
সংযমের ব্যক্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষ সাধারণত কামনা বাসনা প্রবণ। সাময়িক ও বৈষয়িক আনন্দ বিনোদন আর ভোগ চর্চার মধ্য দিয়ে এই প্রবণতার প্রকাশ ঘটে। অন্য সকল জীবের তুলনায় মানুষই একমাত্র জীব- যার চাহিদা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, ও বিনোদনের সীমা পরিসীমা নেই; বরং ভোগ লিপ্সা চরিতার্থ করার বহুমাত্রিক পথ-উপপথ রয়েছে। ভোগ আর বাসনার এই অন্তহীন যাত্রা সুখকর নয় বিধায় এর লাগাম টেনে ধরার জন্য বহু ধর্ম ও বহু মতবাদ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উপদেশ ও বিধান হাজির করেছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইহুদী ধর্ম এমনকি বৌদ্ধ ধর্ম সংযম সাধনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য, মানুষের মনোজগতে চেপে বসা ভোগলিপ্সার অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রন করা।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই ধরণের নিয়ন্ত্রণকে এক ধরণের মানসিক অবদমন হিসেবে দেখেন। কারণ, ফ্রয়েডের মতে, মানুষ আনন্দ বিনোদন আর ইন্দ্রিয়ের চাহিদা পূরণ করতে চায়। কিন্তু ধর্ম যখন সিয়াম বা উপবাসব্রত পালনের মধ্য দিয়ে সংযমের অভ্যাস করাতে চায় তখন ব্যক্তির কামনা বাসনার প্রতাপ দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যক্তি চায় এখনই সুখ, ধর্ম বলছে সমাজের চিন্তা করে সংযম করো। এই দুই চাওয়ার মধ্যে যখন সম্মিলন না হয়, তখন ব্যক্তি মানসিক অবদমনের শিকার হয়। এতে করে প্রতিটি মানুষ মানসিক অশান্তির মধ্যে বসবাস করে। ফ্রয়েডের এই ধারণার পুরো বিপরীতে অবস্থান করে বৌদ্ধ ধর্ম।
বৌদ্ধ ধর্মের বয়ান হলো, পার্থিব জীবনে মানুষের সমস্ত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার উৎসই হলো ব্যক্তির কামনা বাসনা আর পার্থিব বিষয়াদির প্রতি মোহ। এই ধর্ম বলছে, ভোগ তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা (বিভব তৃষ্ণা মানে এই পার্থিব জীবনকে ভোগের একমাত্র ক্ষেত্র মনে করা) মানুষের মধ্যে এতোটাই সক্রিয়ভাবে প্রভাববিস্তার করে যে, তৃষ্ণা মেটাবার জন্য যতই চেষ্টা চালায় ততই তৃষ্ণা বাড়তে থাকে। ভোগের এই তৃষ্ণার কোন অন্ত নেই বলে এই সাধনায় অতৃপ্তিই অধিক।
এ কারণে বৌদ্ধ ধর্ম ফ্রয়েডের চিন্তার বিপরীতে এসে কামনা বাসনার এই লিপ্সাকেই মানসিক অশান্তি ও দুঃখের অন্যতম কারণ বলে সাব্যস্ত করে। বৌদ্ধ ধর্ম বলছে, ভোগের এই তৃষ্ণাকে বশীভূত করতে না পারলে সুখ ও মুক্তি সম্ভব নয়। সেজন্য উপোসথ বা উপবাসব্রত পালন করার মধ্য দিয়ে সংযমী হতে এই ধর্ম সবাইকে আহবান জানায়। এছাড়াও হিন্দু ধর্মের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে “সংযত চিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি এবং অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে .........ভগবানের কৃপা লাভ করে” (শ্লোক, ৬৪)।
ব্যক্তির দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য অথবা ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য সংযম কার্যকর পন্থা হলেও এর সামাজিক উপযোগিতা রয়েছে। বস্তুগত বিষয়াদির প্রতি মানুষের যে মোহাচ্ছন্ন মনোভাব—তা থেকে মুক্ত হলে মানুষ খুব সহজেই অপরের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হবে। যে মানুষ সামাজিক বন্ধন আর ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্যে সামাজিক ও মানবিক প্রাণ খুঁজে পায়, সে মানুষ সংযমী হবে। এর বিপরীতে অসংযমী মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিজ ভাই বোনদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তৎপর থাকে। এর ফলে, পারিবারিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।
শুধু তাই নয়, মানুষ কতটা অসংযমী হলে সুযোগ পেলেই অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে, দুর্নীতি করে রাতারাতি বিলাস ব্যাসনের ভোগ কর্মে নিমজ্জিত হতে চায়। এতে করে মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলো নিচক ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হয়। অথচ সংযমী মানুষ নিজে কম ভোগ করে হলেও অপরের সমস্যা ও অপরের বঞ্চনা কমানোর জন্য কাজ করে।
তবে, সন্ন্যাসবাদীরা যে ধরণের সংযমের চর্চা করে, তাতে জনগণ ক্ষতির শিকার হয় না সত্য; কিন্তু জনগণের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকাও রাখতে পারে না। এছাড়াও এক ধরণের সুফীবাদী আছে, যারা সংযম সাধনা করে পরকালে অফুরন্ত পুরস্কারের আশায়, তাদের উদাহরণ হতে পারে ব্যবসায়ীদের মত; যারা সঞ্চয় করে ভবিষ্যতে অধিক মুনাফার আশায়। তারা জানে না, সংযমের ব্যক্তিক ও সামাজিক উপযোগিতা কি! ফলে সংযম আনুষ্ঠানিকতা আর বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
এমন মনোভাবের কারণে আমাদের সমাজে সংযম সাধনা আর ভোগ সাধনার মধ্যে পার্থক্য রচনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ‘দিনে সংযম মানে রাতে অধিক ভোগ, আর এক মাসের সংযম মানে বাকী এগার মাস অধিক ভোগ’ এই যদি হয় সংযমের নীতি, তাহলে ভোগ সাধনার মানে দাঁড়ায় ইহকালীন বাস্তব ভোগ আর সংযম সাধনার মানে পরকালে অধিক ভোগের প্রত্যাশা। এই যাদের নীতি, তাদের পক্ষে সমাজ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ সম্ভব নয়। অনেকক্ষেত্রে এই ভোগধর্মী সংস্কৃতি নীতি আদর্শহীন সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে।
সংযম সাধনার যে ডিসকোর্স সমাজে চালু আছে, সেই ডিসকোর্সই এমন নীতিহীন ভোগধর্মী প্রবণতাকে আরো শানিত করে। যখন বয়ান হয় ‘এক মাস সিয়াম পালন করলে অতীতের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, আর জান্নাতের দরজা খুলে যাবে’—তখন বিশ্বাসীরা সেই আশায় সিয়াম বা রোজা পালন করে। পালনকারীরা মনে করে, এই সংযম পাপ মোচন করবে আর পরকালে ভোগ শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করবে। এও মনে করে যে, এ তো মাত্র এক মাসের জন্য। তখন কষ্ট করে চেহারা মলিন করে সাময়িক সংযমে মাস পার করলেও তারা সেই আগের ভোগ সাধনায় মনোনিবেশ করে। এ ধরণের মানুষ মানসিকভাবে উচ্চমাত্রার ভোগপিয়াসী।
ভোগপ্রবণ এই মানসিকতার কারণে ‘রোজাদার’ ব্যবসায়ী রোজা রাখছে পরকালে ভোগের আশায়, আর পন্য বিক্রি করছে অধিক মুনাফার আশায়। ভোগাক্রান্ত এই সমাজে রমজান মাসেও ভোগের চাহিদা বেড়ে যায়; এই সুযোগে ভোক্তার চাহিদাকে পুঁজি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের দাম সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করা হয়। কি করে পুরো মাস রোজা রাখবে, এই মানসিক অস্থিরতা থেকে সাধারণ মানুষের ভোগের চাহিদা বেড়ে যায়।
অনেকেই পুরো মাসের জন্য আগেই বেশি পরিমানে পন্য ক্রয় করে মজুদ রাখে। সংযমের এই মাসে নিশাভোগের মাত্রা বৃদ্ধির এই প্রয়াসকে ব্যবসায়ীরা কাজে লাগায়। ফলে যাদের হাতে অর্থকড়ি বেশি অথবা যারা বৈধ অবৈধ মিলিয়ে অধিক উপার্জন করে, তাদের অতিভোগ আর অভাবীদের অল্প ভোগের মধ্য দিয়ে এক মাসের ‘সিয়াম সাধনা’ শেষ হয়। বরং অভাবীদের জন্য এই মাস আরো বেশি কষ্টের। কেননা, এই মাসে অল্প আয়ের মানুষ বা অভাবীদের পক্ষে মাত্রাধিক মূল্যস্ফীতির সাথে খাপ খেয়ে চলা আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। এর মানে, ভোগপ্রবণ মানসিকতা যাদের মধ্যে প্রবল তাদের মধ্যে যারা অধিক সচ্ছল, তারা অন্যান্য মাসের মত রোজার মাসকেও ভোগের মাস বানিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, অসচ্ছল মানুষেরা রোজার মাসসহ পুরো বছরই সংযমের মধ্যে কাটাতে বাধ্য হয়।
পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে, ভোগ সংস্কৃতির প্রতি মানুষের মোহাচ্ছনতা এমনিতেই বেড়ে চলছে। সেই মোহাচ্ছন্নতার প্রভাবে ‘সংযম সাধনা’ দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু ভোগের সাধনা আরো বেশি ব্যাপকতা লাভ করেছে। এর বাহ্যিক কারণ পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন হলেও, অন্তর্নিহিত কারণ মানুষের ভোগপ্রবণ মানসিকতা এবং সংযমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ক দর্শনের অনুপস্থিতি।
ড. আশেক মাহমুদ (সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)
বিবার্তা/এহসান/মাসুম
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]