দুদিন ধরে মাথার মধ্যে আসিম জাওয়াদ। বারবার ভাবছি, ১৮ বছর বয়সে আকাশে উড়েছিলেন যে তরুণ, ১৯ বছর বয়সে সেরা পারফরম্যান্সের জন্যে যিনি পেয়েছিলেন গৌরবমণ্ডিত সোর্ড অব অনার, দেশে বিদেশে যার জীবনে যুক্ত হচ্ছিল একের পর এক সাফল্যের পালক, মাত্র ৩২ বছর বয়সে এভাবে কেন তাঁর চলে যাওয়া?
বঙ্গোপসাগরের কাছে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় যেখানে এই যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হলো সেখানেই কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর। আমার বাসার ছাদ থেকে ছোটবেলায় দেখতাম যুদ্ধবিমানের ওঠানামা। ভীষণ মুগ্ধ হতাম! আমার বাসার কাছেই সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমান ঘাঁটির অবস্থান। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় বিমান বাহিনীর সদস্যদের দেখতাম। ভীষণ ভালো লাগতো। আসলে পতেঙ্গা, ১১ নম্বর ঘাট, ১৫ নম্বর ঘাট, সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমান ঘাঁটির প্রতিটি মোড় আমার চেনা। এখানকার সাগরের গন্ধে আমি বড় হয়েছি।
এই দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেও কর্ণফুলীর তীরে চট্রগ্রাম বোট ক্লাবে ছিলাম। সেখানে বিমানবাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন আমাদের প্রোগ্রামে। দুপুরে খেতে বসে আমি তাদের জীবনের দারুণ সব গল্প শুনছিলাম। রাতে ঢাকায় ফিরে সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিমান দুর্ঘটনার ভিডিও আর ছবি দেখে তাই মনটা ভীষণ খারাপ হলো। আর যখন আসিম জাওয়াদের জীবনের গল্প পড়লাম ভীষণ ভালোবাসা জাগলো। মনটাও ভীষণ খারাপ হলো।
১৯৯২ সালের ২০ মার্চ জন্ম আসিমের। আমার ছোট ছেলেটার জন্ম ঠিক এই তারিখে। জাওয়াদ ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই রিফাতের স্বপ্ন ছিল পাইলট হবে, বিমান বাহিনীতে যোগ দেবে। ফলে বুয়েটে ও সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হননি। বরং স্বপ্ন পূরণ করেছে পাইলট হয়ে। আর শেষে বিমান দুর্ঘটনায়ই তার মৃত্যু হলো। চলে গেল পরপারে। মাত্র ৩২ বছরে জীবন থেকে বিদায় নিলেও অর্জনগুলো অনেক। এমনকি মৃত্যুটাও ভীষণ অর্থবহ!
জাওয়াদ ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ২০১১ সালের ডিসেম্বরে কমিশন লাভ করেন। প্রশিক্ষণে সামগ্রিকভাবে সেরা পারফরম্যান্সের জন্যে তিনি পেয়েছেন গৌরবমণ্ডিত সোর্ড অব অনার। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে বিএসসি (অ্যারো) পাস করেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তি মিশনেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাদারী দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘‘মফিজ ট্রফি’’, ‘‘বিমান বাহিনী প্রধান ট্রফি’’ ও বিমান বাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র লাভ করেন জাওয়াদ।
নানা ধরনের বিমান চালানোতে দক্ষ জাওয়াদ বৃহস্পতিবার (৯ মে) সার্জেন্ট জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ নিয়ে আকাশে উড়াল দিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন উইং কমান্ডার সোহান হাসান। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরে বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এরপর বিমানটিতে আগুন ধরে যায়।
চাইলে সাথে সাথেই জীবন বাঁচাতে পারতেন দুই পাইলট। কিন্তু আশেপাশে তিনটি সার কারখানা, তেলের ডিপো, ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ছিল। কাজেই বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বিমানটিকে কর্ণফুলীর মোহনায় নিয়ে যান দুই পাইলট। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আকাশ থেকে বিমানটি কর্ণফুলী নদীতে ছিটকে পড়ছে। এর আগে বিমান থেকে দুই পাইলট প্যারাশুটযোগে ঝাঁপ দেন। পরবর্তীতে নদী থেকে দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় জাওয়াদের।
১৪ বছরের বিমানবাহিনীর গৌরবান্বিত জীবন আর মাত্র ৩২ বছর বয়সে এমন মৃত্যু বেদনার কোন সন্দেহ নেই। তাঁর পরিবারের জন্য এমন শোক সহ্য করা কঠিন। দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমার শুধু অনুরোধ এই ধরনের বিমানে কোন সমস্যা আছে কী না, সেটি খতিয়ে দেখা হোক। কারণ এই ইয়াক-১৩০ আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে। দুজন সেরা দক্ষ পাইলট থাকার পরেও এমন দুর্ঘটনা বিমানের ত্রুটির প্রশ্নটা সামনে নিয়ে আসে। কেন যেন বারবার রং দে বাসন্তী সিনেমার কথা মনে পড়ে। আরেকটা বিষয়, এমন জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এমন যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে কী হতো সেসব বিবেচনায় নিশ্চয়ই কৌশল ঠিক করবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। কারণ পাইলটদের জীবনের যেমন ঝুঁকি তেমনি ওই এলাকারও ঝুঁকি।
শেষ করি একটা কথা বলে। আমাদের প্রত্যেককে এই পৃথিবী ছাড়তে হবে। তবে কোন কোন মৃত্যু সাহসিকতার। কোন কোন মৃত্যু বীরের যে মৃত্যু জীবনকে অর্থবহ করে। বুড়ো হয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর বদলে আমি নিজেও বীরের মতো মরতে চাই এমন অর্থবহ কোন কারণে। ভালোবাসা জাওয়াদের জন্য। একই সঙ্গে স্যালুট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের উত্তরসুরী স্কোয়াড্রন লিডার জাওয়াদকে। স্যালুট হে বীর!
লেখক : শরিফুল হাসান, কলামিস্ট।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে)
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]