সহকর্মীকে বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল যুবকের
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:১৪
সহকর্মীকে বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল যুবকের
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও নারী সহকর্মীর প্রাণ বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সহকর্মীকে সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেও নিজেই রক্ষা পাননি। তাদের ছুরিকাঘাতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় মোন্তাকিম আলিফের (২৫)। মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন এই যুবক।


২৪ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ভোরে কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মোন্তাকিম আলিফ রাজধানীর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন।


নিহত ওই যুবক ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের দোগাছি মধুপুর গ্রামের জুলফিকার আলীর ছেলে।


নিহতের বন্ধু ও সহকর্মীদের সূত্রে জানা যায়, নাইট শিফট শেষ করে ভোরে অফিস থেকে বের হয়ে আলিফ তার সহকর্মীকে (নারী) বাসায় এগিয়ে দেওয়ার সময় কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে তিনজন বখাটে ছেলে ছিনতাই ও মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করার জন্য কাছে আসে। এসময় মোন্তাকিম আলিফ মেয়েটিকে ছিনতাইকারীদের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়। এসময় তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় তার। মেয়েটির ভাষ্যমতে আলিফ ওই তিনজনকে মারধরও করেছে। তবে ছিনতাইকারীরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আলিফ মেয়েটিকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে বলে যাতে মেয়েটির কিছু না হয়। এসময় ছিনতাইকারীরা আলিফের শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। আলিফকে হাসপাতালে নিলে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। আলিফের এমন মৃত্যুতে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ এলাকাবাসীর মাঝে শোকের ছায়া বইছে।


আলিফের মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে ভিড় করছে আত্মীয়স্বজনরা। তার বাবা জুলফিকার আলী ও মা কহিনুর বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা।


আলিফের মা কহিনুর বেগমের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার কলিজার ধনকে আনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। ভালো করে লেখাপড়া করবে, সে জন্য ঢাকা শহরে ভালো কলেজ ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কাকে টাকা পাঠাব। এখন আমি কাক নিয়ে বেঁচে থাকব। আমাকে একা করে এভাবে চলে যাবি।


মোন্তাকিম আলিফ ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করতেন তিনি।


একটি মেয়েকে বাঁচাতে আলিফের এমন মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিচ্ছেন।


আলিফের বন্ধু মুনিজা হোসেন প্রিথিলা তার ফেসবুকে লিখেছেন, একটা মানুষ নিজের জীবনের শেষটুকু দিয়ে একটা মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে গেল। আসলে কত বড় মনের ও ভালো মানুষ হলে একজন নিজের জীবনের শেষ সময়েও আরেক জনের জীবন বাঁচায়? কেউ বলতে পারবেন? অনেক রাগ ছিলো আমার প্রতি তোর। মাফ করে দিস আমাকে আলিফ।


শাহারিয়ার জাকির রিম্পু লিখেন, আলিফের জন্য আমরা গর্বিত। ওর বাবা-মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। প্রিয় সন্তান আলিফকে হারানোর অভাব কেউ কোনো দিনই ওর বাবা-মাকে পূরণ করে দিতে পারবে না। কিন্তু আলিফকে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। সেটি হলো, আমাদের তরুণ, যুবক সমাজ এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে, পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়নি। আমরা আশান্বিত হতেই পারি, সমাজে এখনও আলিফের মতো যুবকরা আছে। যারা নিজের সর্বনাশ হতে পারে জেনেও মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন নারীকে রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করে।


শ্রাবণী বর্মণ নামে আরেক বন্ধু লিখেন, সকাল সকাল এই নিউজটা পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর বাসা পার হয়েই আমার বাসা যেতে হতো, সেই সুবাদে আলিফকে রাস্তায় প্রায়শই দেখতাম। আলিফ শুধু ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতেই নিহত হয়নি, একজন মেয়েকে তাদের হাত থেকে সর্বোচ্চ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।


আলিফের আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘আহ জীবন! আমার সহপাঠী, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শুরু থেকে যার সঙ্গে ওঠাবসা, ওরে আজ হারাইলাম; অন্যকে বাঁচাইতে গিয়ে সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। আমি বাকরুদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক, ভাই।


মানসুরুল হক (বাবু) বলেন, আলিফের মৃত্যুতে একটি মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেলেও তাঁর মা-বাবা কখনও ভুলতে পারবেন না ছেলের এভাবে চলে যাওয়া। তবে মহাকাল সবকিছুকে ধ্বংস করে দিলেও কিছু কর্ম, ত্যাগ, সৃষ্টি কখনও বিলীন হয় না। তেমনি মহৎ কোনো কাজের মাধ্যমে মৃত্যুর পরও অন্যদের মনে অমর হয়ে থাকেন কিছু কিছু মানুষ। মোন্তাকিম আলিফও এমনই একজন।


এই ঘটনায় বুধবার রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।


এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত দিবাকর অধিকারী বলেন, ঘটনাস্থল ঢাকায়। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য চাইলে ওখানে যোগাযোগ করতে হবে।


বিবার্তা/মিলন/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com