দাম্পত্য জীবন আল্লাহর বড় নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়। দাম্পত্য জীবন সুখি করতে ইসলামের নির্দেশনা খুবই জরুরি। সুখময় জীবনে একজন স্বামীর যতটুকু ভূমিকা, তারচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হয় স্ত্রীর। একজন নারী তার সব কিছু ছেড়ে চলে আসে অন্যের বাড়িতে। এটা যেমন স্বামীর মনে রাখা দরকার, ঠিক তেমনই জীবন ও সংসার সুখী করতে স্ত্রীর দায়িত্বও অনেক বড়।
ইসলাম দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে কিছু কর্তব্যের কথা বলে। আল্লাহ ও তার রসুলের দেয়া জীবন বিধান মত জীবন পরিচালনাই মানুষকে তার জীবনের সব সমস্যা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। অনেক সময় ছোট ছোট ভুলের কারণে অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনে। এর মধ্যে স্বামীরও ভুল থাকে আবার কখনো স্ত্রীরও ভুল থাকে। মানুষ যেহেতু ভুলের মাঝেই আবর্তিত, যে কারোই ভুল হতে পারে। আর ভুল করে দেখেই সে মানুষ।
ফেরেশতাদের কোনও ভুল নেই। আমরা ফেরেশতা না, আমরা মানুষ। তাই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। এটা মেনেই আমাদের জীবন চলতে হবে। তবে তাই বলে বারবার ভুল করাকে ভুল বলা হবে না। মুমিন কখনও এক গর্তে দ্বিতীয়বার পা দেয় না। তাই সবসময় সতর্ক থাকা চাই। ছোট ছোট ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে জীবন পরিচালনা করা চাই। তারপরও দাম্পত্য জীবনে আমাদের যে বিষয়গুলো অবশ্যই লক্ষণীয়, সে বিষয়েই আজ আমরা কথা বলবো।
স্ত্রী বা স্বামীকে উপেক্ষা করে চলা
ডেম কেয়ার টাইপের মানুষ জীবনে সুখী হতে পারে না। যখন দাম্পত্য জীবন শুরু করবেন, অবশ্যই আপনারা দু’জন এক আত্মা হয়ে গেলেন। একজন যা চায় অপরজনও তাই চাইতে হবে। পরামর্শ করে জীবন পরিচালনা করতে হবে। যে কোনও বিষয়ে একে অপরের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে ছাড় দিতে হবে। অনেক স্বামী নিজের বেলায় ইচ্ছামতো জীবন যাপন করে। তার ক্ষেত্রে তার কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
অথচ স্ত্রীর জন্য অনেক নিয়মকানুন বেঁধে দেয়। স্ত্রীকে পর্দা করে চলতে হবে, টেলিভিশন দেখা যাবে না, গান শোনা নিষেধ, ফেসবুক চালানো নিষেধ, বেগানা পুরুষের দিকে তাকানো একদম হারাম ইত্যাদি। অথচ নিজের বেলায় এসব সবই জায়েজ।
এমন করা একটি চরম ভুল। স্ত্রীর জন্য বিশাল বাধ্যবাধকতার ফিরিস্তি তুলে নিজের বেলায় বেমালুম ভুলে থাকা চরম বোকামি। এর মাধ্যমে সংসারের শান্তি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। স্ত্রীর জন্য যে নিয়ম স্বামীর জন্য একই নিয়ম। নিজে নিয়ম লঙ্ঘন করে স্ত্রীর কাছে নিয়ম মেনে চলার আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা কি অন্য লোকদের পুণ্যের আদেশ করো আর নিজেদের ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াতও করো। তোমরা কি এতটুকুও বোঝো না?’ (সুরা বাকারা ৪৪)
সংসার জীবনে স্ত্রীকে সময় না দেয়া
স্ত্রীকে সময় না দেয়া একটি বড় ভুল। তাকে উপেক্ষা করে চলাও আরও বড় ভুল। মনে রাখতে হবে স্ত্রী মানে আপনার অর্ধেক। স্বামী আপনার অর্ধেক। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আদম আ. থেকেই স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এটা বুঝানোর জন্যই যে, স্বামী-স্ত্রী এক মন এক দেহ হিসেবে থাকতে হবে। তার সঙ্গে বসলেই মন খারাপ করে কথা বলা, তাকে সময় না দেয়া। এগুলো আমাদের যুবসমাজের অনেকের মধ্যেই আছে। অথচ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খোশগল্প ইত্যাদি সবই চলে আনন্দচিত্তে।
কিন্তু নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার একদম ফুরসত হয় না। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ঘরে আসার কারণে নিজের সংসারকে ধীরে ধীরে প্রাণহীন করে তোলে। একসময় স্ত্রী যখন বুঝতে পারে তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না, তখন সেও স্বামীকে মূল্যায়ন করে না। এভাবেই ক্রমেই ঝাগড়া-ঝাটি ও শেষে বিচ্ছেদের দিকে গড়ায়। তাই ছোট ছোট ভুল থেকেই বেঁচে থাকতে হবে।
নবীজি সা. জাবির রা.-কে বলেন, ‘কুমারী বিয়ে করলে না কেন? তুমি তার সঙ্গে খেলতে, সেও তোমার সঙ্গে খেলত। তুমি তাকে হাসাতে, সেও তোমাকে হাসাত।’ (বুখারি ৫৩৬৭)
কথায় কথায় স্ত্রীকে অপমান করা
স্ত্রীর সামান্য দোষ ত্রুটি দেখলেই তাকে অপমান করা। কিংবা বকাঝকা করা, এটি অত্যন্ত ঘৃণিত স্বভাব। সংসার জীবনে মারাত্মক ভুল। স্বামী হয়ত মনে মনে ভাবে যে এর মাধ্যমে তার বীরত্ব প্রকাশ পায়, তার পরিবার স্ত্রী তার সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ আর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অথচ বাস্তবে নিজের স্ত্রীর কাছে সে একজন ছোটলোক হিসেবেই ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে। রসুল সা. কোনও দিন তার স্ত্রীদের ধমক পর্যন্ত দেননি। সম্মানের সবচেয়ে বড় স্থানটি তাদের জন্য ছিলো।
প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তিত্ব রয়েছে, আত্মমর্যাদা আছে। কারো ব্যক্তিত্বে আঘাত করা কিংবা আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা দ্বারা তার অন্তর ভেঙে দেয়। এটি গর্হিত অন্যায় অপরাধ। এ জন্য যারা বুদ্ধিমান, তারা কখনো স্ত্রীকে অপমান করে না।
একবার রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বলেন হে আয়েশ! (রসুল সা.-এর আদরের ডাক) জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এই মাত্র তোমাকে সালাম দিয়ে গেল। (বুখারি ৩৭৬৮, মুসলিম ৮৯৭৫)
এভাবে মাঝে মাঝে বিভিন্নভাবে স্ত্রীদের আনন্দ দিতেন রসুল সা.। তিনি আল্লাহর রসুল। আর তার স্ত্রীকে সম্মান দেয়া হবে না এটা অসম্ভব। তাই তার মর্যাদা বোঝানোর জন্যও জিবরাঈল আ. এর সালাম জানানোর বিষয়টা খুবই সুন্দর।
মুসলিম উম্মতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিপূর্ণ চরিত্র, সর্বোত্তম আদর্শ ও সুমহান মর্যাদার অধিকারী। দাম্পত্য জীবনের সর্বোত্তম নমুনা, নরম প্রকৃতি স্ত্রীর প্রকৃত আবেগ, অনুভূতি ও চাহিদা সম্পর্কে সম্যক অভিহিত ছিলেন তিনি।
তিনি স্ত্রীদেরকে এমন অবস্থান প্রদান করেন যা প্রত্যেক নারীই পছন্দ করবে, যার ফলে স্বামীর নিকট সে তার অর্ধাঙ্গিনীতে পরিণত হতে পারে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি ঋতু স্রাবের অবস্থায় কিছু পান করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিতাম, আর তিনি আমার মুখ রাখার স্থানে মুখ রেখে পান করতেন, আমি হাড়ের মাংস খেয়ে শেষ করলে তিনি তা গ্রহণ করে আমার মুখ লাগানোর স্থানেই মুখ লাগাতেন। (মুসলিম ৩০০)
দোষ ধরার প্রবণতা
দাম্পত্য জীবন নষ্ট হওয়ার আরেকটি মূল কারণ, ছোট ছোট বিষয়ে স্ত্রীর ভুল ধরা এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করা। অথচ একজন আদর্শ স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ছোটখাটো ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। ভুল ধরার প্রবণতা ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হতে থাকে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কোনো মুমিন পুরুষ কোনো মুমিন নারীর প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা পোষণ করবে না (কেননা) তার কোনও চরিত্র অভ্যাসকে অপছন্দ করলে তার অন্য কোনোটি (চরিত্র-অভ্যাস) সে পছন্দ করবে। (মুসলিম ৩৫৪০)
আত্মীয়র সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা
স্ত্রীকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার আত্মীয়-স্বজনদেরও ভালোবাসা। স্বামীকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মীয়দেরকেও ভালোবাসা। এটাই প্রকৃত মানুষের পরিচায়ক। তাদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ না রাখা স্বামীর কর্তব্য। স্বামী যদি স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ রাখে, তাহলে ওই স্ত্রীর মনের অবস্থা কী হবে?
এ জন্য স্ত্রীর মা-বাবা, ভাই-বোনসহ সবাইকে সম্মান করা। তাদের ব্যাপারে কোনো উল্টাপাল্টা মন্তব্য করলে এর কারণে স্ত্রী চরমভাবে আঘাত পায়। এ জন্য স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য শ্বশুর-শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করা। ইসলাম শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতামাতার মর্যাদা দিয়েছে। তাই স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতার চোখে দেখা। এর মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
মিথ্যা অপবাদ দেয়া
অহেতুক স্ত্রীকে সন্দেহ করা। স্বামীকে সন্দেহ করা। এটি এমন এক ব্যাধি, এর কারণে কত সংসার তছনছ হয়ে গেছে, আল্লাহ মালুম। এ জন্য কোনও ব্যাপারে সুনিশ্চিত স্পষ্ট না হলে সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকা। অপবাদ এমন এক জিনিস, যা সহ্য করার ক্ষমতা কেউ-ই রাখে না। সামান্য কোনো কিছু হলেই স্ত্রীকে সন্দেহ করা। স্ত্রী আড়ালে গিয়ে কথা বললে সন্দেহ করা। কিছু হলেই স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেয়। যদি ছেলে কথা না শুনে, তাহলে বলে যে তোমার কারণে আজ ছেলে এমন হয়েছে, এসব বলে স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত অপবাদে জর্জরিত করা। এগুলোর কারণে স্ত্রীর মন ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। এ জন্য একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব এগুলো গুরুত্বসহকারে মেনে চলা।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কোনও কোনও ধারণা পাপ।’ (সুরা হুজুরাত ১২)
বিবার্তা/মাসুম
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]