প্রায় দশ মাস প্রতীক্ষার পর অবশেষে সোমবার বিকেলে ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ৩০১ সদস্যের এই কমিটি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ এনে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত ও অবমূল্যায়িতরা।
এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা খতিয়ে দেখতে ঘোষিত কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের নেতৃত্বে সোমবার গভীর রাতে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৩ তারিখ ইফতার পরবর্তী সময়ে মধুর ক্যান্টিনে যে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রীতিকর ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিবার এটির তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সাথে উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির লক্ষে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হল। কমিটির সদস্যরা হলেন-আল নাহিয়ান খান জয়, ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত এবংপল্লব কুমার বর্মণ।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, তদন্ত কমিটিকে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে তথ্য-উপাত্তসহ তদন্ত রিপোর্ট দফতর সেলে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হল।
সোমবার সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ মিছিল বের করার প্রস্তুতিকালে ঢাবির মল চত্বরে জড়ো হওয়ার পর প্রথম দফায় তাদের ওপর হামলা করা হয়। পরে রাত ৮টার দিকে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে দ্বিতীয় দফা হামলার শিকার হন তারা।
হামলায় আহতরা হলেন- ছাত্রলীগের বিগত কমিটির সদস্য ও ডাকসুর বর্তমান সদস্য তানভীর হাসান সৈকত, কবি সুফিয়া কামাল হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদার, ডাকসুর আরেক সদস্য ফরিদা পারভীন, ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক বি এম লিপি আক্তার, রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লাসহ কয়েকজন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছাত্রলীগের নবঘোষিত ৩০১ সদস্যের কমিটির বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের একটি অংশ বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর থেকে মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের সামনে যায়। এ সময় নতুন কমিটিতে পদপ্রাপ্তরা তাদের ওপর হামলা করে।
বিক্ষোভকারীরা জানান, বিক্ষোভে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশাকে গ্লাস ছুঁড়ে মারা হয়েছে। তার মাথা ফেটে গেছে। এছাড়া রোকেয়া হল শাখার সভাপতি ও ডাকসুর ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক লিপি আখতার, সুফিয়া কামাল হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিলোত্তমা শিকদারও গুরুতর আহত হয়েছেন।
বিক্ষোভকারীরা বলেন, ছাত্রলীগের গঠিত ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হয়েছে। যারা ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে কোনো দিন থাকেননি, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে। এ সময় নবঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে উপ-সম্পাদকের পদ পাওয়া কয়েকজন পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন।
শামসুন নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ করেছি। কিন্তু আমাদের কোনো পদ দেয়া হয়নি। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিক্ষোভ করছিলাম। কিন্তু আমাদের গায়ে হাত দেয়া হয়েছে।
কারা মারধর করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে শান্তা বলেন, নতুন কমিটির সহ-সভাপতি সাদিক খান, অর্থ সম্পাদক রাকিব হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাকিল ভূঁইয়া, সহ-সভাপতি কামাল খান ও উপক্রীড়া সম্পাদক বায়জিদ কোতোয়াল হামলা করেছেন।
হামলার বিষয়ে হামলার শিকার তানভীর হাসান সৈকত বলেন, আমরা মধুর ক্যান্টিনের সামনে আসার পর সাদিক খান ও রাকিব হোসেন ও তাদের সাত-আটজন অনুসারী মিলে আমাদের কলার ধরে মারধর করে। এসময় তারা লিপি, তিলোত্তমা ও ফরিদা পারভীনের গায়েও হাত তোলে।
হামলার বিষয়ে তিলোত্তমা শিকদার বলেন, আমরা যখন মধুর ক্যান্টিনে সবাই মিলে মুভ করা শুরু করলাম তখন সাদিক খান আমার ও লিপির উপর হামলা করে, এক পর্যায়ে তারা আমাদের ধাক্কা দেয় এবং লিপির উপর হামলা করে আমি বাধা দিতে গেলে আমার ওপরও হামলা করে। আমরা এমন ছাত্রলীগতো চাইনি।
সাদিক খানের ব্যাপারেতিলোত্তমা বলেন, সাদিক খান যিনি বিবাহিত, যার স্ত্রী কিছুদিন আগে মারা গেল; এমন বিতর্কিত ব্যক্তি কিভাবে এ কমিটিতে স্থান পায়?
হামলার বিষয়ে রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সভাপতি লিপি আক্তার বলেন, কাউকে অভিনন্দন জানানোর অধিকার যেমন আমার আছে, ঠিক একইভাবে অযোগ্য কাউকে কমিটিতে স্থান দিলে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অধিকারও আছে। অথচ সেই অধিকার আদায় করতে গিয়েই আমাদের ওপরে হামলা করা হলো।
লিপি বলেন, ঘোষিত কমিটিতে অযোগ্যদের স্থান করে দেয়াতে এই কমিটির অনেকে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে।
নিজের অবস্থান জানিয়ে লিপি বলেন, আমি পদত্যাগ করার ঘোষণা এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের অভিভাবক। আমি তার কাছে আকুল আবেদন জানাই, যেন তদন্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। আমরা এই কমিটি মানি না। আমি রোকেয়া হলের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। এরপর আমি রোকেয়া হলের সভাপতির দায়িত্বও পালন করি। আমি ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটারিয়া বিষয়ক সম্পাদক। অথচ আমাকে দেয়া হয়েছে উপসম্পাদকের পদ। এটা একটা বড় প্রশ্ন আমার কাছে।
তিনি বলেন, শুধু আমিই না, আমাদের সঙ্গে যারা আজ হাকিম চত্বর ও মধুর ক্যান্টিনের প্রতিবাদে ছিলেন, তাদের অবস্থাও আমার মতো। তাদেরও আমার পদের মতো পদ দিয়ে নিগৃহীত করা হয়েছে।
এদিকে রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহতদের দেখতে গিয়ে পদ বঞ্চিতদের তোপের মুখে পড়েন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী। প্রায় আধা ঘণ্টা বাকবিতণ্ডার পর তারা ফিরে আসেন।
সম্মেলনের এক বছর পর ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে সোমবার বিকেলে তা প্রকাশ করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরপরই পদবঞ্চিতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে বিক্ষোভ করে। এ সময় তাদের ওপর হামলা করা হয়। হামলায় ডাকসুর তিন নেতাসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
বিবার্তা/রাসেল/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]