শিরোনাম
মুক্তিযোদ্ধাদের কান্না শোনার কেউ নেই (২য় পর্ব)
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২১, ২২:০৫
মুক্তিযোদ্ধাদের কান্না শোনার কেউ নেই (২য় পর্ব)
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাঙালি। বাঙালি পেল স্বাধীন দেশ ও লাল সবুজের পতাকা। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন হলেন নয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ। প্রথমে নয় নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডার। পরে তাকে শমশেরনগর সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। নয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করেন। এছাড়া বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এই যোদ্ধা। তার নেতৃত্বে রাজধানীর মিরপুরও মুক্ত হয়।


মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ। তার বাবার নাম প্রফেসার হোসাম উদ্দিন। তিনি বরিশাল বিএম কলেজের নামকরা প্রফেসার ছিলেন। বেগের মায়ের নাম মর্জিনা বেগম। তাদের পৈতৃক বাড়ি ভারতের মালদহ হলেও ১৯২০ সাল থেকেই বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ৭ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে বেগ পঞ্চম। তার বড় ভাই মাহমুদ আলম বেগ ছিলেন ব্যাংকার। আর মেজ ভাই মনজুরুল আলম বেগ একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার।


বীর এই মুক্তিযোদ্ধা আজ আসহায়ভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারি দায়িত্বশীল পদে থেকেও নিজের নীতি আদর্শ এবং সততার কারণে আজ নিজের কোনো বাড়ি নেই তার। সাব সেক্টর কমান্ডার হয়েও পাননি কোনো সরকারি প্লট। দুইবার আবেদন করেও জুটেনি কোনো সরকারি প্লট। থাকছেন ভাড়া করা বাসাতে। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি শোষণ-নির্যাতন, অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেছেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধার টিম গঠন করেছেন। শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করে শত্রুমুক্ত করেছেন কয়েকটা জেলা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার মনের মধ্যে আজ হতাশা আর কষ্টই নিত্যসঙ্গী। এসব পরিস্থিতি সম্পর্কে বলার মতো এখন মানুষের বড়ই অভাব। মুক্তিযোদ্ধাদের কান্না শোনার কেউ নেই। কে শুনবে তাদের কান্না?


সম্প্রতি সাভার পুলিশ টাউনে নিজে ভাড়া বাসাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. মাহফুজ আলম বেগের সাথে আলাপকালে এসব কথা উঠে আসে। বিবার্তা২৪-এর সেই সাথে একান্ত আলাপে জানা গেল তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অজানা সব ঘটনার কথা। পাঠকদের উদ্দেশে সেই গল্পগুলো এখানে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।


যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য।


বিবার্তা : যত দূর জেনেছি ঢাকা মিরপুর মুক্ত হওয়ার পেছনে আপনার বিশেষ ভূমিকা ছিল।


মাহফুজ আলম বেগ :হ্যাঁ, ঠিকই জেনেছেন। আমি বরিশাল থেকে ঢাকায় ফিরলে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বললেন, পুরো বাংলাদেশএখন মুক্ত কিন্তু মিরপুর এখনো মুক্ত না। এখন মিরপুর মুক্ত করতে হবে। নাসির সাহেব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাই। নাসির সাহেব ও শেখ কামাল সব সময় আমাদের যুদ্ধের ময়দানে আসতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলেও বেশ কিছু দিন আমাদের ক্যাম্পে ছিলেন। যুদ্ধের সব কিছু দেখতেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন এখন কি করা যায়? আমি বললাম লিডার আমি তো আমার সব অস্ত্র জমা দিয়েছি। এর আগে আমরা ঢাকায় ফিরে ইউনিভাসিটির জিমনেসিয়ামে উঠেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কাছে তো এতো বেশি লোক নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই আমরা তখনকার সময়ে ইন্ডিয়ান আর্মিদের প্রধানের কাছে আর্মসগুলো সারেন্ডার করলাম। তখন বঙ্গবন্ধু দায়িত্বে থাকা ওই ইন্ডিয়ান আর্মিদের প্রধানকে আর্মস দেয়ার কথা বললে জানালেন জমা দেয়া আর্মস ইন্ডিয়ার সরকারের অনুমতি ছাড়া রিইস্যু করা যাবে না। তখন বঙ্গবন্ধু হটলাইনে ইন্দ্রিরা গান্ধির সাথে কথা বললেন এবং অনুমতি নিয়ে আর্মসের রিইস্যু করা হলো। আমরা সেই আর্মস নিয়ে মিরপুরে অপারেশনে যাই। বঙ্গবন্ধু বললেন শফিউল্লাহর নেতৃত্বে একটা ইউনিট তৈরি হবে। তখন আমি বললাম, লিডার এতদিন নিজে যুদ্ধে কমন্ডার হিসেবে যুদ্ধ কিরে আসছি এখন আর কারো নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে চাই না। আমার কথায় তখন বঙ্গবন্ধু একমত হয়ে অনুমতি দেন। শফিউল্লাহ সাহেব তার গ্রুপ নিয়ে এক দিকে মিরপুরে যান। আমিও আমার গ্রুপ নিয়ে এক দিক দিয়ে যাই। আমার গ্রুপে ইউনিভারসিটির ভলেন্টিয়াররাও ছিলেন। ইন্ডিয়ান আর্মিরা আসল। তাদের সাথে আমরা প্রাণপণে যুদ্ধ করেছি। ১৫৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এক সাথে আক্রমণ করেছি। রক্তে রঞ্জিত হলো মিরপুরের মাটি। আর মুক্ত হলো মিরপুর। পরে ফিরে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি খুব খুশি হলেন। বললাম এখন কি করবো লিডার? ওয়াবদার পরিচালক পদে জয়েন করতে বলেন। জয়েন করি।


বিবার্তা : আপনাদের যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে জানতে চাই।


মাহফুজ আলম বেগ : আমাদের যদ্ধের কৌশল ছিল হিট অ্যান্ড রান। আমি গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করেছি। গেরিলা ইউনিটগুলোকে কমান্ড করতাম। সব সময়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট কালেক্ট করতাম।কোথায়, কখন আর্মিরা মুভ করছে। সে অনুসারে হামলা করাতাম। কোথাও রেইড, কোথাও অ্যাম্বুশ, কোনো কোনো বিওপি দখল করতাম। একটা মজার বিষয় ছিল আমরা যদি এক গুলি ফায়ার করতাম তখন পাকিস্তানিরা ১ হাজার গুলি ফায়ার করতো। একটা ব্রাশফায়ার করে হয় তো চুপ করে খাওয়া-দাওয়া করতেছি। তখন তারা বুলেট বৃষ্টি ঝরাতে থাকতো। তখন আমরা এই বিষয়টা খুব এনজয় করতাম। যত অপারেশন হয়েছে সেগুলো আমি, ক্যাপ্টেন নরুল হুদা, মেজর জলিল আর ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের অফিসাররা প্ল্যান করতাম। আরো কয়েকজন যাদের নামগুলো আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই, লে. কামাল, লে. এহসান, লে. ফিরোজ, লে. আলী, লে. সচীন, লে. মেহেদী, লে. জিয়া, লে. শাহজাহান অমর, সার্জেন্ট ফজলুল হক সাহেব, আলতাফ সাহেব (মৃত), ডা. অরুন (মৃত), মোস্তাফা সাহেব, ডা. জেনারেল শাহজাহান সাহেবসহ আরো অনেকে ছিলেন যাদের নাম এখন মনে করতে পারছি না।


আমাদের যুদ্ধের আরেকটা কৌশল ছিল ছোটদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা। ছোটদের নিয়ে একটা গ্রুপও করেছিলাম। তাদের বয়স ১১-১৪ বছরের মতো। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল ৪০ এর মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস’। আসলে ওরা বিচ্ছুবাহিনী। ওদের এসএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের ওপর ট্রেনিং দেওয়া হয়। নৌকা চালানোর ওপর ছিল বিশেষ ট্রেনিং। তাদের মেইন কাজ ছিল অ্যামুনেশন ক্যারি, ইন্টিলিজেন্সের কাজ করা। ওরা গল্প বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতো। পরে আর্মি ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কি আছে। তাদের কাজে ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে ট্রেইন্ড মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না। সেখানে ওরা বলত স্যার আমি যাব।


অবসর সময়ে নৌকায় মুক্তিযোদ্ধারা।


বিবার্তা : কেমন ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ করার দিনগুলো?


মাহফুজ আলম বেগ : মেজর জলিল একবার প্ল্যান করলেন পাকিস্তানি গানবোটকে কাউন্টার দিতে হবে। গানবোটে ৪০ মিলিমিটার বাফার থাকে। ইপিআরের স্টিল বডি লঞ্চ ছিল তখন। বিগ্রেডিয়ার সালেক ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের কমান্ডার। তাকে রিকোয়েস্ট করে আনা হয় হেভি মেশিনগান। সেগুলো লঞ্চে ফিট করে গানবোট বানানো হয়। বঙ্গ বজ্র নামের দুটি লঞ্চকেই গানবোট হিসেবে ব্যবহার করতাম আমরা। প্রথম নেভি বলতে গেলে নয় নম্বর সেক্টরেই শুরু হয়। নেভির লেফটেন্যান্ট গাজী, লেফটেন্যান্ট আলম ছিলেন। তাদেরকে দিয়েই নৌ অপারেশনগুলো প্ল্যান করা হতো।


বঙ্গ বজ্র নামের এই লঞ্চ দুটি নয় নম্বর সেক্টরের গানবোট হিসেবে ব্যবহৃত হয় বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে সেখানে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। আমাদের পুরো ব্যাটেলিয়ান ঘিরে ফেলে ওদের। পাকিস্তান আর্মি ছাড়া ওরা সারেন্ডার করবে না। পরে তারা অস্ত্র ফেলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। দোয়ারিকা থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওয়াবদায়। পাকিস্তান আর্মি মাথা নিচু করে ওয়াবদার দিকে মার্চ করছে। আর অস্ত্র উচিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে ছেড়া শার্ট আর ছেড়া লুঙ্গি পড়া মুক্তিযোদ্ধারা। এই দৃশ্যটা কখনও ভুলতে পারব না। পরে তাদের ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করি।


যখন ইন্ডিয়ান আর্মিদের কাছে তুলে দেন আমাদের সঙ্গে থাকতেন ফটোগ্রাফার খোকন দাস ও মিন্টু দাস। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যুদ্ধকালীন নানা ছবি তুলতেন। মিন্টু দাস এখন বেঁচে নেই। খোকন দাস চলে গেছেন ভারতে। কিন্তু তাদের তোলা ওই ছবিগুলোই এখন মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল। পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলে বরিশাল শহর মুখী সড়ক পথগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নৌযানে করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ তাদের দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করতে থাকে। পাক বাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে দীর্ঘ আট মাস অবরুদ্ধ থাকা মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে ‘জয়বাংলা’স্লোগান দিয়ে দলে-দলে রাস্তায় নেমে আসে।নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড ওয়াপদা কলোনীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের স্থায়ী ক্যাম্পে লুকিয়ে থাকা পাক সেনা ও তাদের দোসররা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মনজুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান মাস্টার ও আমিসহ বেশ কয়েজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে আত্মসমর্পণ করে।


বিবার্তা : কঠিন সময়গুলোতে কখনও কি ভেঙ্গে পড়েছিলেন?


মাহফুজ আলম বেগ :১৯৭৪ সালে পরিচালক হিসেবে যোগ দেই ওয়াবদায়। ১৯৭৫ সালেরর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। আগে থেকেই খন্দকার মোশতাকের ক্ষোভ ছিল আমার প্রতি। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবিত বা মৃত বেগকে চাই।’এরপরই আমাকে খুঁজতে ক্যাপ্টেন মাজেদ আমার আত্মীয় স্বজনের বাসায় রেইড দিতে থাকে। এক পর্যায়ে কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় আমি নেত্রকোণার কাজলা হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাই। দেরাদুনে আমি ‘মুজিবস আইডোলজিক্যাল ফোর্স’ নামে একটি ফোর্সও গঠন করি। সঙ্গে ছিলেন শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহসহ অনেকেই।


বিবার্তা : এই ফোর্সের উদ্দেশ্য কী ছিল?


মাহফুজ আলম বেগ : দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগঠিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিছু করাই ছিল এই ফোর্সের আসল উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারেরও সহযোগিতা পাই। কিন্তু দেশে ফিরেই অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হতেই হতাশ হই। বড় বড় নেতারাই ধমকের সুরে সেসময় বলেছিল, ‘তুমি আবার আসলে পুলিশে ধরায়া দিমু।’ মোশতাকে কেবিনেটে কারা ছিল বলেন। এরপরই আমি সেমি কট হই। ডিজিএফআই থেকে বলা হলো সারেন্ডার করতে। সারেন্ডার করি। বহু কষ্টে চার বছর পর চাকরি ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু চার বছরের বেনিফিট পাইনি। ওই সময়টা কেটেছে নানা অবহেলা আর আতঙ্কে।



বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পতাকা উড়িয়ে এভাবেই আনন্দ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।


বিবার্তা : মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো আফসোস রয়েছে কী?


মাহফুজ আলম বেগ : ওয়াবদার পরিচালক হিসেবে সততার সঙ্গেই চাকরি জীবন শেষ করেছি। অনেক সুযোগ ছিল কিন্তু কোনো দিন ঘুষ নিইনি। আজ যদি ঘুষ নিতাম বা যে কোনো অসৎ পথ অবলম্বর করতাম তাহলে আজ ঢাকায় নিজের একটা বাড়ি থাকতো, গাড়ি থাকতো। সাব সেক্টর কমান্ডার হয়েও পাইনি কোনো সরকারি প্লট। দুইবার আবেদন করেও কপালে জুটেনি কোন সরকারি প্লট। থাকি ভাড়া করা বাসাতে। দীর্ঘদিন রাজধানীর উত্তরাতে থাকার পর পাঁচ বছর হয় সাভার পুলিশ টাউনে ১৩ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকি। থাকা, খাওয়া, চলা-ফেরা, চিকৎসার খরচ অনেক বেশি। বলা বেঁচে আছি অনেকটা অবহেলায়। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতও পাই না। আমার মতো যারা দেশকে ভালোবেসে দেশপ্রেমিক হয়ে দেশের জন্য জীবন বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সরকারের উচিত এই অসহায় মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের অন্তত ভালো মতো বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করার। আমরা যারা দেশের জন্য মাঠে থেকে সংগ্রাম করেছি আমাদেরও ভালো মতো জীবন-যাপন করার অধিকার আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনের মধ্যে যে কষ্ট আছে সেটা বলার মতো এখন মানুষের বড়ই অভাব। মুক্তিযোদ্ধাদের কান্না শোনার কেউ নেই। কে শুনবে আমাদের কান্না?


আনেকটা বিষয় খুবই দুঃখজনক সেটা হলো আমাদের দেশে আমরা যারা যুদ্ধের ময়দানে বীরের মতো যুদ্ধ করেছি আমাদের বয়স কিন্তু সবার গড়ে ৬০ বা ৬৫ বছর। দেখলেই বোঝা যায় মাথায় চুল আর মুখের দাড়ি পাক ধরেছে। কারো কারো মাথার চুল পুরোটাই সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বিভিন্ন ইস্যুতে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটা মিটিংয়ে গিয়েছি। আলোচনা সভায় কথা বলার সময় লক্ষ্য করেছি আমাদের মতো বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের কথার মাঝে থামিয়ে দিয়েছেন কম বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধারা। সবার সামনে বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের বলতে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আপনি কী জানেন? চুপ করে বসে থাকেন। বিষয়টা আমার মনে কষ্ট দিয়েছে। যারা যুদ্ধের ময়দারে বীরের মতো যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছেন, বিভিন্ন জেলা মুক্ত করেছেন তাদেরকে কিনা বলা হচ্ছে আপনি মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে জানেন না। বিষয়টা খুবেই দুঃখজনক।


বিবার্তা : মুক্তির দিনটি কেমন ছিল?


মাহফুজ আলম বেগ : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ পাকহানাদার বাহিনীর কবল মুক্ত হয়। বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি দেশের এক-একটা এলাকায় ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছিলো। দেশবাসীর মধ্যে বিজয়ের উচ্ছ্বাস-আনন্দ, প্রিয়জনের ফিরে আসার প্রতীক্ষা, ধ্বংসস্তুপ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর স্বজন হরানোর শোকের ভেতরও এক পুলকিত স্বস্থির আবহ বিরাজ করেছিলো সেই দিনটিতে। এদিন থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মহামিলন ঘটতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা ভুলে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তুলে শহর। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানায় মানুষ। নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। স্থানীয় ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার উপস্থিতিতে উঠানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।


বিবার্তা : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কোন ব্যক্তির অবদানের কথা বেশি মনে পড়ে?


মাহফুজ আলম বেগ : আমি কয়েকজন ব্যক্তি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই তারা হলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা শেখ সেলিম সাহেব, বঙ্গবন্ধুর ভাই নাসির সাহেব, কামাল সাহেব এই তিন জন ব্যক্তি যুদ্ধের ময়দানে যেতে কোন দিন ভয় পাননি। সব সময় আমাদের পাশে ছিলেন যুদ্ধে পরিকল্পনা দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে। জামাল সাহেব তিনিও আমাদের সাথে বেশি কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আমাদের মধ্যে অনেকে হয়তো বলবে আমরা যুদ্ধের সময় ভাল ভাল হোটেলে খেয়েছি, থেকেছি। আমি যুদ্ধের সময় দেখেছি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আত্মীয়-স্বজনরা যুদ্ধের সময় মানুষের পাশে কীভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। কতভাবে সাহায্য করেছেন। আবুল হাসনাদ যুদ্ধের সময় উনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। আমার দুই ভাগিনা ছিল। তারা খুবই অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠেছিল। হুমায়ুন কাদের চেীধুরি ও কুমার মোর্শেদ। তারা আমাকে বলল মামা, তুমি দেশের জন্য যুদ্ধ করবা আর আমরা তা চেয়ে চেয়ে দেখবো। তা হতে পারে না। আমরাও তোমার সাথে যুদ্ধ করবো। আর সেটাই করেছে। বরিশাল নাইন সেক্টর ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধে আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে। ওই সময় একজন যুবক মারাত্মভাবে আহত হলে যে রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল আমার ভাগিনা হুমায়ুন কাদের চেীধুরি তার রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল।



লঞ্চে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।


বিবার্তা : মুক্তিযুদ্ধে আপনি কি হারিয়েছেন এবং কি পেয়েছেন?


মাহফুজ আলম বেগ : দেখুন কিছু পেতে গেলে তো কিছু হারাতে তো হবেই। এটাই জগতের নিয়ম। আমি দেশকে ভালোবাসি। দেশের জন্য জীবন দিতেও কোন দ্বিধা নেই। যুদ্ধ করেছি অপশক্তির হাত থেকে দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য। যুদ্ধের ময়দানে অনেক কঠিন পরিক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেক কঠিন পথ পেরোতে হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ ও যুদ্ধাহতদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ের বাংলার মাটি হয়েছে অপশক্তি মুক্ত। পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র। তাই আমাদের দেশের মানচিত্র রক্তের মানচিত্র, ৩০ লাখ শহীদের মানচিত্র৷ এটাই পরম পাওয়া, তৃপ্তির জায়গা৷ এছাড়াও পাকিস্তান আমলে ভাঙাচোরা একটা কর্নেল ছিল আমাদের। তাই নিয়েই গর্ব করতাম। এখন বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামে একজন সেক্রেটারি আছে। আমার নিজের একটা পতাকা আছে। আছে একটা মানচিত্র, একটা ভাষা। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!


বিবার্তা : সরকারের কাছ থেকে কী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন?


মাহফুজ আলম বেগ : সরকারের কাছ থেকে আমরা মাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছিা না। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা জন্য যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা একটা নতুন মাইলফলক হিসেবে আমি মনে করি। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যারা না খেয়ে মারা যেতো তাদের বাঁচার ঠিকানা করে দিয়েছেন। কেননা শতকরা ৮০% মুক্তিযোদ্ধাদের না আছে জমি না আছে ঘর-বাড়ি। তারা সরকারি যে অনুদান পাচ্ছে তা দিয়েই কোন রকমের খেয়ে পরে বেঁচে আছে। মনে হচ্ছে আগামীতে তাদের অবস্থা আরো ভাল হবে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।


বিবার্তা : কোন ঘটনাটির কথা আপনার বেশি মনে পড়ে?


মাহফুজ আলম বেগ : মেজর জলিল অসাধারণ সব যুদ্ধের প্ল্যান করতেন। কিন্তু কোনো একটা বিষয়ে উনি নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন না। যেদিন জাসদে জয়েন করলেন, সেদিন সন্ধ্যায় মেজর জলিলকে নিয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায়। বঙ্গবন্ধু দেখেই তার সহধর্মিণীকে ডেকে বললেন, ‘দেখ,মাহফুজ আলম বেগ জলিলকে নিয়ে আসছে। মিষ্টি মুখ করাও ওদের।’ উনি কালোজাম নিয়ে আসলেন। জলিলকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোর ওপর অবিচার হয়েছে জানি। সব তথ্য আমার কাছে আছে। আমি খুব শিগগিরই তোকে একটা যোগ্য জায়গায় বসাব। কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। মেজর জলিল বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়ে আসলেন।


সেখান থেকে বের হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন শাহবাগের এক হোটেলে। একটা রুমে ঢুকতেই দেখি ভাসানী সাহেব শুয়ে আছেন। তিনি ভাসানীর পা ছুয়ে সালাম করে কথা দিলেন ভাসানী ন্যাপে জয়েন করবেন। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি তো বঙ্গবন্ধুকেও বলে আসলেন। আর এখানে এসে বললেন আরেক কথা।’উনি উত্তর দিলেন না। উনাকে পল্টন নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরলাম। সকালে উঠে শুনি জাসদ নামে নতুন পার্টি গঠন করেছে। যার প্রেসিডেন্ট মেজর এম এ জলিল। উনি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু, সন্ধ্যা রাতে ভাসানী ন্যাপ আর মধ্যরাতে হয়ে গেলেন জাসদ। এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি।


বিবার্তা : বর্তমান সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কেমন?


বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ এর সাথে বিবার্তা প্রতিবেদক উজ্জ্বল গমেজ ও খলিলুর রহমান।


মাহফুজ আলম বেগ : বঙ্গবন্ধু সিংহ হৃদয়ের দয়াপ্রবণ মানুষ ছিলেন। আমি বলব তার মেয়ে বেটার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। অর্থনৈতিকভাবে দেশ উপরের দিকেই যাচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে একটা ভাল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। দেশ পরিচালনায় বাধা বিপত্তি আসবে। তবু শেখ হাসিনা এগিয়ে যাবেন বলে আমার বিশ্বাস। তবে একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝি না সব বিষয়ে কেন প্রাইমিনিস্টারকে নির্দেশ দিতে হয়। তাহলে মন্ত্রীরা কি করেন? একজন মানুষের পক্ষে পুরা দেশ কন্ট্রোল করতে পারা ভেরি ডিফিক্যাল্ট। কোর্ট এখন অনেক বিষয়েই সরাসরি নির্দেশ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। এসব দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।


বিবার্তা : নতুন প্রজন্মের প্রতি আপনার ম্যাসেজ কী থাকবে?


মাহফুজ আলম বেগ : যেদেশে একজন বাবা বেতন পায় ৩০ হাজার টাকা আর ছেলের স্কুলের বেতন দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা। তাহলে ওই বাবা সংসার চালায় কীভাবে ছেলে কী সেটা কখনো জিজ্ঞেস করেছে? ঘুষখোরের পোলা ঘুষখোরই হবে। আর বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের ছেলে-মেয়েরা ড্রাগ আর মোবাইল নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। সবকিছুতে কন্ট্রোল থাকা উচিত, লিমিটেশনও থাকতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বলবো, তোমরা সৎ নাগরিক হও। মাদক থেকে নিজেকে মুক্ত রেখো। বাবা-মাকে ঘুষ না খেতে উদ্বুদ্ধ করো। ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে নিজেকে দূরে রেখো। তবেই তোমাদের হাত ধরে দেশটা সোনার বাংলাদেশ হবে।


বিবার্তা/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com