
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনার তীরবর্তী লালপুরে ও নাসিরনগর উপজেলার মেদির হাওরের পাড়ে পুরোদমে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ।
তবে মৌসুমের শুরুতে এই ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও সংস্থার দারস্থ হচ্ছেন।
এতে মৌসুমি এই ব্যবসার লাভের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের হাতে।
এ অবস্থায় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে তারা লাভবান হবেন। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছেন, সহজ শর্তে জামানত বিহীন ঋণ প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তারা।’
স্থানীয়রা জানান, আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনার তীরবর্তী লালপুর এবং নাসিরনগর উপজেলার মেদির হাওরের পাড়ে সারি-সারিভাবে স্থাপন করা হয়েছে বাঁশের মাচা। এসব মাচায় মেঘনা এবং হাওর অঞ্চল থেকে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ করে শুকানো হয়।
বিশেষ করে পুটি, টেংরা, শইল, টাকি, চাঁদা, আইড়, কাইক্কা, বাইম এবং মেনি মাছের শুঁটকিই অন্যতম। পঁচনরোধে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তপ্ত রোদে শুকানো হয় এই মাছের শুঁটকিগুলো।
পরে দ্বিতীয় ধাপে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে বিক্রয়ের উপযোগী করে তোলা হয়। এর মধ্যে পুটি মাছের চ্যাপা শুঁটকি উৎপাদন অন্যতম। তবে এর পেছনের গল্পটা একেবারেই ভিন্ন। এসব মাছ শুকানোর জন্যে মাচা তৈরী থেকে শুরু করে মাছ কেনা, মাছ শুকানো এবং দেশে এবং বিদেশে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যবসায়ীর প্রয়োজন হয় মোটা অঙ্কের পুঁজি। আর এই পুঁজি সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা দারস্ত হচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ী কিংবা এনজিও সংস্থাসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এতে লাভের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের হাতে।
স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে সহজ শর্তে অল্প সুদে ঋণ পেলে অনেকটাই লাভবান হবেন তারা।
লক্ষণ চন্দ্র দাস নামে এক শুঁটকি ব্যবসায়ী বলেন, আমি ত্রিশ বৎসর যাবত এ ব্যবসা করে যাচ্ছি। আমার কিছু পুঁজি ছিল, সাথে ধারদেনা করে মহাজনের টাকা ঋণ করে আমরা ব্যবসা করে যাচ্ছি। ব্যাংক থেকে আমাদের নাম মাত্র যে টাকা ঋণ দেয় সেটি দিয়ে আমাদের এ ব্যবসার কিছুই হয় না। ব্যাংক বেশি টাকা দেয় না বিধায় আমরা সেখানে যাই না। এছাড়া ব্যাংক থেকে লোন আনতে গেলে জমি জায়গার দলিল জমা দিতে হয়। তাছাড়া এই ব্যবসা শুরু থেকেই মহাজনের মাধ্যমে চলে আসছে। আর আমরা এভাবেই ব্যবসা করে আসছি।
নিখিল চন্দ্র দাস নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ব্যবসা হয় কিন্তু ব্যাংক আমাদেরকে পরিমাণ মত লোন দেয় না। আমরা দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিওদের কাছ থেকে টাকা এনে এই ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছি। যদি ব্যাংকগুলো আমাদের সহজশর্তে ঋণ দিতো তাহলে আমরা ব্যবসাটা সুন্দরভাবে করতে পারতাম। এছাড়া আমরা সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা কিছুই পাইনা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর এ.জেড.এম আরিফ হোসেন বলেন, অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বছরে ৬মাস মিঠা পানির মাছ থেকে শুটকিতে রূপান্তর করার পর এই শুঁটকি ব্যবসায় জমজমাট অবস্থায় থাকে। যারা এই ব্যবসায় জড়িত তাদের মূলধন অনেক কম। ব্যবসার জন্য তারা পুঁজি সংগ্রহ করতে গিয়ে দারস্ত হচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ী কিংবা এনজিও সংস্থাসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এতে বছরে লাভের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের হাতে। সেক্ষেত্রে এই ব্যবসা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাঁধা বলে আমি মনে করি। শুঁটকি খাতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি ব্যাংকের মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউসুফ খান জানান, ‘শুঁটকি ব্যবসায়ীরা চাইলে এই খাতে জামানত ছাড়া সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। আমরা শুঁটকি ব্যবসায়ী যাদের যোগ্যতা রয়েছে, তাদের তালিকা সংগ্রহ করছি। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে না গিয়ে আমাদের ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শুঁটকি পল্লীতে শুঁটকি তৈরীর প্রক্রিয়া আধুনিকরায়ণ জরুরি। এছাড়া ঋণ সুবিধা প্রয়োজন। জেলা ঋণ কমিটিতে তালিকা প্রেরণের কাজ চলছে। মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প হতে অবৈধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান খুব শীঘ্রই শুরু হবে। জেলে নিবন্ধনের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতি মৌসুমে শুঁটকি প্রায় ১৫০ টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য দর প্রায় ৪ কোটি টাকা।
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বছরে ৬মাস এই শুঁটকি ব্যবসায় জমজমাট থাকে। আর এই সময়টাতে জেলায় শত কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন ও দেশে-বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
বিবার্তা/আকঞ্জি/এনএইচ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]