কোরআন হাদিসের আলোকে দানের ফজিলত
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:২৩
কোরআন হাদিসের আলোকে দানের ফজিলত
ধর্ম ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

দান সদকায় অনেক উপকার। জীবনের নানা সমস্যার সমাধান হয় দানে। দান করলে ধন বাড়ে। আবার দান করলে বিপদ আপদ দূর হয়। দানে রোগবালাই থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। তাই ইসলাম দান সদকার প্রতি অনেক অনেক বেশি গুরুত্বারূপ করে। নবীজিও উম্মতকে বেশি বেশি দান করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। দানে কখনো ধন কমে না বলেও ঘোষণা করেছেন।


রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সাদকা করলে কোনও মানুষের সম্পদ কমে না। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। দানের ফলে বিপদ আপদ দূর হয়। মানুষের কল্যাণে নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় বা প্রদান করাকে দান বলা হয়।


হযরত সালেম রা. হতে বর্ণিত, রসুল সা. বলেন, শুধু দু’জন লোকের ওপর ঈর্ষা করা যায়। একজন হলেন সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের জ্ঞান দিয়েছেন আর সে রাত দিন তা চর্চা করে। অপরজন হলেন যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন আর রাতদিন সে তা মানব কল্যাণে খরচ করে। (বুখারি)


দানের প্রতিদান আল্লাহ প্রদান করেন, কেননা আল্লাহ বলেন, তোমরা যারা আল্লাহর রাস্তায় দান করবে তার প্রতিদান তোমাদেরকে পুরাপুরি দেয়া হবে। আর তোমাদের প্রতি কোনও প্রকার জুলুম করা হবে না। (সুরা আনফাল ৬০)


দানের ফজিলত ও ঘটনা


দানে ধন বাড়ে, দান করলে যে বালা মুসিবত থেকে মুক্ত থাকা যায় সেরকম একটি ঘটনা বলছি, আল্লাহর নবী ও গোটা দুনিয়ার বাদশাহ হযরত সুলাইমান আ.-এর যুগের একটি ঘটনা। এক ব্যক্তির বাড়ির পাশে ছিল একটি গাছ। সেই গাছে ছিল একটি পাখির বাসা।


সেই বাসায় পাখিটি যখনই ডিম দিত তখনই লোকটি তা নিয়ে খেয়ে ফেলত। লোকটির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন পাখিটি হযরত সুলাইমান আ.-এর কাছে অভিযোগ করল। সুলাইমান আ. লোকটিকে ডেকে নিষেধ করে বললেন, আর কোনও দিন যেন এ পাখির ডিম সে না খায়। হযরত সুলাইমান আ.-এর নিষেধ অমান্য করে লোকটি আবারো পাখির ডিম খেয়ে ফেলল। নিরুপায় হয়ে পাখিটি পুনরায় হযরত সুলাইমান আ.-এর কাছে অভিযোগ করল।


হযরত সুলাইমান আ. এক জিনকে নির্দেশ দিলেন- লোকটি এবার যখন গাছে চড়বে, তখন খুব জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে যেন নিচে ফেলে দেয়, যাতে লোকটি আর কোনও দিন গাছে চড়তে না পারে। এর পর একদিন লোকটি পাখির ডিমের জন্য গাছে উঠতে যাবে, এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে হাঁক দিল বাবা! কিছু ভিক্ষা দিন।


তখন লোকটি প্রথমে ভিক্ষুককে এক মুষ্টি খাবার দান করল। তারপর শান্ত মনে গাছে থেকে ডিম নামিয়ে খেয়ে ফেলল। পাখিটি আবার সুলাইমান আ.-এর কাছে অভিযোগ করল। সুলাইমান আ. সেই জিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নির্দেশ পালন করলে না কেন? তখন জিন জবাব দিল, আমি আপনার নির্দেশ পালন করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।


এমন সময় পূর্ব ও পশ্চিম থেকে দুজন ফেরেস্তা এসে আমাকে অনেক দূরে ফেলে দিল। হযরত সুলাইমান আ. বিস্মিত হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, জিনটি বলল, আমি দেখলাম, লোকটি গাছে ওঠার আগে এক ভিক্ষুককে এক মুষ্টি খাবার দান করল। সম্ভবত এর বরকতে আল্লাহপাক তাকে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। হযরত সুলাইমান আ. বললেন, হ্যাঁ সদকা বালা-মুসিবত দূর করে। এ কারণেই সে তখন মহাবিপদ থেকে বেঁচে গেছে। (তাজকিরাতুল আম্বিয়া)


কোরআন হাদিসের আলোকে দানের ফজিলত


দানের বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামি পবিত্র কোরআনে বলেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারা ২৬১ )


হযরত আবু বকর রা. এর খিলাফতকালে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যদ্রব্য একেবারেই দুর্লভ হয়ে পড়ে। মানুষের দুঃখ দুর্দশা চরম আকার ধারণ করে। সেই সময় হযরত ওসমান রা. এর প্রায় এক হাজার মন গমের একটি চালান বিদেশ হতে মদিনায় পৌঁছায়। শহরের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী হযরত ওসমান রা. এর কাছে এলেন। তারা তার সমস্ত গমের চালান অর্ধশতভাগ লাভে ক্রয় করার প্রস্তাব দেয়। সেই সাথে তারা এটাও প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্যই এই গম ক্রয় করতে চান।


হযরত ওসমান রা. বললেন, তোমরা যদি আমাকে এক হাজার গুণ লাভ দিতে পারো, তবে আমি দিতে পারি। কেননা অন্য একজন আমাকে সাতশো গুণ লাভ দিতে চেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বললো, বলেন কি? চালান মদিনায় আসার পর তো আমরাই প্রথম এলাম আপনার কাছে। সাতশো গুণ লাভের প্রস্তাব কে কখন দিয়েছেন?


হযরত ওসমান বললেন, এই প্রস্তাব আমি পেয়েছি আল্লাহর কাছ থেকে। আমি এই চালানের সমস্ত গম বিনামূল্যে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করবো। এর বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে সাতশো গুণ বেশি পুণ্য দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তখন হযরত ওসমান রা. কুরআনের এ আয়াত তাদের স্মরণ করিয়ে দেন।


রসুলুল্লাহ সা. বলেন, মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার। যা খেয়ে শেষ করেছে, যা পরিধান করে নষ্ট করেছে আর যা দান করে জমা করেছে তাই শুধু তার। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা শুধু নিয়ে যাবে। (মুসলিম)


হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য দোয়া করে, বলো, হে আল্লাহ দানকারীর মালে বিনিময় দান কর। (বিনিময় সম্পদ বৃদ্ধি কর) আর দ্বিতীয়জন কৃপণের জন্য বদ দোয়া করে বলেন, হে আল্লাহ কৃপণের মালে ধ্বংস দাও। (বুখারি ও মুসলিম)


আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং যা ব্যয় করে তা চর্চা করে বেড়ায় না এবং কষ্টও দেয় না, তাদের জন্য তাদের পালন কর্তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হবে না।’ (সুরা বাকারাহ ২৬২)।


মসজিদে দান করার ফজিলত


মসজিদে দান করার বা মসজিদ নির্মাণ করার ফজিলত অপরিসীম। মসজিদে দান করার হাদিস সমূহের মধ্যে থেকে অন্যতম একটি হাদিস হলো, হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, মহান আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করে দেবেন।’ (বুখারি ৪৫০)


মসজিদে দান করার হাদিস সমূহের মধ্য থেকে অন্য আরেকটি হাদিস হলো, হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিনদের যেসমস্ত আমলের ধারা মৃত্যুর পরও চলমান থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো, ১. সেই ইলম যা সে প্রসার করে গেছে। ২. রেখে যাওয়া নেক সন্তান। ৩. রেখে যাওয়া কুরআনের কপি। ৪. তার নির্মাণকৃত মসজিদ। ৫. তার নির্মাণ করে যাওয়া মুসাফিরখানা। ৬. তার স্থাপন করে যাওয়া নলকূপ। ৭. ওই সাদাকা, যা বেঁচে থাকতে সে দান করে গেছে।


মসজিদ নির্মাণ করতে হবে, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। মসজিদ নিয়ে অহংকার করা কিয়ামতের আলামত। লোকেরা মসজিদ নিয়ে পরস্পর গৌরব ও অহংকারে মেতে না উঠা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। (আবু দাউদ ৪৪৯) তাই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় মসজিদ নির্মাণ করা। কারো সেই সামর্থ্য না থাকলে কমপক্ষে সহযোগিতা করবে। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণে আত্মনিয়োগ করবে। মসজিদকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় করে রাখবে।


হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করার আর তা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ ৪৫৫)


দান সদকার ফজিলত


সর্বোপরি দানে রোগ, বালা-মুসিবত থেকে বেঁচে থাকা যায়, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সা. বলেন, ‘তোমরা অধিক হারে সদকা করো। কেননা বালা-মুসিবত সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না।’ (বায়হাকি ৮০৮৩)


আল্লাহর রাস্তায় দান করার ফজিলত


হাদিসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বোখারি শরিফের আরেকটি হাদিস থেকে জানা যায়, দানে অযাচিত ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত থাকা যায়। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. এর সময় একবার সূর্যগ্রহণ হলো। তখন রাসুল সা. লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি লোকজনের উদ্দেশে খুতবা দান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করেন।


অতঃপর তিনি বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করবে আর সালাত আদায় করবে ও সদকা প্রদান করবে।’ (বুখারি ১০৪৪)


হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রত্যেক দিন যাতে সূর্য উদিত হয়, তাতে মানুষের দেহের প্রতিটি জোড়া হতে একটি মানুষের প্রত্যেক জোড়ার প্রতি সাদ্কা রয়েছে।


প্রতিদিন যাতে সূর্য উদিত হয়। দু’জন লোকের মধ্যে সুবিচার করাও সাদ্কা। কাউকে সাহায্য করে সাওয়ারিতে আরোহণ করিয়ে দেয়া বা তার উপরে তার মালপত্র তুলে দেয়াও সাদ্কা। ভাল কথাও সাদ্কা। নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে পথ চলায় প্রতিটি কদমেও সাদ্কা। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করাও সাদ্কা। (বুখারি ২৭৮১)


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com