
‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’ জনপ্রিয় সংগীত প্রতিযোগিতার আসর ক্লোজ আপ ওয়ান তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ-এর থিম সংটির সাথে মিলে গেছে সফল ফ্রিল্যান্সার দিনা মৃর জীবন।
তিনি পড়ালেখা করেছেন নার্সিংয়ে। কলেজে থিউরিটিক্যাল পড়ার পাশাপাশি একটা মেডিকেলে নার্সিং প্র্যাকটিসও করেন তিন বছর। কর্তৃপক্ষের অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার তাগিদ থেকেই ৬ মাস পরই বদলে ফেলেন জীবনের গতিপথ। স্বপ্ন দেখেন ফ্রিল্যান্সিং করার। স্বপ্ন পূরণে ভর্তি হন ফ্রিল্যান্সিং ইনস্টিটিউটে। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, দৃঢ় মনোবল, ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি ভালোবাসা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। তার লক্ষ্য ছিল অটুট আর বিশ্বাস ছিল হৃদয়ে। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি হয়েছেন সফল। তিনি এখন মধুপুরের ইদিলপুরের অগণিত গারো নারী ফ্রিল্যান্সারদের অনুপ্রেরণার উৎস। হয়েছেন হাজারো তারুণ্যের স্বপ্নদষ্টা ও তাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা।
টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের ইদিলপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম। চারদিক শাল বনে ঘেরা। এই নিভৃত পল্লীতে গারো পরিবারে জন্ম দিনা মৃর। মা সিনিয়র নার্স। বাবা ল্যাব টেকনিশিয়ান। ভাই ডাক্তার। স্বামী চাকরি করেন বেসরকারি হাসপাতালে। দিনা নিজে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। পরিবারের সবাই মেডিকেলের সাথে যুক্ত আছেন। বলা যায় মেডিকেল পরিবার।
সফলতার জন্য পরিবারের সমর্থন বড় ভূমিকা রেখেছে
দিনা বলেন, আসলে আমাদের পরিবারের সবাই যেহেতু মেডিকেলের সাথে যুক্ত, তাই সবার স্বাভাবিক চাওয়া ছিল আমি যেন মেডিকেল লাইনে আমার ক্যারিয়ার গড়ি। নার্সিং শিখি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই। এক বছর পড়াশোনা করি। পারিবারিক সিদ্ধান্তে পরের বছর ভর্তি হই রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে। নার্সিং কলেজে থিউরিটিকেল পড়ার সময় আমাদের প্রাকটিকেল প্র্যাকটিসের সুযোগ ছিল। সেখানে আমি তিন বছর নার্সিংয়ের ডিউটি করেছি।
২০১৭ সালে নার্সিং পড়ার সময়ে পরিচিত একজন দাদার কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে জানাতে পারেন দিনা। একটা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেটের সাহায্যে ঘরে বসে অনলাইনে ডলার আয় করা যায়। এভাবে সারাদেশে অসংখ্য নারী ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করে সংসার চালাচ্ছে। আয় করছে। কথাগুলো তার মনে অনুপ্রেরণা দেয়। তখন তারও মনে ইচ্ছে জাগল ফ্রিল্যান্সিং করার।
দিনার ভাষ্য, তিন বছর নার্সিংয়ে পড়ার সময় হাসপাতালে ডিউটি করেছি। অবশ্যই নার্সিং একটা মহান পেশা। তবুও কেন যেন অন্যের অধীনে থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে আট ঘণ্টা কাজ করাটা ভালো লাগছিল না। তখন দাদার কথায় জীবনের গতিপথ বদলে ফেলি। সিদ্ধান্ত নেই ফ্রিল্যান্সিং করার।
ফ্রিল্যান্সিং তো করবেন, কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং কী, কীভাবে শুরু করবেন, কোথায় প্রশিক্ষণ নেবেন, কিছুই জানতেন না স্বপ্নবাজ এই তরুণী। মনে আছে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি। নিজের উপর আছে ভরসা। সেটাকে পুঁজি করে খুঁজতে থাকেন ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের। এদিকে নার্সিং পড়া শেষ। ৬ মাস কেটে যায় এভাবেই। ২০১৯ সালে একদিন হঠাৎ করে তার ফেসবুকের ওয়ালে ভেসে উঠে নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের কথা। খুঁজে পান স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ।
দিনা বলেন, ২০১৭ সালে যখন ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে অনেক শুনছিলাম তখনই আমার মনের মধ্যে ইচ্ছা জাগছিল আমিও এভাবে ফ্রিলান্সিং করব। কিন্তু কোথায় শিখব তা বুঝতে পারছিলাম না। তখন নার্সিংয়ে পড়ছিলাম। অন্যদিকে মনের সাথেও যুদ্ধ করে পেরে উঠতে পারছিলাম না। নার্সিং করব না ফ্রিল্যান্সিং করব। ২০১৯ সালে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমি নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের কথা জানলাম। ফ্রিল্যান্সিং কী সেটাই বুঝতাম না। প্রথমে আমার কাছে মনে হত যে, ফ্রিল্যান্সিং মানেই গ্রাফিক ডিজাইন। তাই গ্রাফিক ডিজাইন নিয়েই শিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নকরেক আইটিতে সে সময় গ্রাফিক ডিজাইন ব্যাচে সিট ছিল না। তাই ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করি। প্রথম দিকে একটু বুঝতে কষ্ট লাগলেও। সময়, কঠোর পরিশ্রম ও ডেডিকেশন দেয়ার পর ধীরে ধীরে এই কাজের প্রতি আমার এত ভালোলাগা শুরু হয় যে, পরে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়েই সিরিয়াস ভাবে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
সব ফ্রিল্যান্সারের শুরুর দিনগুলিতে থাকে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জ। দিনার বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। ফ্রিলান্সিংয়ের জন্য প্রয়োজন হয় একটা ভালো ল্যাপটপ বা কম্পিউটার। এটা তার ছিল না। সে সময় কেনারও সামর্থ্য ছিল না। পরে টাকা ধার করে একটি ভালো কম্পিউটার কিনে নেন তিনি। তখন ভালো করে কম্পিউটার চালানোও জানতেন না। শেখা শুরু করেন। তখন অনেকেই বলত, এগুলো শিখে কিছু হবে না। শুধু শুধু তুমি সময় নষ্ট করছো। তার চেয়ে নার্সিং পেশাটাই তোমার জন্য ভালো ছিল। এমন নানান ধরনের নেগেটিভ কথা শুনতে হয়েছে তাকে। এসব কথায় কান দেননি বা থেমে যাননি আত্মপ্রত্যয়ী দিনা। মনে ছিল প্রত্যয় আমাকে শিখতেই হবে। ফ্রিল্যান্সিং করতেই হবে। আমি শিখবই। তাই দিনরাত এক করে ভালো মতো শিখার কাজে মনোযোগ দেন তিনি।