
লালমনিরহাটে সমাজসেবা কার্যালয়ের অর্ধশত কোটি টাকার ফাইল গায়েবের ঘটনার ৮মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগমের বিরুদ্ধে দাফতরিকভাবে কোন শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হয়েছে শুধু অফিস বদল। এই ঘটনায় বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেই তদন্তেও নেই কোনো অগ্রগতি।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিনই জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে এইসব গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো গায়েব হয়। ওই ঘটনায় নিজেকে দায়মুক্ত রাখার কৌশল হিসেবে গত ৬ আগস্ট বেলা ১১ টার দিকে ফাইল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা সাজিয়ে টানা এক মাস পর কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে অভিযুক্ত অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগম।
এদিকে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল গায়েবের ঘটনায় অভিযুক্ত তৎকালীন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাককে ২০২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর একই পদে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগমকে ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
কিন্তু অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগমকে বদলির মাত্র ৭মাস পর চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ঢাকার সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শাহেদ পারভেজ স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে আবারো তাকে লালমনিরহাট সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে অব্যাহতি দিয়ে কালীগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয়ে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুর রাজ্জাক তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে পদ বাগিয়ে নিয়ে ২০২১ সালের ২ মার্চ তারিখে কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি মন্ত্রী ও তার পুত্রকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা ও আর্থিক অনুদানসহ তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন নামে বেনামে ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসতেন। জুলাই আন্দোলনের দেশে সরকার পতনের পর গত ৬আগস্ট কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার ফাইল গায়েব হয়। এই ঘটনায় কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের হলে পুলিশ ও বিভাগীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনার তদন্ত নামে । পরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তাকে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে একই পদে বদলি করা হয়। বর্তমানে এখনো তিনি সেখানে কর্মরত আছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগম লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশিরাম মৌজার বাসিন্দা। একই মৌজার স্হায়ী বাসিন্দা লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী- কালীগঞ্জ) আসনের তৎকালীন এমপি ও তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। ২০১৮ সালের ৪ জুন পারভীন বেগম সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগদান করেন। এরপর একই সালের ২৭ জুন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে একই পদে যোগদান করেন।
নিজ অফিস থেকে ফাইল গায়েবের বিষয়ে অভিযুক্ত পারভীন বেগমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ফাইল গায়েবের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এ সংক্রান্ত বিষয়ে লিখিত ভাবে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। তৎকালীন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাকের পরামর্শে থানায় জিডি করা হয়েছে। এরপর তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।”
লালমনিরহাট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট উশৃংখল জনতা ছবিতে আগুন দেওয়া ছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অন্য কোনো কাগজ পত্রে হাত দেয়নি। সুতারাং ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিখোঁজ / গায়ের হওয়ার ঘটনাটি সঠিক নয়। উক্ত ঘটনার ১ মাস পরে তৎকালীন সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পরস্পর পরামর্শে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে থানায় জিডি করেছেন।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মতিয়ার রহমান বলেন, আর্থিকসহ বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ তালিকা, অর্থ বিতরণ / প্রদান তালিকা, নোট, অনুমোদন পত্র, রেজুলেশন, গুরুত্বপূর্ণ চিঠিসহ বিভিন্ন নথি সাধারণত সমাজকল্যাণ পরিষদের নথিপত্রের অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র কীভাবে হারিয়ে গেছে, সেটা অনুসন্ধান/তদন্ত করে সাক্ষ্য প্রমাণের আলোকে মনে হয়েছে, তৎকালীন কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাক ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পারভীন বেগম এই দুইজন মিলে পরামর্শ ক্রমে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ফাইল হারানোর ঘটনা উল্লেখ করে থানায় জিডির ঘটনা সাজিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন রংপুর বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক জিলুফা সুলতানাকে ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া লালমনিরহাটে চলতি বছরের ২১ এপ্রিল দুদকের গণশুনানির অনুষ্ঠানে এ সংক্রান্ত বিষয়ের তদন্ত প্রতিবেদনসহ অন্যান্য তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। খোঁজ না পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রকল্পের ওই ফাইলগুলোতে অর্ধশত কোটি টাকারও হিসাব নিকাশ রয়েছে। এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে বদলি ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, পারভীনকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শাহেদ আলী দুই মাস আগে লালমনিরহাট সদর উপজেলা থেকে কালীগঞ্জে পুনরায় বদলি করেন।
অভিযোগ উঠেছে, লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী- কালীগঞ্জ) আসনের তৎকালীন এমপি ও তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মন্ত্রী পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদসহ পরিবারের সদস্য , আত্মীয় স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের অনুকূলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ আর্থিক অনুদান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত যাতে ভবিষ্যতে দুদকসহ গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার নজরে না আসে সেজন্য ৬ আগস্টের ঘটনার অজুহাতে এবং নিজেদের বাঁচানোর কৌশল হিসেবে থানায় জিডি করা হয়। অভিযুক্ত দুইজনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হলে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন সম্ভব বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষজন ।
বিবার্তা/হাসানুজ্জামান/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]