শেয়ারবাজারে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর করারোপের চিন্তা
প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ১৫:২৬
শেয়ারবাজারে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর করারোপের চিন্তা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর কর আরোপের কথা ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটি আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। সেক্ষেত্রে করের হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেই এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে এ খবরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে।


তবে মূলধনি আয়ের (ক্যাপিটাল গেইন) ওপর কর আরোপের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এর আওতায় আসবেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেন। তাদের অনেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফাও করেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে অনেক সময় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বড় বিনিয়োগকারীরা বেশিরভাগ সময়ই মুনাফা করেন। তবে সরকার সেখান থেকে কোনো রাজস্ব পায় না।


এসব কারণে শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিয়ে আগামী বাজেটে বড় বিনিয়োগকারীদের ওপর কর আরোপ করা হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, যদি একজন বিনিয়োগকারী ৪০ লাখ টাকার বেশি লাভ করেন, তাহলে সরকারকে কর দিতে হতে পারে। এক্ষেত্রে করের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। বর্তমানে, পৃথক বিনিয়োগকারীরা মূলধন লাভ কর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত।


এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, আসন্ন বাজেটে শেয়ারবাজারের মূলধন লাভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে। এক্ষেত্রে লাভের ১৫ শতাংশ দিতে হতে পারে।


এ ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি না- জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত কোনো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর বছরে ৪০ লাখ টাকা মুনাফা করার বাস্তবতা নেই। আর যারা ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন, তারা নিশ্চয়ই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পড়বেন।


এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি ও ব্র্যাক-ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা ক্যাপিটাল গেইনে ট্যাক্স দিয়ে থাকি। আমরা যতটুকু জেনেছি, এবার ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হতে পারে।


তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে আমরা চাই সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যাতে করা হয়। কারণ অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে রয়েছেন, যারা পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ করে আয় করছেন। সবার ওপর করারোপ করা হলে তাতে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যেহেতু আমাদের পুঁজিবাজার একটা ভারনারেবল পজিশনে আছে।


৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ট্যাক্স আরোপ করা হলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিএ সভাপতি বলেন, ব্যক্তিগত খাতে এমন বিনিয়োগকারী থাকতে পারে। তাদের কর দিতে হবে। কারণ আমাদের করের টাকায় দেশ চলবে।


সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, গত দুই বছরের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এসময়ে বিনিয়োগকারীরা সেভাবে রিটার্ন পাননি। এ অবস্থায় মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ করার প্রভাব সামলে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই পুঁজিবাজার। তাই আমরা চাই যাতে এ ধরনের করারোপ করা না হয়। তবে নিতান্তই যদি করারোপ করতে হয় তাহলে আমাদের আবেদন থাকবে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যাতে এর আওতার বাইরে রাখা হয়।


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সম্ভবত আইএমএফের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর প্রণোদনা প্রত্যাহারের জন্য যে চাপ দেয়া হয়েছে সে কারণেই মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে মনে হয়। করজাল সম্প্রসারণের উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এটি বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্বের সব দেশেই মূলধনি মুনাফার ওপর কর রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের জন্য কর ছাড় সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে তেমন কোনো ফল আসেনি। কোনো খাতেই একেবারে পুরো কর ছাড় দেয়া উচিত নয়। তবে প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য মূলধনি মুনাফার ক্ষেত্রে একটি সীমা বেঁধে দেয়া যেতে পারে যে এই সীমার বেশি মুনাফা হলে কর প্রযোজ্য হবে।


গত সপ্তাহ শেষে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন (ডেবট সিকিউরিটিজ ও মিউচুয়াল ফান্ড বাদে) দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৩০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের অংশ মাত্র ২০ শতাংশ। তাছাড়া এ ২০ শতাংশের মধ্যে উচ্চ সম্পদশালী বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন যাদের মূলধনি মুনাফার পরিমাণ বেশি। সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অবদান এক্ষেত্রে বেশ কম। যদিও সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আধিপত্য বেশি প্রায় ৮০ শতাংশ। বাজার মূলধনের বাকি ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, সরকার, বিদেশী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। এ শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা আরো আগে থেকেই মূলধনি মুনাফা ওপর কর দিয়ে আসছেন।


২০ শতাংশ সাধারণ ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর নতুন করে করারোপ করা হলে অনেক ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার শঙ্কা রয়েছে। ফলে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা পুঁজিবাজারের দৈনিক লেনদেনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সরকার স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর লেনদেনের ওপর উৎসে কর বাবদ মোট দশমিক ১০ শতাংশ হারে রাজস্ব পায়। লেনদেন কমে গেলে এ খাতের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।


করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, টাকার অবমূল্যায়নসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুর কারণে অস্থির আচরণ করছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলে গত দুই বছরে বিনিয়োগকারীদের লাভের তুলনায় লোকসান হয়েছে বেশি। প্রতিনিয়ত বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছেন এবং আশঙ্কাজনক হারেও কমছে বিও হিসাবের সংখ্যা।


বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে আমি শুনেছি যে আইএমএফের পক্ষ থেকে নাকি এটি বলা হয়েছে। মূলধনি মুনাফার বিষয়টি শেয়ারের দাম কমা-বাড়ার ওপর নির্ভর করে। ফলে মূলধনি মুনাফা যেমন হতে পারে তেমনি লোকসানও হতে পারে। তাছাড়া এ খাত থেকে খুব বেশি রাজস্বও আসবে না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।


পুঁজিবাজারের মোট পুঁজির প্রায় ৮০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের, যারা মুনাফার ওপর এরই মধ্যে ১০ শতাংশ হারে কর দিচ্ছেন এবং বাকি ২০ শতাংশের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংক, বীমা, আর্থিক, পোর্টফলিও ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, স্টক ব্রোকার বা স্টক ডিলার কোম্পানির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর, তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণকারী ব্যক্তি মূলধনি মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ হারে কর দিচ্ছে। এর বাইরে শুধু সাধারণ ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতারা শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ওপর কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছে।


২০১০ সালের ধসের পর থেকে দেশের পুঁজিবাজার এখন পর্যন্ত পুরোপুরি গতিশীল হতে পারেনি। শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি জোগানের ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজারে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য দেয়া বেশকিছু সুবিধা এরই মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যেমন আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী নগদ লভ্যাংশের ওপর নির্দিষ্ট করমুক্ত সীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং নগদ লভ্যাংশকে ন্যূনতম কর দায় হিসাবে বিবেচনায় নেয়ার কারণে নির্দিষ্ট শ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া কর রেয়াতের বিনিয়োগসীমা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার কারণে বিনিয়োগের ভাটা পড়েছে পুঁজিবাজারে।


অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মূলধনি মুনাফার ওপর কর দিতে হয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসারেই আইএমএফ করারোপের পরামর্শ দিয়েছে। একেবারে পুরো খাতের ওপর কর ছাড় সুবিধা দেয়ার পরিবর্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com