শিরোনাম
সাক্ষাতকার
‘খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত আনতে বিশাল কূটনৈতিক ও আইনি লড়াই জারি রাখতে হবে’
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৫৩
‘খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত আনতে বিশাল কূটনৈতিক ও আইনি লড়াই জারি রাখতে হবে’
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে ঠাণ্ডা মাথায় একটা অসাধারণ কাজ করতে হবে। কানাডার সাথে একটা বিশাল কূটনৈতিক এবং আইনি লড়াই এর প্রস্তুতি নিতে হবে। এটা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কাজ নয়। প্রথমে একটা দ্বিপাক্ষিক বহিঃসমর্পন চুক্তি করতে হবে যাতে জোর দিতে হবে যে ‌‘মৃত্যুদণ্ডের সাজা না দেয়ার প্রতিশ্রুতিগত’ যে অবস্থান বর্তমানে কানাডার রয়েছে তা যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, অন্ততঃ জাতির জনক-এর খুনিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়। ২০০১ সালের বার্নস মামলায় কানাডার মুরব্বি আদালত যে অবস্থান নিয়েছিলেন তা ছিল তারও মাত্র ১০ বছর আগে দুটি মামলায় (কাইন্ডলার এবং ন’ ১৯৯১) নেয়া অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।


সম্প্রতি জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল বিবার্তা২৪ডটনেটের সাথে একান্ত আলাপকালে এসব কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সহযোগী অধ্যাপক ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ। বিবার্তার সাথে দীর্ঘ সাক্ষাতকারের ২য় পর্বের উঠে এসেছে দেশের বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের বিচারিক হালচাল, সাম্প্রতিক আবরার হত্যা মামলার রায় সহ দেশের আইনঙ্গনের সঙ্কট ও সেসব থেকে উত্তরণের বিভিন্ন দিক। দীর্ঘ আলাপের বিষয়গুলো বিবার্তার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো। দুই পর্বের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের নিজস্ব প্রতিবেদক আদনান হোসাইন সৌখিন। সাক্ষাৎকারটির শেষ পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো...


বিবার্তা: বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার জন্য স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ বেশ কিছু রায় এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অনেক আসামি এখনো পলাতক। আইনগত ভাবে কিভাবে এসব মামলার সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যায় বলে আপনি মনে করেন?


মাসুম বিল্লাহ: বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দীর্ঘদিন হতে দেয়া হয় নাই। খুনিরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে দীর্ঘদিন বিচারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিলো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইনডেমনিটি বাতিল করা সম্ভব হয় এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে অনেক খুনি ধরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। যাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল তাদের আপিল শুনানি বিএনপি এসে স্থগিত করে দেয়। শেখ হাসিনা আবার ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসলে আপিল শুনানি হয়, এবং কয়েকজনের খুনির দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়। এখনো কয়েকজন খুনি পলাতক আছে। যেমন কানাডায় বহাল তবিয়তে বাস করছে খুনি নূর চৌধুরী। কানাডা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেনা বিধায় নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে বহিঃসমর্পণ করেনা। বাংলাদেশ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।


প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কয়েকবার চেষ্টা করেছেন। যেমন একবার তিনি জাস্টিন ট্রুডো-র কাছে প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন যে, কানাডার সংবিধানে (অধিকার সনদ ১৯৮২)-এর এ কেমন ধারা (ধারা ৭: জীবনের অধিকার) যে তা খুনিকে রক্ষা করে ? তার এই কথাটাই দেশি-বিদেশী নামকরা আইনের মুয়াল্লেমগন উঁচু আঙ্গিকে নানা সময়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। ২০০১ সালে বার্নস মামলায় কানাডার মুরব্বি আদালত তাদের ১৯৮২ সালের চার্টারকে ‘জীবিত গাছ’ জ্ঞান করে সমসাময়িক বাস্তবতার আলোকে বলে দিয়েছেন যে ‘বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া’ ফাঁসির সাজা দেয়া হবে না বা দেয়া হলেও কার্যকরী করা হবে না মর্মে লিখিত আশ্বাস না পেলে কোনো পলাতককে বহিঃসমর্পন করা কানাডার উচিত হবে না।


কানাডার আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটি খুনিদের স্বর্গরাজ্য হবে বলে সমালোচনা রয়েছে। অনেক গবেষক রীতিমতো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ‘সেফ হেভেন’ প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৯৬ থেকে খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় আছে, ফুলের বাগান করছে। কানাডার মানবাধিকার সনদ নামের ‘লিভিং ট্রি’কে ফুলে ফুলে বিউটিফিকেশন করছে। কানাডাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এমন অসহ্য সৌন্দর্যের ভার তারা নিতে পারবেন কিনা।


কে জানে আবার এখন ১৫ বছর পরে ভিন্ন একটা কাইন্ডলার যথা নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রে কানাডিয়ান আদালত সরকারের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ নাও করতে পারে। পলাতক হস্তান্তর এর ক্ষেত্রে কানাডার একটা টেস্ট হলো যদি কোনো সমর্পন (এবং শাস্তি) কানাডার মানুষের বিবেককে আচ্ছন্ন করে (shocks the conscience) তবে হস্তান্তর বৈধ হবে না। কানাডার সরকারকে বাংলাদেশ যদি মৃত্যুদণ্ড না দেয়ার নিশ্চয়তা ছাড়াই রাজি করাতে পারে, তাহলে ওই খুনিটা নিশ্চয় কানাডার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। তখন সেই প্রমাণ করুক তার হস্তান্তর কিভাবে কানাডার বিবেককে আচ্ছন্ন করবে।


বিবার্তা: যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধী এখনো বিচারের বাইরে। অনেকের বিচার হয়েছে কিন্তু রায় কার্যকর হচ্ছে না। এর পেছনে রাজনৈতিক বা আইনগত কি ধরনের কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


মাসুম বিল্লাহ: যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ-এর জন্য ২০১০ সালে ট্রাইবুনাল গঠন ছিল বিবেকের কাছে ক্ষমতার অর্ঘ্য অর্পণের অন্যতম উদহারণ। এই বিচারে এ পর্যন্ত ৪২ জন ব্যক্তির দণ্ড হয়েছে, বেশিরভাগ কার্যকরী হয়েছে, কয়েকটা কার্যকরী হয়নি। কিছু মামলা তদন্তাধীন আছে। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলাসমূহ গতি হারিয়েছে। এর বড় একটি কারণ প্রথম চার/পাঁচ বছরে যাদের বিচার হয়েছে তারা অপরাধ সম্পৃক্তি ছিল ঘৃণ্যতম। অধিকন্তু তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্ত অবস্থান-এর কারণে মানুষ এক সময় মনে করতো তাদের বিচার কখনো হবে না। সে কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে তাদের বিচার হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন, এবং বড় অর্থে, স্ট্র্যাটেজিক লিটিগেটিং অনুসরণের ক্ষেত্র। যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে আমরা কিছুটা ইতিহাসের দায়মোচন ঘটাতে পেরেছি। কিন্তু এখনো সেই দায় পুরোপুরি মিটে নাই।


বিচারের নানান দিক হয়। একটা হয় শাস্তি দেয়া। আরেকটা শাস্তি দেয়ার পর্ব শেষ হলে প্রতিকারমূলক, ন্যায়ানুগ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সবাইকেই কাজ করতে হয়। অপরাধের বিচার করা যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য তেমনি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনও জরুরি।



বিবার্তা: সাম্প্রতিক সময়ে আবরার হত্যা মামলার রায়ে বিচারিক আদালতে বিশ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। রায়টির একটা জনপ্রতিক্রিয়ার দিক রয়েছে। আপনিতো আইনের সমাজ-মনস্কতার কথা বলেন। এই রায়টি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?


মাসুম বিল্লাহ: এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ভিকটিম-সংবেদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের রায়কে মানুষ আনন্দচিত্তে স্বাগত জানায়। কিন্তু এই উপসর্গ সমাজের সুস্থতার লক্ষণ প্রকাশক নয়।


আবরার হত্যাকাণ্ডে ২০ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এর আইন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় প্রতিশোধবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। বিচারবিভাগ কাজ করছেন বটে, কিন্তু চাঞ্চল্যকর, রোমহর্ষক মামলাগুলোতে একটা মিউজিক্যাল চেয়ার সিনড্রোম দেখতে পাচ্ছি। অধস্তন আদালত ‘পেনাল পপুলিজম’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক মৃত্যুদণ্ডের রায় দিচ্ছেন, অথচ তারা ভালো করেই জানেন যে, তাদের এই রায় উচ্চ আদালতে টিকবে না।


বিচারগুলোকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তবে একথা ঠিক যে, বিচারবিভাগকেও নির্বাহী বিভাগের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সরকার কোনো রায় বা আদেশ সম্পর্কে কি ভাববেন তা নিয়ে বিচারকরা উদ্বিগ্ন থাকছেন বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়িয়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’?


বিবার্তা: মামলার শুনানির দীর্ঘসূত্রিতা কি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর কোনো প্রভাব ফেলে?


মাসুম বিল্লাহ: শুধু শুনানি বলে তো কথা নয়, মামলা দায়ের থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি হওয়া অবধি সীমাহীন অপেক্ষা করতে হয়। ভূমি মামলার কথাই ধরুন। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে, যার মধ্যে ৮০ ভাগই ভূমি সংক্রান্ত। আমাদের মোট বিচারক ১৮০০-এর মতো। একটা ভূমি মামলার বিচার হতে আমাদের দেশে বর্তমানে গড়ে তিন থেকে ৪৫ বছর সময় লাগছে। অধ্যাপক আবুল বরকত এটিকে বলছেন, ‘অনিঃশেষ জাতীয় অপচয়’!


তাই দীর্ঘসূত্রিতা বিচার ব্যবস্থার অন্তরে আঘাত হানছে। লিগ্যাল সিস্টেম একটা প্যাথলজির মতো। সেই প্যাথলজিতে ‘বিচার’ একটা গিনিপিগে পরিণত হয়েছে। বিচারের হাটে গরিব মানুষের সাওদা করার উপায় নেই। রাষ্ট্রের একটা সমান কার্যকরি সমান্তরাল অঙ্গ হিসেবে বিচারবিভাগ ভূমিকা রাখতে পারছে না। যেটুকু আমরা রাষ্ট্র করে বলছি, সেখানে মামলা নিস্পত্তির তৃপ্তির ঢেকুর আছে বটে, তাতে কতটুকু ন্যায়বিচার বিচারপ্রার্থী পেয়েছেন সে খবর আমরা জানিনা।


বিবার্তা: অনেক মামলায় ধর্ষক, খুনি বা মানবতাবিরোধী অপরাধীর পক্ষেও আইনজীবী পাওয়া যায়। এটি অপরাধীদের কি পরোক্ষভাবে মদদ দেয়া হচ্ছে না ? আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।


মাসুম বিল্লাহ: না, ব্যাপারটি তা নয়। আমরা আবেগ থেকে ওই রকম মনে করি। কোনো ব্যক্তির অপরাধ বিচারিকভাবে প্রমাণিত না হওয়া অবধি ওই ব্যক্তি ‘অভিযুক্ত’ মাত্র, অপরাধী নয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার। এই অধিকারের অন্যতম অনুষঙ্গ হল, দক্ষ আইনজীবী দিয়ে নিজের অবস্থান আদালতে তুলে ধরা। কোনো মানুষই আদালতের পরিবেশে সঠিক ভাষায় নিজেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে না।


তাই আইনজীবীর দ্বারা প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আসে। যিনি মামলা করেছেন তার আইনজীবীর দায়িত্ব হলো সাক্ষ্য, প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করা। একটা আদর্শ ফৌজদারি ব্যবস্থায় দুপক্ষকেই এই অধিকার দিতে হবে। এ না হলে নির্দোষ মানুষ নিগ্রহ বেড়ে যাবে। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তি যতই খারাপ হোক আইনজীবী দিয়ে তার কথা বলার সুযোগ বিচার ব্যবস্থায় থাকতে হবে।


বরং, যদি কোনো আইনজীবী কোনো অভিযুক্তের পক্ষে না থাকেন রাষ্ট্রের উচিত তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে দেয়া। বিচার ব্যবস্থায় রেট্রিবিউটিভিজম এর পাশাপাশি ক্ষমাশীলতা ও তিতিক্ষার সুষ্ঠু প্রয়োগের সুযোগ না থাকলে সে বিচার ব্যবস্থা নিগ্রহমূলক বিচারব্যবস্থায় পরিণত হয়। আইনজীবীরা যদি সম্মিলিতভাবে কোনো অভিযুক্তের পক্ষে না দাঁড়াতে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বুঝতে হবে, তারা আইনজীবী হওয়ার পাঠ ভালোভাবে নেননি।



বিবার্তা: নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে দুই যুগ হয়ে গেল। কিন্তু কতদূর নিশ্চিত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা?


মাসুম বিল্লাহ: ১৯৯৯ সালে বিচার বিভাগের পৃথককরণ সংক্ৰান্ত ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি মোস্তফা কামাল। ২০০৭ সালে অনেক গড়িমসির পর আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাজিস্ট্রেসি নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়। বিচারকদের নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন বানানো হয়েছে। বিচারকদের আলাদা বেতন কাঠামো হয়েছে।


মাসদার-উত্তর সময়ে আমাদের আদালত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে ভালো কিছু রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে তেরোতম সংশোধনী মামলা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল) এবং ষোড়শ সংশোধনী মামলা রাজনৈতিকভাবে বিতর্ক তৈরি করলেও, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে শক্ত দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।বিচারপতি সিনহার অস্বাভাবিক বিদায় অবশ্য বিচারিক স্বাধীনতার চিন্তায় অনেক প্রশ্ন রেখে গেছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, নিয়োগ ইত্যাদি প্রশ্নে যে বিধিমালা তৈরি হয়েছে, সেখানে ‘ডেপুটেশন’ প্রাকটিস এবং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের (আসলে সরকারের) প্রাধান্য একটা বিতর্কিত বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। এছাড়া উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সংবিধান-তাগাদা থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট আইনের অনুপস্থিতি ভালোমানের বিচারক নিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


সবকিছুর উপরে, অনেক সময় বিচারকগণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীনতা অনুশীলন করতে ভয় পান। বিচারিক স্বাধীনতা তাই নিজের থেকে আগলে রাখার বিষয়।


বিবার্তা: প্রায়ই একটি কথা শুনে থাকি ‌‘আইনের মারপ্যাঁচ’ বা ‘আকাশে যত তারা, আইনে তত ধারা’। সাধারণ মানুষের কাছে এসব প্রবাদ - প্রবচন খুবই ভীতি সৃষ্টি করে। আইনের শিক্ষক হিসেবে আপনি এই বিষয়গুলি কিভাবে দেখেন। সাধারণ মানুষের এই আইন-ভীতি কিভাবে দূর করা যায়?


মাসুম বিল্লাহ: আইন তো শোষণ বা ক্ষমতার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর এটা হয় আইনের ভাষার কারসাজিতে। একটা শব্দের বহু অর্থ হয়।


আইনের বিচারভেদ ক্ষীণ। মলিন। এ ক্ষীণতা নিয়ে দুটো শিকারী বাঁজ পাখির কোনটা উপরে উড়ে, দুটি ব্লেডের মধ্যে কোনটার শান বেশি, দুটি ধাবমান ঘোড়ার মধ্যে কোনটায় চড়ে আরাম অথবা দুটো তরুণীর মধ্যে কার চোখ বেশি উজ্জ্বল- এসবের বাচ-বিচার করা যায় না। শেক্সপিয়র-এর হেনরি সেভেন এর আর্ল অফ ওয়ারউইক-এর একটা সংলাপ এরকম: ‘ইন দিজ নাইস শার্প কুইলেটস অফ দ্য ল’/ গুড ফেইথ, আই এম নো বেটার দ্যান এ ড’। অর্থাৎ, ‘আইনের এই ঘোরতর মারপ্যাঁচে, সত্যি বলতে, আমি এক দাঁড়কাক, বৈ তো নই’!


কাজেই আইনি ব্যাখ্যায় অনেক সময় বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হন। এ জন্য এই ধরণের প্রবাদ চালু হয়। যেমন ভূমি জরিপের ক্ষেত্রেও আপনি একটা কথা পাবেন এরকম: ‘দেশে এলো জরিপ, মানুষ হলো গরিব’। তবে একথাও ঠিক যে, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে আইন বিমুখ। আইন ভাঙ্গাটাই বা আইনকে তেমন গুরুত্ব না দেয়াটাই এখানে বীরের কাজ। এই মানসপটের কারণে আমাদের এখানে আইনের শাসন চর্চা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আইনের শাসনের মান নির্ভর করে কোনো জাতির আইন মানার ক্ষমতা থেকে।


আইন দিয়ে আমাদের সামাজিক আলোকায়ন দরকার। আইনকে জনবান্ধব হতে হবে। মানুষের দোরগোড়ায় আইনের সেবা পৌঁছে দিতে হবে: ‘ল এট পিপলস’ সার্ভিস’। আইনকে যদি জীবনের সেবক হতে হয়- যে জীবনের কপাল রক্তে রঞ্জিত, শ্রমে জর্জরিত, নিষ্পাপ অশ্রু আর সংগ্রামে ভেজা - তাহলে বিচার-পদ্ধতির যেমন দহন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন স্বদেশী আইন ব্যবস্থার পুনর্জাগরণ। প্রয়োজন কিছু দরদী মানুষ, দ্রোহী আইনজীবী, দ্রোহী বিচারক, ভালো শিক্ষক।



বিবার্তা: আইন পেশা ও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার পর্যালোচনা জানতে চাই। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জন্য আপনার উপদেশ ও প্রত্যাশা কি?


মাসুম বিল্লাহ: আমাদের আইনের বাজার একেবারে ছোট নয়। ছেলেমেয়েরা আইন পড়ে শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীসহ অধিকাংশ কাজই করতে পারে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে তিন /চার হাজার আইন গ্রাজুয়েট বাজারে আসে। আইনজীবী ও জাজ হতে হলে এদের আলাদা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এখনো হিসেবে করে দেখেছি যত্ন নিয়ে আইন পড়া ছেলে মেয়ে ৪/৫ মাসের বেশি বেকার থাকেনা। তবে তাদের যোগ্য কাজের অভাব নেই তা বলছিনা। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কাছে আমার প্রত্যাশা হলো তারা যেন একটু পড়াশুনা করে আদালতের বারান্দায় যায়। নিজেদেরকে সম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তোলে।


বিবার্তা: বিবার্তাকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।


মাসুম বিল্লাহ: আপনাকে ও বিবার্তা২৪ডটনেট কে অনেক ধন্যবাদ।


বিবার্তা/আদনান/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com