অনন্য পর্যটন কেন্দ্র ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘পুঠিয়া রাজবাড়ি’
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৩৮
অনন্য পর্যটন কেন্দ্র ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘পুঠিয়া রাজবাড়ি’
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

পুঠিয়া রাজবাড়ি রাজশাহীর অনন্য পর্যটন কেন্দ্র। কেবল রাজশাহী নয়, দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও প্রতিদিন ছুটে আসছেন এর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের টানে।


এই রাজবাড়ির বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন তারা। এটি সমানভাবে সমৃদ্ধ করছে দেশের ইতিহাস গবেষকদেরও।


জনশ্রুতি রয়েছে- জনৈক নীলাম্বর সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করার পর এটি 'পুঠিয়া রাজবাড়ি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর আগে ১৫৫০ সালে বৎসাচার্যের পুত্র পিতাম্বর রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন।


১৭৪৪ সালে এই জমিদারি ভাগ হয়। সেই ভাগাভাগিতে জমিদারের বড় ছেলে পান সম্পত্তির সাড়ে পাঁচআনা এবং অন্য তিন ছেলে পান সাড়ে তিনআনা। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা ছিল। প্রথা বিলুপ্ত হলে পুঠিয়া রাজবাড়ির জমিদারিও বিলুপ্ত হয়।


কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও সেই আমলে তাদের নির্মিত রাজপ্রাসাদ মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ক্ষয়ে ক্ষয়ে টিকে আছে আজও।


রাজবাড়ি চত্বরটি রয়েছে ৪ দশমিক ৩১ একর আয়তনের জমির ওপর। ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ রাজবাড়িটি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তাই পুঠিয়া রাজবাড়িটি এখন জাদুঘর। পর্যটক ও স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্য অনেকটা নতুন করেই সাজানো হচ্ছে ঐতিহাসিক এই রাজবাড়িটি।


পুরোনো অবকাঠামো ঠিকঠাক রেখেই ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হচ্ছে পুরো রাজবাড়িটি। এখন এটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।


বর্তমানে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত সিন্দুক, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় আসবাবপত্র। তাই জাদুঘরটি দেখতে রোজই মানুষের ঢল নামছে। আর ঈদসহ যে কোনো বড় উপলক্ষে জাদুঘরটি দর্শনার্থী ও পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। মাত্র ৩০ টাকা দর্শনীয় বিনিময়ে দিনভরই পুঠিয়া রাজবাড়ির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন আগত দর্শনার্থীরা।


বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এখানকার পুরাকীর্তিগুলোতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময় সন্ধ্যার পরেও রাজবাড়ি দেখতে বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী ভিড় জমান।


আর এখানে কেবল প্রাচীন রাজবাড়িই নয় রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দিরও। তবে আসলে যেই প্রাসাদটি সবাই পুঠিয়া রাজবাড়ি হিসেবে চেনেন বা জানেন, সেটি কিন্তু পুরোনো সেই রাজবাড়ি নয়। এটি নির্মাণ করা হয়েছিল অনেক পরে।


রাজবাড়ির সামনের সুদৃশ্য স্তম্ভ, অলংকরণ, কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়াল, ফুল ও লতাপাতার সরব উপস্থিত এক নান্দনিক নির্মাণশৈলীর পরিচয় বহন করছে। যার অনুপম সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য আজও পর্যটকদের বিমোহিত করে চলেছে। রাজবাড়ির ছাদ সমতল। ছাদে লোহার বিম, কাঠের বর্গা ও টালি ব্যবহৃত হয়েছে। আর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রাজবাড়ির চারপাশে ওই সময় পরিখা (দীঘি) খনন করা হয়েছিল।


ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি বা পাঁচআনি রাজবাড়ি হচ্ছে- পুঠিয়ার মহারানি হেমন্ত কুমারী দেবীর বাসভবন। আগে থেকেই এখানকার আশপাশে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ থাকলেও ১৮৯৫ সালে আকর্ষণীয় ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে আয়তাকার দ্বিতল রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী।


পাঁচআনির রাজ পরগনার রাজা ছিলেন পরেশ নারায়ণ। তার স্ত্রী ছিলেন মহারানি হেমন্তকুমারি দেবী। রাজার নাম তেমনভাবে কেউ না জানলেও উদার ব্যক্তিত্ব কর্মগুণ ও দানশীলতার জন্য ইতিহাসে আজও ভাস্বর হয়ে আছেন মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী।


প্রজাবাৎসল ও দানশীল রানি হিসেবে তাই মহারানি হেমন্ত কুমারীর নাম এখনও রয়েছে রাজশাহীর মানুষের মুখে মুখে।


রাজশাহীর প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলেও উঠে আসে তার নাম। রাজশাহীতে ঢোপকল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পানিজনিত মহামারির হাত থেকে এখানকার মানুষকে পরিত্রাণ দিতে তার অবদান আজও কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করা হয়। কালের আবর্তে ঐতিহ্যবাহী সেই ঢোপকল আজ বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার নাম থেকে গেছে।


আর পুরোনো রাজবাড়ির সামনের অংশে নতুন এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন, তার শাশুড়ি মহারানি শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে।


সপ্তদশ শতকে মুঘল আমলে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পুঠিয়া রাজবাড়ী ছিল সবচেয়ে প্রাচীন।


হেমন্তকুমারী রানি কর্তৃক খনন করা রাজবাড়ি ঘেঁষা শ্যামসাগর দীঘির পাড়েই রয়েছে চারআনি স্টেট। এটি পরেশ নারায়ণের ছোট ভাই নরেশ নারায়ণের রাজপ্রসাদ।


রাজপ্রথা বিলুপ্তের পর চারআনী রাজপ্রাসাদটি এক প্রকার পরিত্যক্ত বাড়ি হিসেবেই পড়ে রয়েছে। আর পুঠিয়া রাজবাড়ির বেশিরভাগ স্থাপনাই রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে।


এগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করে। তবে মামলা জটিলতার কারণে চারআনি এস্টেটের রাজপ্রাসাদটি এখন পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিতে পারেনি। তাই অযত্নেও অবহেলায় এই রাজবাড়িটির ধ্বংসাবশেষটুকুই রয়েছে।


রাজবাড়ির আশেপাশে ছয় একর আয়তনের ছয়টি দিঘী রয়েছে। রাজবাড়ি ছাড়াও পুঠিয়ার রাজাদের স্মৃতি বিজড়িত বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, বড় শিবমন্দির, ছোট শিবমন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, জগদ্ধাত্রী মন্দির, দোল মন্দির, রথ মন্দির, গোপাল মন্দির, সালামের মঠ, খিতিশচন্দ্রের মঠ, কেষ্ট খেপার মঠ, হাওয়া খানাসহ ১৫টি প্রাচীন স্থাপনা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আর প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই অপূর্ব সব পোড়ামাটির কারুকাজ।
পোড়ামাটির মাধ্যমে পৌরাণিক কাহিনীর সব চিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এর চারটি কক্ষে রাজবাড়ির বিভিন্ন সামগ্রী ছাড়াও রাখা হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে পাওয়া বিভিন্ন মূর্তি ও প্রত্ন নিদর্শন। আরও রয়েছে রানীর স্নানের ঘাট ও অন্দর মহল।


সব মিলিয়ে এই রাজবাড়ি প্রাঙ্গণটি বিশাল। ভালোভাবে ঘুরে দেখতে হলে অন্তত একবেলা সময় গড়িয়ে যাবে। এখানে প্রবেশ করতে কাটতে হয় ৩০ টাকার টিকিট। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা হয় ১৫ টাকা।


রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম নূর হোসেন নির্ঝর বলেন, পুঠিয়া ঐতিহ্য ঐতিহাসিক রাজবাড়ীটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করছে। রাজবাড়ীটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছ। এখানে প্রচুর সংখ্যক দর্শনার্থী ও পর্যটক আসেন। তাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই রাজবাড়ির সার্বিক নিরাপত্তা দেখভাল করা হয়। এখানকার রাজারা ভারতে চলে যাওয়ার পর তাদের প্রতিষ্ঠিত পিএন হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ রাজাদের আসবাব ও সিন্দুক নিয়ে স্কুলে রেখেছিলেন। সেখান থেকে কিছু জিনিস ইউএনও কার্যালয়েও রাখা হয়েছিল। জাদুঘর হওয়ার পর সেই আসবাব ও সিন্দুকগুলো আবারও রাজবাড়ি জাদুঘরেই হস্তান্তর করা হয়েছে।


এগুলো প্রদর্শন হচ্ছে বলেও জানান তিনি।


প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজবাড়ি দেশের একটি অনন্য পুরাকীর্তি। এখনও এর পুরো সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে রানীঘাটের সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। আরও অনেক সংস্কার কাজ বাকি আছে। সব কাজ শেষ হলে রাজবাড়িটি আরও বেশি দর্শনীয় হবে। তখন দর্শনার্থী আরও বাড়বে। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে- দেশের পাশাপাশি এখন বিদেশি পর্যটকও বাড়ছে।


যা সবার জন্য গৌরবের বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com