৯১’এর ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে ৫’শ মানুষ প্রাণ হারালো
যে গ্রামে ৩৩ বছরেও আশ্রয় কেন্দ্র নেই
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৪৬
যে গ্রামে ৩৩ বছরেও আশ্রয় কেন্দ্র নেই
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের ডাঙ্গারচর গ্রামে ভয়াল ৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ শত মানুষ মারা যাবার ৩৩ বছর পরেও গড়ে উঠেনি দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত কোন সাইক্লোন শেল্টার, আশ্রয়কেন্দ্র ও বেঁড়িবাধ। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আতঙ্কে কাটে উপকূলে বসবাসরত ডাঙ্গারচরের প্রায় ১৫ হাজার মানুষের।


দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে করণীয় বিষয় প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) ও রেড ক্রিসেন্ট জনসচেতনতা সৃষ্টি করলেও অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে হতাশায় পুরো গ্রামবাসী। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও দ্রুত টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণের দাবি গ্রামবাসীর।


তথ্যমতে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে প্রলয়ংকরী সুপার সাইক্লোন সিডর আছড়ে পড়ে জুলধা ডাঙ্গারচর উপকূলসহ উপজেলার নদীপাড়ের বসতি গড়া মানুষের উপর। এ সময় লন্ডভন্ড হয় মানুষের বসতঘর। গ্রামের মানুষের নিজস্ব অর্থায়নে বেরিবাঁধ নির্মাণ করলেও তাও ভেঙে যায়।


ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৮-৯ ফুট উচ্চতায় বেড়ে গেলে মানুষের জীবনমান ও চলাচল অচল হয়ে পড়ে।


এছাড়াও ১৯৯১ সালের ভয়াবহ সেই জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়ে যায় এ জনপদের হাজার হাজার বাড়িঘর। এ দুঃসহ স্মৃতি ৩৩ বছরেও ভোলেনি তারা। ম্যারি এন ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন এক পুকুরে ২৮ লাশ। আর এক কবরে ৫০ জনের গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন সেই পুকুর এখনো রয়েছে গ্রামে। অথচ, এ গ্রামে এখনো নির্মিত হয়নি আশ্রয় কেন্দ্র।


পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারের অভাবে এ অঞ্চলে ৯১ সালে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি ঘটে ছিল বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।


এরই মধ্যে আবার সিডরের মতো প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্গত ডাঙ্গারচরের কপালে দুঃখই রয়ে গেলো। মরার উপর খাড়ার ঘা, প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে আবার এ গ্রামের মানুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।


তবে বিভিন্ন দুর্যোগের পর ইউনিয়ন পরিষদ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রচারের মাধ্যমে এখন অনেকটা সচেতন লোকজন।


কর্ণফুলী উপজেলায় বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কতটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে তার তথ্য পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ভবনগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা যায়। তবে বিদ্যমান জনসংখ্যা অনুযায়ী আরও ২০/৩০ টি সাইক্লোন সেন্টারের প্রয়োজন এই উপজেলায়।


কর্ণফুলী উপজেলার ডাঙ্গারচর এলাকার মোহাম্মদ আব্বাস (৩৯) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমাদের নদীর পাড় ভেঙে গ্রামের অনেকের বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন নদী প্রায় আমাদের বাড়ির কাছে চলে এসেছে। বেঁড়িবাধ দিয়ে নদীর ভাঙন ঠেকানো না গেলে হয়ত একদিন আমাদের বাড়িঘরও বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের দরকার জরুরি ভিত্তিতে সাইক্লোন শেল্টার ও টেকসই সড়ক।’


জুলধা এলাকার মো. সাদ্দাম বলেন, ‘এ উপকূলীয় গ্রামটিতে কোনো ধরনের সরকারি মুজিব কেল্লা, উঁচু সড়ক বা কোনো টেকসই বেড়িবাঁধও নেই। ফলে ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো দুর্যোগে দুর্বিষহ জীবন পার করে এ গ্রামের অধিবাসীরা।’


ডাঙার চরের খুরশিদা বেগম বলেন, ‘৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ে আমার স্বামী রহমত উল্লাহ, আমার শাশুড়ি আজব খাতুন ও আমার ছেলে বালা মারা গেছেন। ওই ভয়ংকর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেনি। ওই সময়ের কথা মনে হলে এখনো আতঙ্কে ছেয়ে যায় মন।’ ৩৩ বছর পর এসেও সেই কথা বলতে কেঁপে কেঁপে ওঠেন এই নারী।


সাধারণ মানুষের পক্ষে ডাঙার চর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, ‘এলাকা থেকে সাইক্লোন শেল্টার অনেক দূরে, তাই দুর্যোগের সময় গ্রামের অনেক লোক আশ্রয় নিতে শহরে চলে যায়। তাও নদী পার হয়ে। কিন্তু অনেকেই আবার ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে থেকে যায়।’


তিনি আরও বলেন, ‘ম্যারি এন, সিডর ও আইলার পরে আমরা ভেবেছিলাম আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে সরকার আমাদের বেঁড়িবাধ ও প্রয়োজনীয় সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করে দেবেন। কিন্তু এর কিছুই হয়নি। বেঁড়িবাধ নির্মাণের নামে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আইওয়াশ করা হচ্ছে। কবে হচ্ছে বাঁধ নির্মাণ তার খবর নেই। এ বিষয়ে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসকের।’


জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল হক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নেই। যা আছে তাতে সংকুলান হয় না, আরও দরকার রয়েছে। বিশেষ করে ডাঙার চরে জরুরি ভিত্তিক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা জরুরি।’


স্বজন হারা ওসমান গণি, মাহবুব আলম, হাফেজ আহমদ, মো. শাহাজান, মো. ইব্রাহিম জানান, তারা সকলে তাদের আত্মীয় স্বজনকে ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়েছেন।


উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এখন যেকোনো সময় দুর্যোগের বিষয়ে অবহিত করলে মানুষজনকে সরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সাইক্লোন শেল্টার পর্যাপ্ত নয় সেটা সত্য, আরও হলে নিরাপদের জন্য ভাল হয়। এ ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।’


বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) এর মহাসচিব অ্যাডভোকেট এ.এম জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে সম্পদের প্রচুর ক্ষতিসহ যথাক্রমে ৩ লাখ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকায় জীবনহানির সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪০৬ ও ১৯০ জন।’


তিনি আরও বলেন, ‘যে গ্রাম থেকে ৯১ সালে ৫০০ মানুষ মারা গেছে ওই গ্রামে এখনো সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়কেন্দ্র না হওয়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতা। মানুষের জীবন রক্ষায় গ্রামের মানুষের নিজস্ব অর্থায়নে গ্রাম রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিত জুলধার ডাঙার চরে বড় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা।’


চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘জুলধা ডাঙার চর গ্রামের কথা আমাদের কেউ জানায়নি। আপনিই প্রথম জানালেন। এখন আমাদের সাইক্লোন শেল্টারের প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষকে এক্ষুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ডিসি স্যারসহ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দরখাস্ত দিয়ে রাখতে বলেন। আমরা অবশ্য ডাঙার চরে একটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করার চেষ্টা করব। এছাড়াও যদি খাস জমি থাকে মুজিব কেল্লাও করে দেব।’


বিবার্তা/জাহেদ/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com