
মা চাইতেন আমি যেন গায়িকা হই। তাই ছোটবেলায় আমাকে গান শিখিয়েছেন। তখন থেকেই কেন যেন আমার গৎবাধা নিয়ম-কানুন, থিউরিটিক্যাল কিছুই পছন্দ ছিল না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত গান শিখি। নাচের প্রতিও আলাদা ভালোলাগা কাজ করত। যদিও সেক্ষেত্রেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকেই সুনির্দিষ্ট করে কোনো পেশার প্রতি ফোকাস না করে কেন জানি আমার চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে খুব ভালো লাগত।
ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, পাইলট হব এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা কখনো মাথায় আসেনি। সব সময় মনে হতো, যে কাজটি আমি সবচেয়ে বেশি এনজয় করবো, যে কাজটি করতে খুব ভাল লাগবে, সেটিই আমি করবো। সময়ের সাথে সাথে সেটিই আমি করেছি। যখন আমি বুঝতে পেরেছি এ কাজটি করে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি, কাজটি করতে আমার ভালো লাগছে, সেটিই আমি করে এসেছি।
এভাবেই আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের ক্যারিয়ার জীবনের কথাগুলো বলেন নিউজ প্রেজেন্টার ও নবাগত অভিনেত্রী তাসনিম এ জান্নাত। পুরোনাম তাসনিম এ জান্নাত অর্থী হলেও সবাই তাকে অর্থী নামেই ডাকেন। স্কুলজীবনে প্রথম মডেলিংয়ের অফার পান। এরপর ছোটপর্দায় অভিনয় করে মিডিয়াতে যুক্ত হলেও সময়ের পালাক্রমে নাটক, মডেলিং করে আজ তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সফল নিউজ প্রেজেন্টার। প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন সংবাদমাধ্যমে। এখন তিনি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত যে মানুষটাকে টিভির পর্দায় দেখা যায় তার এই প্রেজেন্টার হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে নানান ঘটনা।
কখনো গৎবাধা নিয়মে চলতে চাইনি
ঢাকায় জন্ম তাসনিম এ জান্নাত অর্থীর। এখানেই মায়ের আদরে শৈশব, কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলি কেটেছে তার। বড়বোন ও ছোটভাইয়ের মধ্যে অর্থী মেঝো। পারিবারের চার সদস্যদের মধ্যে একটা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক রয়েছে।
অর্থীর ভাষ্য, আমার পরিবার আমার কাছে সবকিছু। আমার পরিবারের চারজন সদস্য সব সময় বন্ধুর মতো সবকিছু করে থাকি বলে যেকোনো বিষয়ে সবাই একসাথে খুব এনজয় করি। সবাই সবার সঙ্গ খুব উপভোগ করি।
স্কুলজীবন থেকেই বরাবর ভালো রেজাল্ট করে আসছেন অর্থী। ছাত্রী হিসেবে ছিলেন খুবই মেধাবী। কমার্স বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই কখনও হাইলাইটেড হতে পছন্দ করতেন না তিনি। মানুষের অ্যাটেনশন খুব বেশি পাওয়া, এই বিষয়টা থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন।
অর্থী বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি একটু রিজার্ভড থাকতাম। তাই আমাকে বোঝা একটু মুশকিল ছিল। আমি বেছে বেছে মানুষের সাথে কথা বলতাম। ক্লাসের অন্যরা আমার নামের পাশে রহস্যময়ী আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু পছন্দের সঙ্গ পেলে আমি আবার একেবারেই অন্য রূপের এক মানুষ।
এইচএসসি পাস করে অর্থী উচ্চশক্ষিার জন্য ভর্তি হন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু একটা করতে হবে। সে ভাবনা থেকে একটা পার্টটাইম চাকরি খুঁজছিলেন। একদিন একটা সার্কুলার দেখেন চ্যানেল ২৪-এ নিউজ প্রেজেন্টার নেয়া হবে। তখন ভাবেন এটা তো একটা ক্রিয়েটিভ কাজ। ট্রাই করে দেখা যাক হয় কিনা। তখন কোনো আগপিছ চিন্তা না করে অ্যাপ্লাই করেন। চাকরিটা হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরু থেকেই এভাবে নিউজ প্রেজেন্টেশনের সাথে যুক্ত হন অর্থী। আবারও শুরু হয় মিডিয়ার সাথে পথচলা। তবে এবার ভিন্নভাবে।
পছন্দের কাজেই তার অভিনিবেশ
অর্থী বলেন, আসলে আমার জীবনে পরিকল্পনা করে কোনো কিছুই করা হয়নি। যা-ই পরিকল্পনা করেছি সব উল্টো হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে যুক্ত হওয়াটাও একেবারে হঠাৎ করেই।
শুরুতে নিউজ প্রেজেন্টেশনের তেমন কোনো প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না অর্থীর। চ্যানেল ২৪-এ বিবিসি, সিএনএন-এর ট্রেইনারদের দিয়ে ২ মাসের একটা প্রশিক্ষণ করানো হয়। এটাই ছিল তার জন্য প্রথম প্রশিক্ষণ। এরপর তিনি প্রতিনিয়ত চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করেন। সংবাদ উপস্থাপন এখন শুধুমাত্র তার পেশা নয়, সবচেয়ে ভালোবাসার একটা জায়গা।
সংবাদ উপস্থাপন একটা শিল্প। অনেক বড়ো একটা দায়িত্ব। পুরো নিউজরুমের অনেক পরিশ্রমের ফসল যা হাজারো দর্শকের সামনে তুলে ধরেন একজন উপস্থাপক। তাই দায়িত্বের ভারটাও অনেক বেশি। নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে প্রথমদিনের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল? অর্থী বলেন, আমার বয়স যেহেতু অনেক কম ছিল, তাই নার্ভাসও ছিলাম একটু বেশি। যেহেতু ক্যামেরার আগে কাজ করা হয়েছিল, তাই ক্যামেরাভীতি ছিল না। কিন্তু এর আগে যেহেতু কখনো লাইভ অন এয়ারে যাইনি, তাই একটু ভয় কাজ করছিল। কারণ লাইভ অনএয়ার হওয়ার বিষয়টা খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ ভুল হলে সেটা নতুন ভাবে করার কোন সুযোগ নেই। তাই কিছুটা শঙ্কা থাকলেও প্রথমদিন সাবলীলভাবে কোনো ভুল ছাড়াই সংবাদ উপস্থাপন করতে সক্ষম হই।
২০১২ সালে চ্যানেল ২৪-এ যোগ দেন তরুণ এই সংবাদ উপস্থাপিকা। মাঝখানে বছর দুয়েক কাজ করেন দেশ টিভিতে। তারপর যখন নিউজ ২৪-এর আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু হয়, তখন তিনি চ্যানেল নিউজ ২৪-এ যোগ দেন। টানা ছয় বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি তিনি মাঝে এক বছর একটি এফএম রেডিও স্টেশনে আরজে হিসেবে একটি শো হোস্ট করেছেন।
রেডিওতে আরজে হিসেবে কাজ করাটাও তার জন্য ছিল একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। অর্থীর ভাষ্য, আরজিংয়ে আমার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি টিভিতে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করেছি। স্ক্রিনে দর্শকরা আমাকে দেখেছেন। যখন আমার শো শুরু হয়, তখন যারা আমাকে স্ক্রিনে দেখেছেন, চিনতেন তারা আমার লিসেনার হতে শুরু করেন। ওই শোতে তরুণ লিসেনারদের একটা নতুন সার্কেল তৈরি হয়। সেই শো থেকে আমি শ্রোতাদের কাছ থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি, যা অভাবনীয়। আমি ওই কাজটা ছেড়ে দেয়ার পরও এখনও লিসেনাররা প্রতিনিয়ত আমার খোঁজ-খবর রাখেন, ভালোবাসার শুভেচ্ছা পাঠান। এই ভালোবাসাময় অভিজ্ঞতাগুলো আসলে মানুষকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়।
যখন রেডিও জকি
একজন সংবাদ উপস্থাপককে টিভি স্ক্রিনে সুন্দরভাবে সংবাদ উপস্থাপনা করতে বেশ কিছু গুণাবলী অর্জন করতে হবে। অর্থীর ভাষ্যমতে, সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য একটু গোছানো ব্যক্তিত্বের হওয়া উচিত। উপস্থাপকের কাছে যে খবর বা তথ্য আছে সেটাকে শ্রোতা-দর্শকদের কাছে কতটা শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে পৌঁছে দেয়া যায় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেহেতু এটা দেখা ও শোনার বিষয়, তাই এখানে মেকআপ-গেটাপেরও বিষয় রয়েছে। পরনের পোশাক, মেকআপ এমন হওয়া উচিত না যা নিউজের সাথে প্রাসঙ্গিক বা মানানসই নয়। একজন নারী বা পুরুষ প্রেজেন্টার অন্য সাধারণ দিনে বা অনুষ্ঠানে যে রকম পোশাক বা গেটাপ নিতে পারেন, নিউজে তা নিতে পারেন না। পোশাক, চুল, মেকাপ, এক্সপ্রেশন সবগুলোর সমন্বয় থাকতে হবে। এখানে দিনের সাথে, খবরের বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে সব কিছু পরতে ও করতে হয়। এমন কিছু পরা বা করা যাবে না যেটা দর্শকদের বিরক্তির কারণ হতে পারে। তবে একজন সংবাদ উপস্থাপকের জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে সেগুলো হলো স্পষ্ট, শুদ্ধ উচ্চরণ ও প্রমিত বাংলায় কথা বলা, শারীরিক ভাষা বা সুন্দর বাচনভঙ্গী, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি।
সংবাদ উপস্থাপনা যেমন একটা শিল্প, তেমনি কাজটা অনেক চ্যালেঞ্জিংয়েরও। তার মতে, সংবাদ উপস্থাপনা একজন উপস্থাপকের কাছে প্রত্যেকটা দিনই একটা নতুন দিন, একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি খবরই তার কাছে নতুন। প্রতিনিয়ত নানারকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আবার এমনও হয়, পাঁচ মিনিট আগেই একটা ঘটনা ঘটেছে। আর সেটা খবর তৈরি হয়ে আমার কাছে এসেছে। তখন ওই হট চেয়ারে বসেই ইমপ্রোভাইজ্শন, প্রমিত উচ্চারণ বজায় রেখে সংবাদটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, একজন দক্ষ উপস্থাপকের দায়িত্ব।
পড়াশোনার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে চাকরি করার বিষয়টা পরিবার কীভাবে নিয়েছে? জবাবে অর্থী জানালেন, শুরুর দিকে আমার ফুলটাইম চাকরির ব্যাপারে পরিবার থেকে কিছুটা আপত্তি ছিল। কারণ, তাদের ধারণা ছিল চাকরিতে এত সময় দিলে আমার পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আমি দু’দিকেই ভালোভাবে ব্যালেন্স করতে পেরেছি, তখন অনেক বেশি উৎসাহ এবং সহযোগিতা পেয়েছি পরিবারের কাছ থেকে। আমার কাজের পেছনে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ভূমিকা অনেক বেশি। প্রতিটি কাজে আমার পরিবারের প্রত্যেকজন মানুষ আমার বন্ধুর মত পাশে থেকেছে। তাদের সাপোর্ট না পেলে আমি আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। এত ভালোভাবে কাজ করা হত না। বিশেষ করে আমার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা আমার মা।
পরিবারকে সব সময় পাশে পেয়েছি
যারা সংবাদ উপস্থাপনাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে? অর্থী বলেন, আমি প্রতিদিনই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। শেখার চেষ্টা করি। তাই নতুনদের পরামর্শ দেয়ার যোগ্য নিজেকে এখনো মনে করি না। তবে অনেক বছর ধরে যেহেতু সংবাদমাধ্যমে কাজ করছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং সাবলীল বাচনভঙ্গি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক বিষয়ে জানা, জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই।
অর্থী শুধু সংবাদ উপস্থাপিকা হিসেবেই কাজ করেন না, ‘পায়ের ছাপ’নামে একটা চলচ্চিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রের অভিনয় নিয়ে তিনি বলেন, মিডিয়াতে কাজ করার সময় হঠাৎ করেই কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে আমি যতগুলো সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছি মোটামুটি সবগুলো ছিল বাণিজ্যিক ধারার। যার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমার দর্শক-শ্রোতা এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য এমন একটা কাজ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছি, যেখানে ব্যক্তি অর্থীর সঙ্গে তারা কিছুটা মিল খুঁজে পাবেন।
ব্যক্তি হিসেবে অর্থী একজন মার্জিত ও রুচিবোধসম্পন্ন নারী। দেখে-শুনে ও বেছে বেছে কাজ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কাজের কোয়ালিটি এবং রুচির সাথে কোনোভাবেই কম্প্রোমাইজ করতে পারব না। শুধু শখ বা অভিজ্ঞতার জন্য আমি এমন কাজ করবো না, যা দেখে আমার দর্শক-শ্রোতা হতাশ হবে। তাই যদি কাজ করতে হয় খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে করবো। আর না হয় করবো না।
সংবাদ উপস্থাপককে হতে হয় পরিপাটি
মিডিয়াতে চাকরি করার কারণে অবসর খুব কমই মেলে অর্থীর। যেটুকু সময় পান তার পুরোটাই পরিবার এবং কাছের মানুষদের সঙ্গে কাটানোর চেষ্টা করেন। আর ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে তার কাছে ভ্রমণের জায়গার চেয়ে সাথের মানুষের প্রাধান্য খুব বেশি। পছন্দের কেউ সঙ্গে থাকলে যেকোনো জায়গাই তার কাছে হয়ে ওঠে সুন্দর।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে অর্থী বলেন, লাইফ ইজ সো আনপ্রেডিক্টেবল। আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী চমক অপেক্ষা করছে তা আমরা জানি না। যেহেতু সব সময় নতুন কিছু করতে ভালোবাসি, তাই কিছু পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। প্রকৃত সময় সুযোগ বুঝে অবশ্যই সবাইকে জানানোর ইচ্ছা আছে।
বিবার্তা/গমেজ/কেআর
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]