
সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর তাদের পদগুলোতে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ ঠেকানোর বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে হিজবুল্লাহ। এই অনুপ্রবেশই চিরশত্রু ইসরায়েলকে তাদের অস্ত্র গুদাম ধ্বংস করে দিতে, যোগাযোগ যন্ত্রপাতিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে ও অভিজ্ঞ নেতাদের হত্যা করার সুযোগ করে দিয়েছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে এসব তথ্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়েছিল।
শুক্রবার হিজবুল্লাহর কমান্ড সদরদপ্তরে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে নাসরাল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল। তারা এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহার করা শত শত পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটানোর পাশাপাশি বহু জনকে হত্যা ও বহু যোদ্ধাকে আহত করে সাময়িকভাবে অক্ষম করে দিতে সক্ষম হয়।
এই অনুপ্রবেশ সক্ষমতার ওপর ভর করেই ইসরায়েল হিজবুল্লাহর নেতৃত্বদানকারী পরিষদের অর্ধেক সদস্যকে হত্যা ও তাদের শীর্ষ সামরিক কমান্ডকে ধ্বংস করে দেয়।
নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের আগের দিনগুলোতে ও এর পরের কয়েক ঘণ্টায় রয়টার্স লেবানন, ইসরায়েল, ইরান ও সিরিয়ার বহু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা লেবাননের শক্তিশালী আধাসামরিক শিয়া গোষ্ঠীটির সাপ্লাই চেইন ও কমান্ড গঠনসহ অন্য ক্ষেত্রগুলোতে যে ক্ষতি ইসরায়েল করেছে তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সময় সবাই তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়েছেন।
ইসরায়েলের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত এক কর্মকর্তা নাসরাল্লাহর ওপর আঘাত হানার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে রয়টার্সকে জানান, হিজবুল্লাহর বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে ইসরায়েল ২০ বছর ব্যয় করেছে, তাই যখনই তারা চাইবে গোষ্ঠীটির সদরদপ্তরসহ নাসরাল্লাহর ওপর আঘাত হানতে পারবে।
গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের এই ব্যবস্থাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি; কিন্তু আর বিস্তারিত কিছু জানাননি।
দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীদের চক্র বুধবার নাসরাল্লাহর ওপর হামলার অনুমোদন দেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার জন্য নেতানিয়াহু যখন নিউ ইয়র্কে তখন হামলাটি চালানো হয়।
২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর মাসব্যাপী যুদ্ধের পর থেকে নাসরাল্লাহ আর জনসম্মুখে আসেননি। অনেকদিন ধরেই তিনি সতর্ক জীবনযাপন করছিলেন, তার গতিবিধি সীমিত ছিল এবং যেসব লোকজনের সঙ্গে তার দেখা হত তাদের সংখ্যা খুব কম ছিল বলে নাসরাল্লাহর নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তার ভাষ্য। তিনি বলেন, নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এই অল্প লোকজনের মধ্যেও ইসরায়েলি চরদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
সম্প্রতি নিহত হিজবুল্লাহর এক শীর্ষ কমান্ডারের জানাজায় নাসরাল্লাহর অংশ না নেওয়া ও এরপর আগে থেকে রেকর্ড করা তার ভাষণ প্রচারের কথা উল্লেখ করে হিজবুল্লাহর এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ১৭ সেপ্টেম্বরের পেজার বিস্ফোরণের পর থেকে নাসরাল্লাহ আরও সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন, ইসরায়েল তাকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে এমন আশঙ্কা করছিলেন তিনি।
রয়টার্স জানিয়েছে, এই বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে হিজবুল্লাহর গণমাধ্যম দপ্তর সাড়া দেয়নি।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যায়বিচারের একটি পরিমাপ’ বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, নাসরাল্লাহর নির্দেশে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইরান সমর্থিত লেবাননি গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নিজেদের রক্ষা করার অধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি সমর্থন আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইসরায়েল জানিয়েছে, নাসরাল্লাহর ওপর আঘাত হানতে তারা দক্ষিণ বৈরুতের একটি আবাসিক ভবনের নিচে ভূগর্ভস্থ সদরদপ্তরে বোমা ফেলেছিল।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিজবুল্লাহ বিশেষজ্ঞ মান্নেস রান্সস্তূর্প বলেন, “হিজবুল্লাহর জন্য এটি একটি বিশাল ধাক্কা ও বিরাট গোয়েন্দা ব্যর্থতা। ইসরায়েলিরা জানত তিনি বৈঠক করছেন। তিনি অন্যান্য নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছেন। আর সেই সময়ই তারা তার ওপর হামলা চালায়।”
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, নাসরাল্লাহসহ হিজবুল্লাহর নয়জন সর্বজ্যেষ্ঠ কমান্ডারের মধ্যে আটজনকে তারা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশকে গত সপ্তাহে হত্যা করা হয়েছে। এই কমান্ডাররা হিজবুল্লাহর রকেট ডিভিশন থেকে অভিজাত রাদওয়ান বাহিনীসহ বিভিন্ন ইউনিটকে পরিচালনা করতেন।
শনিবার ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদাভ শোশানি এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, নাসরাল্লাহ ও অন্যান্য নেতা যে বৈঠক করছেন এর ‘সত্যিকার সময়’ নিয়ে ইসরায়েলের পরিষ্কার ধারণা ছিল। হিজবুল্লাহর নেতারা ইসরায়েলে হামলার পরিকল্পনা করতে বৈঠক করছিলেন।
কিন্তু কীভাবে তারা এসব তথ্য জানতে পেরেছেন তা নিয়ে কিছু বলেননি শোশানি।
ইসরায়েলের হাতজেরিম বিমান ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিচাই লেভিন সাংবাদিকদের বলেছেন, লক্ষ্যস্থলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডজন ডজন বোমা ছোড়া হয়।
তিনি বলেন, “অভিযানটি জটিল ছিল আর দীর্ঘ সময় ধরে এটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল।”
হিজবুল্লাহ দ্রুত কমান্ডারের শূন্যস্থান পূরণের সক্ষমতা দেখিয়ে আসছে। নাসরাল্লাহর মামাতো ভাই হাশেম সাফিয়েদ্দিনকে দীর্ঘ দিন ধরে তার উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]