিটগুলোকে কলেজে পরিণত করার যে আবেদন আমরা করেছি, মন্ত্রণালয় সেটিও ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। আশা করছি, শিগগিরই পর্যায়ক্রমে এই কাজগুলো শুরু হবে।(চলবে)


বিবার্তা/গমেজ/শাহিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com