লাখো নারী উদ্যোক্তার স্বপ্নের দিশা রূপা আহমেদ
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২২, ১১:৪৪
লাখো নারী উদ্যোক্তার স্বপ্নের দিশা রূপা আহমেদ
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

স্বপ্ন দেখলেই হয় না। লক্ষ্য স্থির রেখে সেই স্বপ্ন পূরণে অবিরাম কাজ করে যেতে হয়। তাহলেই একদিন অধরা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। রূপা আহমেদ এমনই একজন নারী। জীবনে স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে পড়ালেখা করে নিজে থেকে কিছু করার। উদ্যোক্তা হওয়ার। সমাজে নিজের একটা আলাদা ও স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার। পাশাপাশি সমাজে পিছিয়ে পড়া অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার। আজ তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিনি এখন অগণিত নারী উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণার উৎস।


বলছিলাম নারী উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের (ওয়েব) প্রেসিডেন্ট এবং রূপা বুটিক হাউজের কর্ণধার ও স্বত্বাধিকারী রূপা আহমেদের কথা। তিনি ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মানব সেবা কমিটির সেক্রেটরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অনলাইন প্লাটফর্ম দেশীয়.কম-এর ফাউন্ডার এবং চেয়ারম্যান।


অন্য পাঁচটা সাধারণ নারীর মধ্য থেকে উঠে এসে স্বামী-সংসার সামলে নিজের যোগ্যতায় উদ্যোক্তা সেক্টরে স্বতন্ত্র একটা পরিচয় তৈরি করেছেন। সারাদেশের অগণিত নারীর অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছেন। তার আজকের এই অবস্থান তৈরি করার পেছনে রয়েছে নানান চড়াই-উৎরাই পেরোনোর গল্প।


কৈশোর থেকেই নিজের জামা-কাপড় নিজেই ডিজাইন করে বানাতেন। আর সেগুলি পরতেন। তখন থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের প্রতি তার মনে আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করতো। ডিজাইনিংয়ের প্রতি দিন দিন তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। একটা সমেয় এসে ডিজাইনিংয়ের প্রতি ঝোঁক চলে আসে। স্কুলজীবন থেকেই টুকটাক ডিজাইনিংয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। তখন তার মনে হতো বড় হয়ে ডিজাইনার হতে পারবেন। ধীরে ধীরে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে।


ছাত্রী হিসেবে বরাবরই ভালো ছিলেন রূপা। খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি, মতিঝিল টিএনটি কলেজ থেকে এসইচএসসি এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে বিএসএস পাস করেন।



শুধু নিজের স্বপ্ন বাস্তয়নই নয়, অন্যদের জীবন গড়তেও সদা তৎপর


রূপা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে সংসার জীবনে এসে একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করছিলাম। নিয়ম করে প্রতিদিন রুটিন মাফিক কাজ করা, বসের অধীনে থাকা এসব আর ভালো লাগছিল না। তখন মাথায় আসে কোনো একটা বিজনেস করতে পারলে নিজে ভালো থাকা যেতো। সেই সাথে পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাও সম্ভব হতো। সে ভাবনা থেকে ছোটবেলার ফ্যাশন ডিজাইনের প্রতি ভালোলাগার বিষয়টি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেই। নিজের উপর ছিল অগাধ আত্মবিশ্বাস। সেটিকে পুঁজি করে স্বামীর সাথে পরামর্শ কররি। স্বামী প্রথমে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও বুঝিয়ে বলেছি। তখন বন্ধুসুলভ ভাবে পাশে থাকার সম্মতি দেন। ২০০৮ সালে শুরু করি স্বপ্নের প্রজেক্ট। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের বিজনেস। নিজের নামে বিজনেসের নাম দেই ‘রূপা বুটিক হাউজ’।



যেকোনো বিজনেসে সফলতার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। রূপাও ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের বিজনেসকে দক্ষ হাতে পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ২০০৯ সালে রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীতে একটা কারখানায় বিজনেসের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেন। নরসিংদী থেকে থান কাপড় কিনে ওই কাপড়ে ডিজাইন করে ব্লক বাটিক ও এমব্রয়ডারির কাজ করতেন। পরে সেগুলি স্থানীয়ভাবে বিক্রি করতেন।



রূপা বলেন, শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের দেশীয় পোশাক তৈরি করেছি। যেমন, থ্রি-পিস, সালোয়ার-কামিজ দিয়েই শুরু করি। আস্তে আস্তে শাড়ি, পাঞ্জাবি, কাপল ড্রেস, বেবি ড্রেসসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় পোশাক তৈরি করেছি। হাতের তৈরি কাজগুলো শুরু থেকেই ভালো সাড়া পেয়েছি। আমার বিজনেস কৌশল ছিল, আমি যেমন কোন পোশাক কিনতে গেলে কাপড়টা গুণগতমানসম্পন্ন, টেকসই কি-না, পরে স্বস্তি পাবো কি-না, এসব বিষয়ে চিন্তা করি। ঠিক তেমনি ক্রেতারাও যাতে আমার তৈরি পোশাক কিনে পরে আরাম ও স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন সেটি মাথায় রেখে প্রত্যেকটা পোশাক ডিজাইন ও তৈরি করেছি। আমার পোশাকগুলির প্রথম দিকের কাস্টমার ছিল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদের মাধ্যমে প্রথম বেচাকেনা শুরু হয়। তারাই প্রথমে নিজের পছন্দ ও চাহিদা মতো এ পোশাকগুলি কিনেছেন। আলহামদুলিল্লাহ শুরুটা খুব ভালো ছিল।


কারখানায় তৈরি পোশাকগুলো বিক্রিতে সাহায্য করেছে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। রূপা তাদের বিনা পুঁজিতে কাপড় বিক্রি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। স্থানীয় বেকার নারী-পুরুষরা সেগুলি বিক্রি করে দিন শেষে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন।


রূপা বলেন, কারখানার তৈরি পোশাকগুলো স্থানীয়দের বিনা জামানতে নিয়ে বিক্রির সুযোগ করে দেয়ায় বেকার নারী-পুরুষরা সেগুলো অনেক আগ্রহ নিয়ে বিক্রি করেছেন। সবাই খুব আন্তরিকভাবে কাজটা করেছেন। বিষয়টা খুব ভালো লাগত। তবে কিছু মানুষ পোশাক নিয়ে বিক্রি করে আর টাকা ফেরত দেননি। আমাকে ঠকিয়েছেন। লাভ-লস নিয়ে বিজনেস। কথাটা মাথায় নিয়ে হতাশ হইনি। তিন বা ছয় মাস পর যখন কেউ এসে বলতো, আপু আপনার এই কাপড়ের বিক্রি করে লাভের টাকায় আমি একটা ফ্রিজ কিনেছি, আমি একটা টিভি কিনেছি, তখন আমার খুব ভালো লাগতো। তখন মনে হতো আমি মানুষের একটু হলেও উপকারে আসতে পেরেছি। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে আমার ‘রূপা বুটিক হাউজ’-এর কার্যক্রম।