অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
জিডি না করায় দুর্ঘটনা হয়ে গেল হত্যা মামলা!
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৫, ১৪:৪৯
জিডি না করায় দুর্ঘটনা হয়ে গেল হত্যা মামলা!
ইমরুল হাসান বাবু, টাঙ্গাইল
প্রিন্ট অ-অ+

টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় থানায় জিডি না করার ফলে ওই দুর্ঘটনার আট দিন পর আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় নিহত কলেজছাত্রী অথৈ মনির মা আলেয়া বেগম নিহতের চার সহপাঠীকে মামলায় অভিযুক্ত করেছেন। দীর্ঘ এক সপ্তাহের সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।


জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের কুমুদিনী সরকারি কলেজের পাঁচ ছাত্রী অথৈ মনি, লামিয়া জান্নাত, ঐশি, তন্নী ও অপি গত ৮ জানুয়ারি (বুধবার) প্রাইভেট পড়ার কথা বলে তাদের ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মধুপুরের সন্তোষপুর রাবার বাগান এলাকায় বন্য বানর দেখতে যায়। ফেরার পথে কলেজছাত্রী অথৈ মনি, লামিয়া জান্নাত, ঐশি, তন্নী ও অপি একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা নিয়ে মধুপুরের দিকে যাত্রা করে। ছেলে বন্ধুরা তিনটি মোটরসাইকেলে ফিরতে থাকে। পথিমধ্যে অথৈ মনি অটোরিকশা থেকে নেমে তার বন্ধু জাকারিয়ার মোটরসাইকেলে উঠে। মোটরসাইকেলটি মধুপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শেওড়াপাড়া (পুন্ডুরা) বাজারের পশ্চিমপাশে বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক্টরের (স্থানীয়ভাবে তৈরি এক ধরনের ট্রাক) সঙ্গে সামান্য ধাক্কা লাগে। এতে মোটরসাইকেল থেকে অথৈ মনি সড়কে পড়ে যায় এবং তার মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়। পরে মধুপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল হয়ে উন্নত চিকিৎসার্থে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) রাতে কলেজছাত্রী অথৈ মনি মারা যান।


মধুপুরের শেওড়াপাড়া বাজারের পশ্চিম পাশের ওই সড়ক দুর্ঘটনায় অথৈ মনি আহত হওয়ার ঘটনা পুলিশ জানতে পারলেও যেহেতু ঘটনাস্থলে নিহত নেই তাই থানায় কোন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেনি। ওই দুর্ঘটনার সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও ফলাও করে ছাপা হয়। পরে নিহত অথৈ মনির আবেগি মা আলেয়া বেগম গত ১৫ জানুয়ারি দণ্ড বিধির ৩০২/১০৯ ধারায় টাঙ্গাইলের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মধুপুর থানা আমলী আদালতে একটি পিটিশন মামলা
দায়ের করেন।


মামলায় জাকারিয়া, লামিয়া জান্নাত, আবির ও অপিকে অভিযুক্ত করা হলেও ঐশি ও তন্নীকে অভিযুক্ত তালিকার বাইরে রাখা হয়।


আদালত মামলাটি মধুপুর থানাকে এফআইআর হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী গত ৯ এপ্রিল মধুপুর থানায় মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯ ধারায় এফআইআর করা হয়।


দুর্ঘটনায় নিহত অথৈ মনি মির্জাপুর উপজেলার থলপাড়া ফতেপুর গ্রামের মো. কালামের মেয়ে ও কুমুদিনী সরকারি কলেজের এইচএসসি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। আলেয়া বেগমের দায়েরকৃত হত্যামামলার অভিযুক্ত কলেজছাত্র জাকারিয়া (২২) মধুপুর উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের নুরে আলমের ছেলে, লামিয়া জান্নাত (১৮) মির্জাপুর উপজেলার ভাতকুড়া মহেড়ার মাসুদ রানার মেয়ে, সুমাইয়া মোস্তফা ওরফে অপি (১৮) মধুপুর পৌরসভার গোলাম মোস্তফার মেয়ে ও আবিরও (২০) মধুপুর পৌরসভার বাসিন্দা এবং তারা সবাই সহপাঠী।


সরেজমিনে মধুপুরের শেওড়াপাড়া বাজার ও এর আশপাশে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে পূর্ব দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে চালক ও এক নারী আরোহী নিয়ে পশ্চিম দিকে অর্থাৎ মধুপুরের দিকে বেপরোয়া গতিতে যাচ্ছিল। শেওড়াপাড়া বাজারের পশ্চিম পাশে মোটরসাইকেলটি পৌঁছলে পশ্চিম দিক থেকে আসা একটি ট্রাক্টরের (স্থানীয়ভাবে তৈরি এক ধরনের ট্রাক) সঙ্গে সামান্য ছোঁয়া লাগে। ট্রাক্টরের চালক ও মোটরসাইকেলের চালকের তড়িৎ সতর্কতায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি।


কিন্তু মোটরসাইকেলে থাকা নারী আরোহী উল্টে পাকা রাস্তায় পড়ে যায়। এতে তার মাথার পেছনে ফেঁটে রক্ত ঝড়তে থাকে। মোটরসাইকেল চালক ভয়ে দুর্ঘটনা কবলিত নারীকে রেখে মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। পরে স্থানীয়রা আহত নারীকে উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে পাঠায়।


শেওড়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী মো. জাহিদ, আছর আলী, সোহেল সহ অনেকেই জানান, ওইদিন এলাকার কাঁচামাল ব্যবসায়ী রিপনের জানাজা ছিল। এলাকার অনেকেই ওই জানাজা নামাজে অংশ নেয়। ওইদিন বিকালে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ট্রাক্টরের সঙ্গে মোটরসাইকেলটি সামান্য (সম্ভবত সামনের লুকিং গ্লাসে) লেগে যায়। এতে পেছনের মেয়েটি উল্টে পাকা রাস্তায় পড়ে রক্তাক্ত জখম হয়।


মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী সন্তোষপুর রাবার বাগান এলাকায় বনের বানর দেখতে গিয়েছিল বলে তারা জানতে পেরেছেন।


শেওড়াপাড়া বাজারের পশ্চিম পাশে দুর্ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির গৃহবধূ মোছা. আছমা বেগম জানান, তার বাড়ির সামনেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনার শব্দে তিনি সহ অনেকেই ওই স্থানে যান। কিন্তু দুর্ঘটনা কবলিত রক্তাক্ত ব্যক্তি নারী হওয়ায় কেউ ধরতে যায়নি।


তিনি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে মাথার পেছনে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। তখন গল গল করে রক্ত ঝড়ছিল। তিনি কাপড় দিয়ে মাথা বেঁধে একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাযোগে মধুপুর হাসপাতালে পাঠান। মোটরসাইকেল চালক ছেলেটি মূলত দুর্ঘটনায় ভয় পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। প্রায় একই কথা বলেন অপর প্রত্যক্ষদর্শী আরিফুল ইসলাম সহ অনেকেই।


নিহত কলেজছাত্রী অথৈ মনির সহপাঠী ঐশী ও তন্নী জানায়, ঘটনার দিন অথৈ মনি সহপাঠী সুমাইয়া মোস্তফা অপির ভাই আবিরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে বাসযোগে মধুপুর বেড়াতে যান। মধুপুরে গিয়ে আবিরের সহযোগিতায় একটি ঘরে গিয়ে তারা ফ্রেশ হয়।


ঘোরাঘুরি (বেড়ানো) শেষে তারা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করে। পথিমধ্যে অথৈ মনি অটোরিকশা থেকে নেমে তাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া কলেজছাত্র জাকারিয়ার মোটরসাইকেলে উঠে। পরে তারা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সেখান থেকে আহতাবস্থায় অথৈ মনিকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে।


তারা জানায়, খবর পেয়ে অথৈ মনির পরিবারের লোকজন টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল থেকে তাকে ঢাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জানুয়ারি রাতে কলেজছাত্রী অথৈ মনি মারা যান বলে জানতে পেরেছেন।


অথৈ মনির সহপাঠী সুমাইয়া মোস্তফা অপির বাবা গোলাম মোস্তফা জানান, অথৈ মনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল বলে তিনি জানতে পেরেছেন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অথৈ মনি মারা যায় বলেও জেনেছেন।


অথৈ মনির খালা রুমি আক্তার জানান, দুর্ঘটনার রাতে অথৈ মনির মুঠোফোন ঐশীর কাছে ছিল। সারারাত অথৈ মনির ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ সচল ছিল। দুই দিন পর তারা (সহপাঠীরা) মুঠোফোন ফেরত দিয়েছে।


মামলায় অভিযুক্ত জাকারিয়া, লামিয়া জান্নাত, আবির ও সুমাইয়া মোস্তফা ওরফে অপি জানান, তারা মধুপুরে বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে অথৈ মনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়। তারা মধুপুর হাসপাতালে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। অথৈ মনির পরিবারকেও তারাই খবর দেয়। মায়ের মন সাধারণত সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকে। আবেগের জায়গা থেকে দুর্ঘটনাকে অথৈ মনির মা হত্যা মামলা এবং তাদেরকে অভিযুক্ত করে হয়রানি করছেন।


নিহত কলেজছাত্রী অথৈ মনির মা আলেয়া বেগম জানান, তার মেয়েকে ফুঁঁসলিয়ে মধুপুরে বেড়াতে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। তার মেয়ের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। অথৈ মনির সহপাঠী ঐশী ও তন্নী একেক সময় একেক কথা বলছে। তার মেয়েকে মধুপুরে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে সহপাঠীরা পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। মধুপুর থানা মামলা না নেওয়ায় তিনি আদালতে চার সহপাঠীকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেছেন।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মধুপুর থানার এসআই উচ্ছ্বাস পাল জানান, আদালত থেকে পিটিশন মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে তিনি সরেজমিনে প্রকাশ্য এবং গোপনে তদন্ত কাজ চালাচ্ছেন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।


মধুপুর থানার ওসি মো. এমরানুল কবীর জানান, কলেজছাত্রী অথৈ মনির মৃত্যুর বিষয়টি তিনি ১৫ জানুয়ারি (বুধবার) বিকালের দিকে জানতে পারেন।


তিনি জানান, কয়েকদিন আগে কয়েকজন কলেজছাত্রী তিনটি মোটরসাইকেলে মধুপুরে বেড়াতে আসে। ওই সময় একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়। আহত মেয়েটিকে ফেলে অজ্ঞাতপরিচয় ছেলেটি মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তিনি এমন খবর পেয়েছেন।


সড়ক দুর্ঘটনায় একজন আহতের ঘটনা হওয়ায় ওই সময় থানায় জিডি করা হয়নি। তবে আদালত থেকে পিটিশন কপি আসার পর থানায় এফআইআর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মামলাটির সঠিক তথ্য উদ্‌ঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। যেকোনো মূল্যে এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।


টাঙ্গাইল শহরের কুমুদিনী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. খলিলুর রহমান জানান, গত ৮ জানুয়ারি প্রাইভেট পড়ার কথা বলে ক্যাম্পাস থেকে বের হয় এবং তারা মধুপুরে বেড়াতে গেছে এমন খবর জানতে পেরে তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে প্রাইভেট পড়া বন্ধ করা হয়েছে।


বিবার্তা/ বাবু/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com