১০ জানুয়ারি, বাঙালি জাতির জীবনে এক স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করে তার আজীবন লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটিই ঐতিহাসিক ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ দিবস নামে স্থান করে নিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে রক্তের হোলিখেলা শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
পাকিস্তানি হায়েনারা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখলেই মুক্তি সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে আসবে বাঙালিরা কিন্তু আশ্চর্য বন্দি মুজিব আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। রণাঙ্গণে প্রতিজন যোদ্ধাই হয়ে উঠলেই এক একজন মুজিব। তার নামেই পরিচালিত হল মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের কারাগারে গোপন বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু’র ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছিল এবং কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীর স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অকুতোভয় ও দৃঢ় অবিচল। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালবাসার কারণে পাকিস্তানি সামরিক হায়েনার অত্যাচার তাঁকে ভীত করতে পারে নাই। মুক্তিপাগল বাঙালীর সকল আবেগ-উচ্ছ্বাস নিজের মাঝে ঠাঁই দিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিব বাঙালির ভালবাসার গণ্ডি ছাড়িয়ে সারাবিশ্বের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মুক্তিকামী মানুষের আস্থা অর্জন করে নেন। ফলে বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে ভয় পায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী-জীবনপণ যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু পিআইয়ের একটু বিশেষ বিমানে লন্ডন পৌঁছান। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হলেও সে বিজয় পরিপূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর আজন্ম প্রেম, প্রিয় স্বদেশভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে।
স্বদেশে ফিরে আসার পূর্বে ৮ জানুয়ারি তিনি লন্ডনে পৌঁছানোর পর সেখানে সাংবাদিকদের দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, “পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হওয়ার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে দেশদ্রোহীর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন।”
দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন “I was mentally ready for that. And the man who is ready to die nobody can kill him remember one thing.”
আরও বলেছিলেন “আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।”
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে আসার পূর্বে নয়াদিল্লীতে ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর ভাষণে বলেছিলেন “এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা।”
অবশেষে সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে এসে জনতার মাঝে দাঁড়ান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেয়ার অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। সেই দিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত আমাদের যাদের সামনে থেকে দৈখার সৌভাগ্য হয় নাই তারা ভিডিওতে দেখেছি কী অপার্থিব আনন্দে বাংলাদেশের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামল তাঁর দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন রেসকোর্সে জমায়েত হওয়া ১০ লাখ মানুষের সাথে সারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ-বাতাস।
কান্না জড়ানো কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে, আমার বাংলাদেশ চিরদিন থাকবে।”
তিনি বলেছিলেন, “আমি জানতাম না আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসবো, আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম- তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও, এই একটা অনুরোধ থাকলো তোমাদের প্রতি আমার।”
লাখো জনতার সামনে দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য, আমি যেন এই চেষ্টা করে মরতে পারি। এই দোয়া, এই আশীর্বাদ আপনারা আমারে করবেন।”
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত একটা জাতির মনে নতুন আশার আলো নিয়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আসেন সকলের প্রিয় বঙ্গবন্ধু, ফিরে আসেন এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ।
লেখক: গুলশাহানা ঊর্মি
বিসিএস (তথ্য)
সংযুক্তি- প্রেস উইং, প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়।
বিবার্তা/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]