মানুষ কেনাবেচার হাট : যেখানে শ্রম বিক্রি হয়
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩৮
মানুষ কেনাবেচার হাট : যেখানে শ্রম বিক্রি হয়
না‌জিরপুর (পিরোজপুর) প্রতি‌নি‌ধি
প্রিন্ট অ-অ+

যারা কাজের জন্য নিয়ে যায় তারা লোক ভালো হলে থাকা-খাবারের অসুবিধা হয় না। আবার অনেকে আছে, যারা আমাদের মানুষই মনে করে না। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন শ্রম বিক্রি করতে আসা জুলফিকার।


এটি পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজারের থানা এলাকার সকালের চিত্র। সকাল থেকেই লোকজনের কোলাহলে সরগরম হয়ে ওঠে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে হাট বসেছে; তবে এ হাটে নেই কোনো পণ্য।


এখানে পণ্যের মত বিক্রি হয় শ্রম। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ এ হাটে আসেন শ্রম বিক্রির জন্য। তাদের শ্রম বিক্রি হয় দিন, সপ্তাহ বা মাস চুক্তিতে। ভোর থেকেই ‘মানুষের হাট’ বসে বেচাকেনা চলে বেলা ৯টা পর্যন্ত। সপ্তাহে দু’দিন বসে এ হাট শনি ও মঙ্গলবার।


বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, থানা সামনের সড়কে প্রায় একশ মিটার এলাকা জুড়ে বসেছে ‘মানুষের হাট’। শ্রমিকরা কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছেন। খদ্দের এলে শ্রমিকরা জড়ো হন। আবার অনেক শ্রমিক ‘কাজ নেবেন’ বলেও ডাকতে থাকেন।


বৈঠাকাটা বাজারে শ্রম বিক্রি করতে আসা বেশিরভাগের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার, চিতলমারী, কচুয়া, বাগেরহাট, নেছারাবাদসহ বিভিন্ন জেলায়। তাদের অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী ও গৃহস্থালির কাজ করেন।


ধান রোপণ ও কাটার সময় এই বাজারে প্রতিদিন ৫ হাজারের মতো শ্রমিক শ্রম বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। অন্য সময়ে ২ থেকে ৩ হাজার; যাদের বেশিরভাগই কৃষি কাজ করেন বলে চিতলমারী থেকে আসা শ্রমিক জুলফিকার জানান।


বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ শ্রমিক ভাসমান সবজির কান্দিতে কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হন শ্রমিকরা। আর দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হন গৃহস্থালির শ্রমিকরা। মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতেও অনেকে কাজ করেন। কাজ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক বেতন নেন কিছু শ্রমিক।


তিনি আরো বলেন, এলাকায় যে কাজ আছে তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে এসেছি। যদিও প্রতিদিন কাজ পাই না; কোনো কোনো সপ্তাহে খালি হাতে ফিরতে হয়।


শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে হাটে এসেও সকাল ৯টার মধ্যে যারা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, তাদেরই ফিরতে হয় ‘শূন্য হাতে’। শ্রমিকদের কেউ কেউ আসেন দুই-এক মাসের জন্য। থাকার সুবিধা কিংবা ভালো কোনো কাজ পেলে থেকে যান বছরের পর বছর। আবার টানা কয়েকদিন কাজ না পেলে অনেকে এক হাট থেকে অন্য পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।


শ্রমিকরা হাটে আসার জন্য দলে দলে ছোটেন ছেঁড়া লুঙ্গি, শার্ট, টি-শার্ট ও পুরোনো প্যান্ট পরে; গলা ও কোমরে গামছা বাঁধা থাকে। পোশাক যেমনই হোক তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তান ও পরিবারের লোকজন নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই কাজ। আর এ কাজ পেতেই ঘুম চোখ নিয়ে চলে তাদের লড়াই।


বাগেরহাটের জেলার সোনাকুর গ্রামের নিজাম জানান, সংসারের চাকা ঘুরে মানুষের কাজ করে। মাসে সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা রোজগার করেন বলে জানান এ শ্রমিক।


তিনি বলেন, বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলে-মেয়ে আছে। থাকা-খাওয়া ফ্রি হওয়ায় বেচে যায়। বাকিটা বাড়িতে পাঠাই। দিন ৫৫০টাকা ধরে একজনের সঙ্গে যাবো।


উপজেলার বৈঠাকাটা বাজারে কথা হয় আমতলা গ্রারে সাইদুল শেখের সঙ্গে। আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ার কারণে কাজের আশায় এসেছেন বলে জানান তিনি। কোনো কোনো দিন কাজ পান, আবার কোনো দিন তাকেও খালি হাতে ফিরতে হয় বাড়িতে।


বেশির ভাগ শ্রমিকেরা জানান, যারা কাজের জন্য নিয়ে যান, তারা লোক ভালো হলে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হয় না। আবার অনেকে আছে, যারা আমাদের মানুষই মনে করেন না।


সবজি বাগানের কান্দির কাজের জন্য শ্রমিকের খোঁজে এসেছেন বিশারকান্দির সরকার বাড়ি এলাকার বিনয় সরকার।


তিনি বলেন, শ্রমিক দরকার তাই ভোরেই চলে এসেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে এখানে লোক পাওয়া যায়; তারা কাজেও বেশ আন্তরিক। তাই বেশিরভাগ মানুষই এখানে শ্রমিক নিতে আসেন।


বিলডুমরিয়া গ্রাম থেকে শ্রমিক কিনতে আসা আব্দুল লতিফ জানান, ২জন শ্রমিক দরকার একজন পেয়েছি ৫৫০টাকা করে দিন। আরো একজনকে একই দাম বলছি কিন্তু রাজি হচ্ছে না। গত বছর ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় শ্রমিক কিনেছি। এবছর দাম বেশি।


বিবার্তা/ম‌শিউর/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com