অর্থনীতিতে নীতি প্রয়োগ কৌশল হিসেবে গেম থিওরি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। গেম থিওরির জনপ্রিয় উদাহরণটি হচ্ছে এরকম- এক টুপিওয়ালা বেশ ভালো বিক্রি-বাট্টা করে কিছু অবিক্রিত টুপি নিয়ে পার্কের বেঞ্চে আরামসে ঘুম দিয়ে উঠে দেখে যে পার্কের বাঁদরেরা তার সব টুপি মাথায় দিয়ে গাছের ডালে বসে আছে। টুপিওয়ালা ভাবতে থাকলো কী করা যায়।
এমন সময় তার মনে পড়লো বাঁদর অনুকরণ করে। সে তার মাথায় থাকা একমাত্র টুপিটি খুলে ঘাসের উপর ছুড়ে দিলো। ব্যাস বাঁদরেরাও একে একে সব টুপি খুলে ছুড়ে দিলো। টুপিওয়ালা খুশি মনে টুপি কুড়িয়ে বাড়ি চলে এলো। তারপর একমাত্র নাতিকে তার এই টুপি ফেরৎ পাওয়ার গল্প শুনিয়ে উপদেশ দিলো বাঁদরের পাল্লায় পড়লে কী কৌশল নিতে হবে।
এরপর দিন গেল নাতি বড় হয়ে নিজে দাদুর ব্যবসায় নেমে পড়লো। সেও একদিন কিছু অবিক্রিত টুপি নিয়ে পার্কে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মাথার টুপিটা ছাড়া বাঁদরেরা সব টুপি পরে গাছের ডালে বসে আছে। কী করা যায় নাতি ভাবতে গিয়ে দাদুর কথা মনে পড়ে গেল। সে তার মাথার টুপিটি খুলে ঘাসে ছুঁড়ে দিল। এদিকে একটি বাঁদরের টুপি কম পড়েছিল। নাতি টুপি ছোড়ার সংগে সংগে সে সেটি তুলে মাথায় পরে নিয়ে গাছের মগ ডালে গিয়ে বসে রইলো। নাতি বহু হুশহাস করেও টুপি ফেরৎ না পেয়ে টুপি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে অগত্যা স্থান ত্যাগ করলো।
সার কথা হলো প্রতিপক্ষের কৌশলেরও আপডেট হতে পারে এটা ভুলে গেলে চলবে না। আর নিজের কৌশলের আপডেট না ঘটালে প্রতিটি খেলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। নিজের কৌশল ঠিক করতে হয় প্রতিপক্ষের কৌশল জেনে, না জানতে পারলে সম্ভাব্য কৌশল অনুমান করে নিতে হয়। এজন্য অতীত কাল থেকেই রাজারা রাজনৈতিক জয় আনতে গুপ্তচর নিয়োগ দিতেন প্রতিপক্ষের কৌশল জানতে।
এবার ভাবুন শ্রীলংকার কাছে কেন হারলাম। সবাই মাঠের সেনা বা সেনাপতিকে দোষ দিচ্ছে; কিন্তু আমরা তো মনে হচ্ছে হেরে গেছি কোচের কৌশল আপডেট করার ব্যর্থতার জন্য। পিচ রিড করা, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের তথ্য জানা, নিজের টিম সাজানো, ইত্যাদিতে বাংলাদেশর কোচিং ও ম্যানেজমেন্ট টিম আপডেট নয় এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। যে খেলোয়াড় মানসিক চাপে আছে তাকে রিলিফ কেন দিচ্ছে না। সবাই তো আর মুশফিক হয়ে উঠেনি যে কামব্যাক করতে পারবে স্বল্প সময়ে!
এবার আমার মূল কথায় আসি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণ ও স্বরূপ কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে ধর্মীয়ভাবে উত্তেজিত, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন গুটি কয়েক মানুষ এই অপকর্মগুলো ঘটিয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এর সংগে সম্পৃক্ত নয়; বরং এসব ঘটনার প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপরও এগুলো ঘটে কেন? কারণ যারা এসব ঘটায় প্রতিবার তারা তাদের কৌশলের আপডেট ঘটায়। পক্ষান্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশল মান্ধাতার আমলের- সবসময় পোস্ট এক্টিভ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দুষ্কৃতি ধরতে নামে। তাদের গোয়েন্দা তথ্য গতানুগতিক, প্রতিরোধ পদ্ধতিও গতানুগতিক- কিছু আনসার, কিছু সিসিটিভি ফুটেজ, কিছু অনুদান, কিছু সম্প্রীতিসূচক বিবৃতি- ব্যাস কর্তব্যকর্ম শেষ।
সবচেয়ে হতাশ করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু শিক্ষিত মানুষের ফেসবুকীয় আচরণ। অতি আবেগ দেখানো, অতি রেটরিক কথা, ঘটনার বিশ্লেষণে অদক্ষতা, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সিস্টেমকে দোষারোপ করার প্রবণতা, সর্বোপরি বাংলাদেশে আমজনতার সহিষ্ণুতা ও সংস্কৃতিবোধকে অনুধাবন করতে না পারা, ইত্যাদি দৃষ্টিকটূভাবে প্রকট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কারো কারো বাক্য প্রয়োগে ছিল দেশ নিন্দা, অভব্য শব্দ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সমর্থন এবং জিঘাংসার সুর।
এই সব বাক্যবাণ মাঠে মারা নাও যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক শক্তি পরবর্তীতে নতুন কৌশল আপডেট করতে গিয়ে ফেসবুকীয় এই বাক্যগুলো তাদের দলীয় অনুপ্রেরণার জন্য সূত্র হিসেবে ব্যবহার করবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
(অধ্যাপক তোরাব রহিমের ফেসবুক থেকে)
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]