জনবল সংকট, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পাবনা মানসিক হাসপাতাল
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৪৪
জনবল সংকট, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পাবনা মানসিক হাসপাতাল
পাবনা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

দেশের একমাত্র মানসিক রোগ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান পাবনা মানসিক হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন চিকিৎসক ও লোকবল সংকট থাকায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। ৫০০-শয্যার বিশেষায়িত এই হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট থাকায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই দ্রুত সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।


পাবনা মানসিক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সরকারের মঞ্জুরিতকৃত ৩১ টি চিকিৎসক পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ১২ জন চিকিৎসক। এখনও পদ শূন্য ১৯ জন। এছাড়াও মঞ্জুরিকৃত প্রথম শ্রেণীর ৭ জন কর্মকর্তার স্থলে রয়েছে ৩ জন। এখনও পদ শূন্য ৪ জন। দ্বিতীয় শ্রেণীর মঞ্জুরিকৃত পদ সংখ্যা ৩১৬ জন থাকলেও বর্তমান কর্মরত আছেন ২৯৬ জন। এখনও পদ শূন্য ২০ জন। তৃতীয় শ্রেণীর মঞ্জুরিতকৃত পদ সংখ্যা ১১৯ জন থাকলেও বর্তমান কর্মরত আছেন ৭৭ জন। এখনও পদ শূন্য ৪২ জন। চতুর্থ শ্রেণীর মঞ্জুরিকৃত পদ সংখ্যা ১৭০ জন থাকলেও বর্তমান কর্মরত আছেন ৬১ জন। এখনও পদ শূন্য ১০৯ জন। প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সরকারের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৬৪৩ জন থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪৪৯ জন। সবমিলিয়ে পদ শূন্য ১৯৪ জন। এছাড়াও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, সিনিয়র কনসালটেন্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট, ডেন্টাল সার্জন’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ এখনও শূন্য।


১৯৫৭ সালে ১১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই মানসিক হাসপাতাল। দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই এই হাসপাতালটি মানসিক চিকিৎসায় ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ৬০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানটি এখন ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রশাসনিক অবকাঠামো পরিচালনার জন্য রয়েছে ব্যাপক জনবল সংকট। এই হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি সেবার মান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আগের নিয়মেই দেওয়া হয় ব্যবস্থাপত্র। এখনও পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনে চলে বহির্বিভাগে আসা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৫০০ শয্যার এই মানসিক হাসপাতালে প্রধান ফটকের প্রবেশ মুখে সড়কের বেহাল দশা। ভর্তি হওয়া আবাসিক রোগীদের আবাসস্থলও বেশ পুরোনো। যার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের পড়তে হয় নানান সমস্যায়।


পাবনার ঈশ্বরদী মুলাডুলি থেকে আসা মানসিক রোগীর স্বজন মোজাম ও রংপুর থেকে আসা অনিক নামের এক ব্যক্তি জানান, বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে ঈশ্বরদী ও রংপুর থেকে ভোরে এসেছেন তারা। তারা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসার মান ভালো হলেও বহির্বিভাগে মাত্র দুই জন ডাক্তার ও অন্যান্য পদে জনবল সংকট থাকায় সিরিয়াল নিয়ে রোগী দেখাতে গিয়ে অনেক সময় লেগে যায়। এতে করে দূর থেকে আসা রোগীর স্বজনরা রোগী হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় তাদের।
কথা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আরেক মানসিক রোগীর স্বজন মো. গফুরের সাথে। তিনি জানান, মানসিক সমস্যার জন্য ছোট ভাইকে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখিয়েছেন তিনি। ভাইয়ের মানসিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার ভর্তি করার পরামর্শ দেন তাকে। তবে বহির্বিভাগে সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তার দেখাতে দেরি হওয়ায় এবং হাসপাতালে স্বজনদের থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।


পাবনা মানসিক হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: এ.কে.এম শফিউল আযম জানান, পাবনা মানসিক হাসপাতাল একটি জনপ্রিয় বৃহত্তম ও পুরাতন হাসপাতাল। এখানে ৫০০ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসা সংকট রয়েছে। ৫০০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে যে কয়জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ থাকার কথা সেখানে কিছুটা চিকিৎসক সংকট রয়েছে। আমরা এই স্বল্প জনবল নিয়েই সেবা চালিয়ে যাচ্ছি।


তিনি বলেন, প্রতিদিন সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত টেকনাফ, তেতুলিয়া থেকে শুরু করে প গড়, ঠাকুরগাঁ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি থেকে এই হাসপাতালে মানসিক রোগী আসে। তিনি জানান, আমরা আমাদের রোগীদেরকে যদি কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে চাই। তাহলে আমাদের আরও বেশি জনবল প্রয়োজন বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যারা আমাদের কাজে সহযোগিতা করে।


তিনি বলেন, এছাড়াও আমাদের বহির্বিভাগের সড়কটি সংস্কার করা প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের স্থাপনাগুলোও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।


এবিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন, প্রতিদিন এই হাসপাতালে ২০০ থেকে ৩০০ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সবসময় হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন রোগী ভর্তি থাকে।


তিনি বলেন, মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতালে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছে মাত্র ৪ জন। তিনি জানান, অন্যান্য হাসপাতালের মত এই হাসপাতালেও বিনামূল্যে ঔষধ ও খাবার দেওয়া হয়। তিনি জানান, হাসপাতালে দীর্ঘদিন ডেন্টাল সার্জনের পদ শূন্য থাকায় দাঁতের বিভিন্ন রোগ ঝুঁকিতে আছে মানসিক রোগীরা। এছাড়াও হাসপাতালের অবকাঠামোও বেশ পুরাতন হয়ে গেছে।


তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে নারী নার্স পর্যাপ্ত থাকলেও পুরুষ নার্স সংকট থাকায় রাতের ডিউটি নিয়ে নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। তিনি জানান, রোগী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটি ধারণা শুধু এই হাসপাতালেই মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। বিষয়টি আসলে তা নয়। এখন প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই না জেনে অনেক কষ্ট করে দূরদূরান্ত থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসে।


তিনি বলেন, এখানে তো সব ধরনের রোগী ভর্তি করা হয় না। চিকিৎসকদের প্রাথমিক পরামর্শক্রমেই এখানে রোগী ভর্তি করা হয়। পুরাতন হাসপাতাল, অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তবে দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে।


তিনি আরও জানান, হাসপাতালটি উন্নত করার জন্য এর পাশেই আরও একটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণের মহাপরিকল্পনা করেছে সরকার। সেটির নকশা ও অনুমোদন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সব ঠিক থাকলে খুব দ্রুতই হয়ত ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হবে। তখন হয়ত আরও ভালোভাবে মানসিক রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।


বিবার্তা/পলাশ/এনএইচ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com