ফরজ না হলেও জাকাত-ফিতরা যাদের দিতে হবে?
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৫
ফরজ না হলেও জাকাত-ফিতরা যাদের দিতে হবে?
ধর্ম ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

কেউ কেউ মনে করেন, কোনো ওজরের কারণে রোজা রাখতে না পারলে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয় না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সদকাতুল ফিতর একটি স্বতন্ত্র ইবাদত।


রোজা রাখা বা না রাখার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ওজরের কারণে রোজা রাখতে না পারলেও নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যথাসময়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করা জরুরি।


জাকাত ফরজ না হলে কি ফিতরা দিতে হবে?


অনেকের ধারণা, কারও ওপর জাকাত ফরজ না হলে তার ওপর সদকাতুল ফিতরও ওয়াজিব হয় না। এ ধারণা ঠিক নয়। কোনো ব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ না হলেও অনেক ক্ষেত্রে তার ওপর সদকাতুল ফিতর আবশ্যক হয়ে যায়। কেননা জাকাত ও সদকাতুল ফিতরের নেসাবের ধরনে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। জাকাত শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা এবং ব্যবসায়িক পণ্যের ওপর ফরজ হয়। এ তিন প্রকারের সম্পদ ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর জাকাত ফরজ হয় না।


অপরদিকে প্রয়োজন অতিরিক্ত সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়, যদি তা নেসাব পরিমাণ হয়। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, বসবাসের অতিরিক্ত ঘর-বাড়ি, প্রয়োজন অতিরিক্ত গাড়ি, ঘরের অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ইত্যাদি সব কিছু সদকাতুল ফিতরের নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।


সব শ্রেণির ব্যক্তিই আধা সা’ গমের মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা


বর্তমানে এ প্রথা চালু হয়ে গেছে যে, শুধু আধা সা’ গমের মূল্য দ্বারাই সবাই সদকাতুল ফিতর আদায় করেন। সাধারণত মনে করা হয় যে, সদকাতুল ফিতর আদায়ের পরিমাণ সবার জন্য এই একটিই। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। হাদিস শরীফে সর্বমোট পাঁচ প্রকার খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায়ের বর্ণনা এসেছে। যথা: যব, খেজুর, কিসমিস, পনির ও গম। প্রথম চারটি দ্বারা ফিতরা আদায় করতে চাইলে মাথাপিছু ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম, আর গম দিয়ে দিলে মাথাপিছু ১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৮)


প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী উল্লেখিত পাঁচটি দ্রব্যের মধ্যে যেটি সর্বাধিক মূল্যবান তা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন।


সমাজে এমন অনেক ধনবান ব্যক্তি আছেন, যারা খুব সহজেই খেজুর, কিসমিস বা পনির দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায়ের সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু অন্যদের দেখাদেখি তারাও অর্ধ সা’ গমের মূল্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করেন, যা মোটেও সমীচীন নয়। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত নিজের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী উপরোক্ত দ্রব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামী দ্রব্যের হিসাব অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করা।


খাদ্যদ্রব্যের মূল্য দ্বারা ‘ফিতরা’ আদায় করলে তা আদায় হবে না। আজকাল কিছু লোককে বলতে শোনা যায় যে, সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে সরাসরি হাদিসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্য দ্বারা। খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তার মূল্য দ্বারা ‘ফিতরা’ আদায়ের রেওয়াজটি ভিত্তিহীন। শরীয়তে এর কোনো প্রমাণ নেই। অথচ শরীয়তের দলীলে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, হাদিসে উল্লেখিত খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে সেগুলোর মূল্য আদায় করারও অবকাশ আছে।


সেক্ষেত্রে উল্লেখিত খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটিকে মাপকাঠি ধরে সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে। অর্থাৎ ওই খাদ্যবস্তুর জন্য শরীয়তে যে পরিমাণটি নির্ধারিত-‘সা’ বা ‘নিসফে সা’ সে পরিমাণের বাজারমূল্য আদায় করলেও সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে।


নিম্নে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য দ্বারা ‘ফিতরা’ আদায়ের কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করা হলো।


১. সাহাবায়ে কেরাম রাযি.-এর মাঝে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য দ্বারা ‘ফিতরা’ আদায়ের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ইসহাক আস সাবিয়ী রহ. বলেন-


أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ ‘আমি সাহাবায়ে কেরাম রাযি.কে এ অবস্থায় পেয়েছি যে, তাঁরা রমযানের সাদাকা (অর্থাৎ ফিতরা) দান করতেন খাবারের সমমূল্যের দিরহাম দিয়ে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৮, আছার ১০৩৭১)


২. কুররা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-


ﺟﺎءﻧﺎ ﻛﺘﺎﺏ ﻋﻤﺮ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ اﻟﻌﺰﻳﺰ ﻓﻲ ﺻﺪﻗﺔ اﻟﻔﻄﺮ : ﻧﺼﻒ ﺻﺎﻉ ﻋﻦ ﻛﻞ ﺇﻧﺴﺎﻥ ﺃﻭ ﻗﻴﻤﺘﻪ ﻧﺼﻒ ﺩﺭﻫﻢ


‘আমাদের নিকট সদকায়ে ফিতর সম্পর্কিত খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর পত্র পৌঁছেছে, যাতে একথা ছিল যে, প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আধা সা’ বা তার মূল্য আধা দিরহাম ফিতরা আদায় করতে হবে।’


৩. বিশিষ্ট তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বলেন-


ﻻ ﺑﺄﺱ ﺃﻥ ﺗﻌﻄﻲ اﻟﺪﺭاﻫﻢ ﻓﻲ ﺻﺪﻗﺔ اﻟﻔﻄﺮ


‘সদকাতুল ফিতর বাবদ দিরহাম আদায় করতে কোনো অসুবিধা নেই।’
[প্রাগুক্ত]


সাহাবা-তাবেয়ীনের আমল ও ফতোয়া এবং খলীফাতুল মুসলিমীনের শাহী ফরমানের আলোকে ফকীহরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, সদকাতুল ফিতর-এ খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তার মূল্য আদায় করতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং মূল্য আদায় করলে গবিবদের নানামুখী প্রয়োজন পূরণে অধিক সহায়ক হয় বিধায় একে উত্তমও বলা হয়েছে।


জাকাত ফরজ নয়, এমন ব্যক্তিকে ফিতরা দেয়া


সদকাতুল ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকে খোঁজ করেন, যাকে দেবেন তিনি জাকাত দেন কি না। জাকাতদাতা হলে তাকে ফিতরা দেবেন না; অন্যথায় দেবেন। এটি ঠিক নয়। কারণ যার ওপর জাকাত আবশ্যক নয়, তিনি সদকাতুল ফিতর গ্রহণ করতে পারবেন এমনটি জরুরি নয়। কেননা জাকাত ও সদকাতুল ফিতরের নেসাবের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং দেখতে হবে যাকে ফিতরা দেবেন তিনি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত কি না। জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে তিনি সদকাতুল ফিতরও গ্রহণ করতে পারবেন।


প্রবাসীর ফিতরা আদায় করলে সে দেশের মূল্য হিসাবে দিতে হবে। অনেকে ভিনদেশে থেকে নিজের দেশে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে চান। এজন্য স্বদেশে কাউকে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায়ের জন্য বলে দেন। এ রকম ব্যক্তির ফিতরা কোন দেশের দ্রব্যমূল্যের হিসাবে আদায় করা হবে?


মূলত ফিতরা আদায়কারী যেখানে অবস্থান করবে সেখানকার দ্রব্যমূল্যের হিসাব অনুযায়ীই ফিতরা আদায় করা নিয়ম। সুতরাং বিদেশে অবস্থানকারী ব্যক্তি তার পক্ষে দেশে ফিতরা আদায় করতে চাইলে বিদেশের হিসাব অনুযায়ী ফিতরা আদায় করতে হবে। যেমন সৌদি আরবে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি নিজের ফিতরা বাংলাদেশে আদায় করতে চাইলে সৌদির হিসাব অনুযায়ী আদায় করবেন, বাংলাদেশের হিসাবে নয়। অতএব সৌদি আরবে সর্বনিম্ন ফিতরা ২০০/- টাকা হয়ে থাকলে সৌদি প্রবাসীর পক্ষে এদেশে ২০০/- আদায় করতে হবে। আমাদের দেশের হিসাব অনুযায়ী সর্বনিম্ন ফিতরা ৭০/- টাকা আদায় করা যথেষ্ট হবে না। কারণ তিনি এদেশে নেই; বরং সৌদি আরবে রয়েছেন।


অনুরূপভাবে বিদেশে অবস্থানকারী ব্যক্তি তার দেশে অবস্থানরত নাবালেগ সন্তানদের ফিতরা দেশে আদায় করলেও বিদেশের হিসাব অনুযায়ীই আদায় করবেন; দেশের হিসাবে নয়। কারণ নাবালেগ সন্তানের ফিতরা আদায় করা বাবার ওপর ওয়াজিব। আর শরীয়তে ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে আদায়কারীর স্থানের দ্রব্যমূল্য ধর্তব্য হয়; যাদের পক্ষ হতে আদায় করা হচ্ছে তাদের স্থান ধর্তব্য হয় না।


তবে দেশে অবস্থানরত নিজের স্ত্রী ও বালেগ সন্তানদের ফিতরা আদায় করতে চাইলে দেশের হিসাব অনুযায়ী আদায় করতে পারবেন। কারণ স্ত্রী ও বালেগ সন্তানের ফিতরা তাদের নিজেদের ওপরই আবশ্যক হয়। স্বামী বা বাবার ওপর নয়। তাই তাদের ফিতরা স্বামী বা বাবা আদায় করলেও মূলত আদায়কারী তারা নিজেরাই। এজন্য তাদের অবস্থানস্থলের দ্রব্যমূল্যের হিসাবে ফিতরা আদায় করবেন।
এমনিভাবে বিদেশে অবস্থানকারী বালেগ ব্যক্তির পক্ষ থেকে কেউ যদি দেশে নিজ সম্পদ দ্বারা ফিতরা আদায় করতে চান তাহলে বিদেশের হিসাব অনুযায়ী আদায় করবেন। যেমন অনেকে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বিদেশে অবস্থান করেন। তাদের বাবা-মা বা অভিভাবক থাকেন দেশে। তাদের ফিতরা অভিভাবকরা নিজেদের সম্পদ থেকে এ দেশে আদায় করলেও বিদেশের হিসাব অনুযায়ী আদায় করবেন। কারণ এক্ষেত্রে মূলত ফিতরা ওয়াজিব হয়েছে ওই প্রবাসীর ওপর। এখন তার পক্ষ থেকে অন্য ব্যক্তি আদায় করলেও মূল আদায়কারী সেই প্রবাসী। আর ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে শরীয়তে আদায়কারীর অবস্থানস্থলের মূল্য ধর্তব্য হয়।


[আলবাহরুর রায়েক ২/৩৫৫; রদ্দুল মুহতার ২/৩৫৫; ইনায়া ২/২৮০; ফাতাওয়া দারুল উলূম যাকারিয়া ৩/২৩৪; দারুল ইফতা জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নুরী টাউন, করাচী, অনলাইন সংস্করণ।


সদকাতুল ফিতর আদায়ে এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। আমাদের উচিত, বিজ্ঞ কোনো আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করে তা আদায় করা। এতে অনেক ভুল-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাঁর হুকুম যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন।


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com